- বিপুল দাস
আশ্চর্য একটা মেয়ে শিউলি। ভুজঙ্গর ঘটনা শোনার পর সে প্রথমে খুব চিৎকার, হৈ-হল্লা করল, তারপর কেঁদে ভাসাল, ভুজঙ্গর স্বভাব একটু খারাপ বটে, কিন্তু একাজ সে করতেই পারে না। অত সাহস ওর হবেই না।
“দাদা, তোর তো সব উকিল ম্যাজিস্ট্রেটের সঙ্গে আলাপ আছে, থানাতেও চেনাজানা আছে, একটু বুঝিয়ে বল না ও একাজ করতেই পারে না। আমি জানি, বাথরুমে মাকড়সা দেখলে আমাকে গিয়ে তাড়াতে হয়। আমার চেয়েও ভীতু। ওর বন্ধুরা সাজিশ করে ওকে ফাঁসিয়েছে। ‘রূপনগরের সুন্দরী’ সিরিয়ালে সেম ঘটনা ছিল। দাদা, তুই ওকে বাঁচা।”
“দেখি, কী করা যায়” – সান্ত্বনা দেবার জন্যই তপন বলেছিল। তাছাড়া আর কী বলার আছে শিউলিকে। সে কোনও দিনই তার বরকে শাসন করার চেষ্টা করেনি। এমনকি চুরির দায়ে তার স্টেট ট্রান্সপোর্টের কনডাক্টরি চলে গেছে, সেটাই চেপে গেছে। তারপর থেকে দুজনে মিলে হিসেব কষে এ বাড়ির রক্ত চুষে গেছে। সবাই চুপ করে থেকেছে। ভেবেছে, যা করার তপন করুক। তপন কড়া কোনও স্টেপ নেবে নেবে করেও নিতে পারেনি।
তারপর আস্তে আস্তে শিউলি স্বাভাবিক হয়ে গেল। ভুজঙ্গর খবর সম্পর্কে আর কোনও আগ্রহ দেখা গেল না। বরং তপনের কানে খবর এল বাদলের সঙ্গে আবার মাখামাখি শুরু করেছে। এর মাঝে এক রাতে মা এসেছিল তার ঘরে।
“তপন, কী করি বলতো? কেন যে এমন মেয়েকে জন্ম দিয়েছিলাম। কুলের কলঙ্ক হয়েছে মেয়েটা।”
“শিউলির কথা বলছ তো? নতুন আবার কী করল?”
“ক’দিন হ’ল রোজ আমাকে বিরক্ত করছে, সিধুর বিয়ের জন্য নতুন গয়না কী কী করেছি, ওকে দেখাতে হবে। নতুন বৌয়ের জন্য নিশ্চয় অনেক গয়না বানানো হয়েছে। শুধু তাই নয়, আমার পুরোনো গয়নাগুলো কাকে কোনটা দিয়ে যাব ভেবেছি, তাও জানতে চাইছে। আমার একটা বিছেহার আছে, বিয়েতে আমার শাশুড়ি দিয়েছিলেন, সেটার ওপর ওর বহুদিনের লোভ। আমি ভেবেছিলাম, তোর বৌয়ের মুখ দেখব। সে তো আর আমার কপালে হল না। সিধুর বৌকেই দেব। শিউলির নজর পড়েছে সেটার ওপর। জানতে চাইছিল গয়নাগুলো কি বাড়িতে, না লকারে রেখেছি। আমার এখন সত্যিই ভয় করছে। পেটের শত্রু। ওর আর ভুজঙ্গর জন্য পাড়ায় তো আর মুখ দেখানোর পথ নেই। কোনও দিন ভাবিনি এ বাড়িতে পুলিশ আসবে। লিলিরও তো একদিন বিয়ে দিতে হবে। কোথা থেকে যে এমন মেয়ে আমার পেটে জন্ম নিল, ভগবান জানে। তুই একদিন কথা বল তো।”
“ঠিক আছে, তুমি ঘরে যাও। আমি দেখছি কী করা যায়।”
নিজের বোন সম্পর্কে ভাবতে খারাপ লাগে। এ কথা বাইরের কারও সঙ্গে তো দূরের কথা, বাড়িতেও সে আলোচনা করতে পারবে না। কিন্তু মনের ভাবনাকে আটকাবে কেমন করে। শিউলির ভেতরে সেক্সের প্রভাব খুব বেশি। তার সঙ্গে রয়েছে লোভ, উচ্ছৃঙ্খলতা, ভোগবিলাসের দিকে আকর্ষণ। এসবের জন্য কোনও রকম নৈতিকতার ধার সে ধারে না। এই ধরনের মেয়েদের জন্য সংসারে আগুন ধরে যায়। সত্যিই, তাদের ফ্যামিলিতে শিউলি বড় বেমানান। তপনের পরে মেয়ে হলে অতিরিক্ত আদর পেয়েছিল সবার। তার সব আবদার বাবা, মা মুখ বুজে মেনে নিত। তখনই শিউলির সর্বনাশ হয়ে গেছে।
কুয়াশা একটু একটু করে কেটে যাচ্ছে। আকাশে তাকালে সূর্যের অবস্থান বোঝা যায়, কিন্তু সূর্য স্পষ্ট দেখা যায় না। লিচু গাছের নীচে শুকনো পাতার ওপর কুকুরটা শুয়ে রয়েছে। বাচ্চা হবে দুলির। কুয়ো থেকে জল তুলে ভালো করে মুখ ধুয়ে, চোখমুখও পরিষ্কার করে নিল তপন।
সন্ধেবেলা কোর্ট থেকে ফিরে চা, জলখাবার খেয়ে লিলিকে বলল শিউলিকে ডেকে দিতে। একটু বাদেই শিউলি এসে তার দরজার সামনে দাঁড়াল। বাড়িতেও টাইট জামা আর একটা জিনস পরে রয়েছে। এত উগ্র দেখাচ্ছে তাকে যে, নিজের বোনের দিকেই তপন চোখ খুলে তাকাতে পারছিল না। মাথা গরম হয়ে গেল তার।
“দাদা, আমাকে ডেকেছিস? কিছু বলবি?”
“ভুজঙ্গ কবে ছাড়া পাবে, কিছু ঠিক নেই। আদৌ কোনও দিন জেলের বাইরে আসতে পারবে কি না, কেউ জানে না। তুই কি এখানেই থেকে যাবি, না শ্বশুরবাড়ি ফিরে যাবি, কিছু ঠিক করেছিস?”
“ওর কথা আমার সামনে আর বলিস না। মরুক হারামিটা।”
“চোওপ, আর একটা খারাপ কথা বললে বেত দিয়ে পিটিয়ে তোর পিঠের চামড়া তুলে দেব আমি। অনেক সহ্য করেছি। তোরা দুজন মিলে আমাদের সংসারটাকে তছনছ করে দিলি। ঘাড় ধরে এ বাড়ি থেকে বার করে দেব এবার। ভেবেছিস দাদা চিরকাল চুপচাপ ঘানি টেনে যাবে, আর তোরা সবাই আমার কাঁধের ওপর বসে ইচ্ছেমতো নাচবি।’’
“শুধু আমার দোষ দেখছিস। ভুজঙ্গই আমাকে উসকে দিত। “তোমার দাদার তো লক্ষ লক্ষ টাকা, বোনটা বিনা চালানে পার হয়ে গেল, যাও না কিছু আদায় করে আনো।” জানিস, আমাকে জিজ্ঞেস করত তোর সুটকেসের চাবি কি সবসময় তোর সঙ্গেই থাকে। তোর থেকে হাত পেতে যা দু’চার টাকা পেতাম, হাত মুচড়ে সে টাকা নিয়ে নিত। খারাপ জায়গায় গিয়ে সে টাকা উড়িয়ে আসত। অথচ আমাকে কোনও দিন কোনও সুখ দিতে পারেনি। না শরীরের, না মনের। পিঠের চামড়া তুলে দিবি। এই দেখ, আমার পিঠের অবস্থা। একশো বার হারামি বলব।”
এগিয়ে এসে শিউলির গালে প্রচণ্ড জোরে একটা চড় মারল তপন। মায়ের অভিযোগ, শিউলির ঔদ্ধত্য, তার দিকে পেছন ফিরে টপ তুলে কালশিটে-পড়া পিঠ দেখানো – এসব থেকে বেরিয়ে আসার জন্য মরিয়া হয়ে শিউলিকে আঘাত করল তপন। গালে হাত দিয়ে কয়েক সেকেন্ড অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে রইল শিউলি। তপন দেখল তার চোখে জল নয়, আগুনের দুটো ফুলকি দপ করে জ্বলে উঠল। আস্তে ঘরে ছেড়ে বেরিয়ে গেল শিউলি।
ভোরবেলায় লিলি এসে তার দরজায় ধাক্কা দিল। শিউলি তার ঘরে নেই। তার ছোট সুটকেসও নেই। লিলির টাকার ব্যাগ নেই। বাবার বালিশের নীচে চাবির গোছা নেই। মায়ের ট্রাংক খোলা।
বিকেলে ক্লাবের ছেলেরা এল। বাদল কাল রাতে বা আজ সকালের দিকে এসেছিল কি না, জানতে চায়। সকাল থেকে বাদল বাড়িতে নেই। কেউ জানে না কোথায় গেছে। বৌবাচ্চা রেখে কোথায় যাবে, কেউ বলতে পারছে না।
“তপনদা, আপনার বোন শিউলি কোথায়?”
“বলতে পারব না। আমি বাড়ি ছিলাম না। কোন বন্ধুর বাড়ি যাবে বলে দুপুরে নাকি বেরিয়েছে। ফিরলে আমি তোদের জানাব।”
“জানাতে হবে না। খোঁজ পেলে ওদের দুজনেরই মুণ্ডু এনে আপনাকে দেখিয়ে যাব। ওসব শান্তি চক্রবর্তী মানব না। এই ওয়ার্ডে কোনও দিন এসব ছিল না। কিছু মনে করবেন না, আপনার বোনটা এরকম রেন্ডি-টাইপ হয়ে গেল, শাসন করতে পারেননি? অথচ ছোট বোনটাকে মাথা নীচু করে চিরকাল রাস্তা দিয়ে হেঁটে যেতে দেখেছে সবাই। বল গোপাল?”
“লিলি তো? একদম।”
বালতিতে জল ছিল। আরও একবার ভালো করে মুখ পরিষ্কার করল তপন। তার মনে হচ্ছিল কাল রাতের বাসি খাবার এখনও তার মুখের ভেতরে রয়ে গেছে। তার মুখ থেকে, জামাকাপড় থেকে পচা, বাসি খাবারের দুর্গন্ধ বেরোচ্ছে। আবার চোখমুখ পরিষ্কার করল। এবার সিধুর বিয়ের জন্য মেয়ে দেখতে হবে। ভাগ্যিস প্রায় সব গয়নাই লকারে ছিল। তার বৌয়ের মুখ দেখবে বলে মা বিছেহার রেখে দিয়েছিল। মা, ওটা দিয়ে তুমি সিধুর বৌয়ের মুখ দেখো। তোমাদের কিছু ভাবতে হবে না। আমি আছি তো, বিয়ে আমি ঠিক তুলে দেব।
একুশ
মুকুন্দপুরের ফ্ল্যাটই নেবে বলে শেষপর্যন্ত ডিসিশন নিল টনি। টু বিএইচকে। এর চেয়ে বড় নিয়ে কী করবে সে। কে এসে রাত কাটাবে তার ফ্ল্যাটে। বড়জোর কামাল কিংবা অভয়। অভয়কে প্রথম দিন বাইশ বলে ডাকলে সে অবাক হয়ে তাকিয়েছিল। তারপর তার পিঠে একটা আদরের থাপ্পড় মেরে বলেছিল – আরে ইয়ার, তুম তো রুস্তম নিকলে। ওয়া উস্তাদ, ওয়াহ।
অদ্ভুতভাবে অভয়ের সঙ্গে তার যোগাযোগ। তাকে যেদিন ফ্ল্যাট দেখাতে নিয়ে যাবে বলে দালাল এসেছিল, রোশনলাল, তার সঙ্গে আরও একজন এলে দালাল আলাপ করিয়ে দিয়েছিল। অভয় মিশ্র। টনিকে ফ্ল্যাট দেখানো হয়ে গেলে অভয়কে নিয়ে সন্তোষপুরে যাবে। সেখানেও নতুন কিছু ফ্ল্যাট তৈরি হচ্ছে। অভয়কে দেখাবে।
টনিদের ফ্ল্যাটগুলো রেডি হয়ে ছিল। ফাইনালি কিছু চেঞ্জ করতে হবে কি না, সেটা আজ টনি বলে দেবে। বিশেষ করে টনি বলেছিল বাথরুম আর কিচেনের ফিটিংসগুলো সে দেখবে। তারপর ফাইনাল পেমেন্ট করে দরজার চাবি হাতে নেবে। রোশনলাল তাকে নিয়ে আজ যাবে বলে ফোনে জানিয়েছিল। ইন্ডিয়ান ওভারসিজ ব্যাংক ছাড়িয়ে বর্ণবিহার কমপ্লেক্সের কাছেই ওদের হাউজিং কমপ্লেক্স। গত এক বছরে বেশ কয়েকবার এখানে এসেছে টনি। আফসোস হয় দু’দিন আগে এলেও সেকেন্ড ফ্লোরের ফ্ল্যাটটা পেত। জাস্ট দু’দিনের জন্য সিক্সথে নিতে হলে। মানুষ পাগলের মতো মাথা গোঁজার জায়গা খুঁজে বেড়াচ্ছে। কলকাতায় একটা ফ্ল্যাট আছে মানে সে সব পেয়ে গেছে। ইহজীবনে তার আর কিছু পাওয়ার নেই। “আমার ফ্ল্যাট তো গণপতি টাওয়ারে” – বলার সময় স্পষ্টই বোঝা যায় আবেশে তার চোখ দু’টো আধবোজা হয়ে যাচ্ছে। মনে হয় ঘাড়ে কেউ নরম পালক দিয়ে সুড়সুড়ি দিচ্ছে। শহরতলির আত্মীয়স্বজনের কাছে তার পজিশন অনেক উঁচুতে।
টনিকে অভয় দাদা বলে ডাকলে টনি জানতে চেয়েছিল কোন ইয়ারে তার জন্ম।
“উনিশশো নব্বই, সেকেন্ড জুলাই। আপনার?”
“ওরে, তুই আমার জুড়ুয়া ভাই। কুম্ভমেলায় হারিয়ে গিয়েছিলি। বুকে আয় ভাই।”
টনি তাকে জড়িয়ে ধরলে হকচকিয়ে গিয়েছিল অভয়। টনিরও জন্মদিন ঊনিশশো নব্বইয়ের সেকেন্ড জুলাই শুনে অবাক হয়েছিল অভয়। সেও জড়িয়ে ধরেছিল টনিকে। টনির ইচ্ছে হয়েছিল এই কমপ্লেক্সেই অভয় ফ্ল্যাট নিক। রোশনলাল মাথা নেড়েছিল। উপায় নেই, এখানে সব বুকড হয়ে গেছে। এখন কেউ যদি ভাড়া দেয়, বা বিক্রি করতে চায় – তখন পাওয়া যেতে পারে। সেসব রোশনলালের দায়িত্ব নয়।
অভয়ের সঙ্গে খুব দ্রুত টনির ঘনিষ্ঠতা বেড়ে গেল। আসলে অভয়ের সেন্স অফ হিউমার, জ্ঞানগম্যির গভীরতা টনিকে আকৃষ্ট করেছিল। একই ভাবে রেসিপ্রোক্যালি টনির কথাবার্তা শুনে অভয় বুঝেছিল তাদের দুজনের ভাবনার কোথাও বেশ মিল আছে। ফ্রিকোয়েন্সি মিলে যাচ্ছে। কম লোকের সঙ্গেই এরকম হয়। সুন্দর সখ্য গড়ে উঠেছিল তাদের মধ্যে। টনি ঠিক করেছিল এবার আনন্দকে দেখতে যাওয়ার সময় অভয়কে সঙ্গে নিয়ে যাবে।
যেদিন ওরা দুজন আনন্দকে দেখে ফিরে এল, অভয় ওর সঙ্গে নতুন ফ্ল্যাটে এল। অভয়ের সঙ্গে গাড়ি ছিল। ফেরার পথেই দুজনের মতো রুটি-মাংস নিয়েছিল টনি। মদ তার ঘরেই আছে। খাটের সামনে টেবিল টেনে নিল টনি। অভয় টনির বইয়ের আলমারির সামনে দাঁড়িয়ে বইগুলো দেখছিল। পিঠের নীচে বালিশ রেখে আধশোয়া হল টনি। গ্লাস তুলে টনি চিয়ার্স করল। অভয়ও।
“অনেক বই তো। সব পড়া তোর?”
“সব আমার নয়, কিছু বাসুকাকু বলে একজন দিয়েছিল। অভয়, বাইরে রাত কাটাচ্ছিস, ফিরতে দেরি হবে — বাড়িতে জানাবি না? বলে দিস একেবারে খেয়ে ফিরবি। দুটো কাজু দে তো।”
টেবিলের উলটোদিকে সিঙ্গল সোফায় বসল অভয়। টনির বিছানায় দুটো কাজু ছুড়ে দিল। দুটোই লুফে নিল টনি। জন্টি – একচোখ টিপে বলল অভয়।
“ধ্যুস, কত রোডস ফসকে গেল। ওর’ম মনে হয়। আমাকে আর একটা আইস-কিউব দে। দেরি না করে বাড়িতে ফোন করে দে। আমার অস্বস্তি হচ্ছে।”
“আমারও এরকম হয়। বিশ্বাস করবি না, কেউ চুরি করছে দেখলে আমারই লজ্জা করে। চোখ সরিয়ে নিই, যদি ওর চুরি আমি দেখে ফেলেছি বুঝে লজ্জা পায়। তোকে বললাম, অন্য কেউ শুনলে আমাকে গান্ডু ভাববে।”
“আমারও হয়। মুখ ঘুরিয়ে নিই। জানিস, বিসর্জনের মিছিলে ধাড়ি ধাড়ি মেয়েদের আর ছেলেদের মৃগীরোগীর মতো নাচতে দেখলে আমার ভীষণ লজ্জা করে। চোখ ঘুরিয়ে তাড়াতাড়ি সরে যাই।”
“আমার লজ্জা করে বয়স্ক লোকদের হাউমাউ করে কাঁদতে দেখলে। আমাদের কোম্পানির একজন সিনিয়ার সেলসম্যান, এরিয়া ম্যানেজারের সঙ্গে খিটিমিটি আগেই ছিল, টার্গেট নিয়ে হেভি গোলমাল লাগল। ঘোষদা, বেচারা বৌয়ের চিকিৎসার জন্য নাজেহাল, মালদার ট্যুরে যেতে পারেনি – ঝাড় খেয়ে দেখি ক্যান্টিনে বসে হাউহাউ করে কাঁদছে। বল, এতবড় একজন মানুষকে বাচ্চাদের মতো কাঁদতে দেখলে কেমন লাগে। মালটা কিন্তু স্মুদ আছে। ভালো কথা, হসপিটালে দীপা নামের যে মেয়েটার সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিলি, তোর সঙ্গে কথা বলছিল, আমার মনে হল তোর সঙ্গে কোনও অ্যাফেয়ার আছে।”
“কেন, কেন তোর এরকম মনে হল? আরে, ও তো আমার বন্ধুর বৌ। আনন্দকে তো দেখলি। লস্ট কেস। ভালো না মেয়েটা?”
“কিছু মনে করিস না, কত ইনভেস্ট করেছিস? মেয়েটার জন্য তুই অনেক খসিয়েছিস, কিন্তু মেয়েটার কিছুই খসাতে পারিসনি। শোন, মেয়েদের ব্যাপারে তোর চেয়ে আমার এক্সপিরিয়েন্স অনেক বেশি। তোকে কিন্তু মেয়েটা ভেতর থেকে পছন্দ করে না। তোকে দেখেই মেয়েটার চোখে এক রকম আলো জ্বলে উঠেছিল। দ্যাটস নট দা ফ্লেম অফ লভ। এই গ্লাস ছুঁয়ে বলছি, সম্ভবত তোকে ঘৃণা করে।”
“এক্সপিরিয়েন্স অনেক বেশি? ক’টা মেয়ের সঙ্গে মিশেছিস? তুই জানিস, আনন্দ আমার কাজিন। আমরা ছোটবেলায় একসঙ্গে বড় হয়েছি। দীপা একটা জেম। তোর রিডিং ভুল হয়েছে।’’
“হলে আমি খুশি হব টনি। আর শোন, জীবনে একজন মেয়ের সঙ্গেই মিশেছি, তাকেই বিয়ে করেছিলাম।”
“করেছিলাম, মতলব?”
“লস্ট কেস। অলকা বেহরা অ্যাকচুয়ালি ভুবনেশ্বরের মেয়ে। আমি তখন ভুবনেশ্বরে পোস্টিং। আমাদের কোম্পানির একটা কালচারাল প্রোগ্রামের জন্য আমরা একটা এজেন্সিকে কিছু আর্টিস্ট দিতে বলেছিলাম। ভালো পেমেন্ট দেয় কোম্পানি। ভালো মানে, মোর দ্যান এক্সপেক্টেশন। এই মেয়েটা, দ্যাট হোর, সোজা আমার অফিসে এসেছিল আমাকে নির্লজ্জভাবে ফ্ল্যাটারিং করতে। টু বি প্রিসাইজ, বুকের আঁচল ফেলে। তারপর কোথা হইতে কী হইয়া গেল …’’
“মোহন পলাইয়া গেল।”
“ইয়ে”। সামনে হাত বাড়াল অভয়। টনি বিছানা থেকেই করতল তার দিকে ছুড়ে দিয়ে হাই ফাইভ করল। এই জন্যই অভয়কে এত ভালো লাগে।
“আগে বাঢ় অভয়, আস্তে খা। এনজয় কর। তোরা কি উড়ে ? গাছে দুটো পাখি ছিল, নীচ দিয়ে একটা উড়ে গেল। এখন গাছে কয়টা পাখি আছে?”
“আমাদের পূর্বপুরুষ বাংলার বাইরে থেকে এসেছিল। শুনেছিলাম কনৌজ থেকে। কী যেন, সম্ভবত ভবানন্দ মিশ্র। সেই লেজ ধরে একদম শেষে আমি অভয়ানন্দ ঝুলে আছি। বেশ খানদানি ব্রাহ্মণ আমরা।”
“লজ্জা করে না ভবানন্দ মিশ্রের বংশধর হয়ে অনাচার করছিস। বাদ দে, সেই মেয়েটার কথা বল। বুকের আঁচল ফেলে দিয়েছিল। আমি না কল্পনায় সেই সিনটা দেখার চেষ্টা করছি।”
“কিছু মনে করিস না, তোকে মাঝে মাঝে স্যাডিস্ট মনে হয় আমার। কোথাও একটা পারভার্সন আছে তোর। হ্যাঁ, ফেঁসে গিয়েছিলাম। অলকা বেহরা আমাকে কুকুরেরও অধম বানিয়েছিল। ভাদ্রমাসের কুকুর ছিল অলকা। আমাদের বিয়ে হয়েছিল। জাস্ট এক বছর বাদেই আমি আবিষ্কার করলাম, দাঁড়া, আর একটা নেব। হুঁ, এক বছর বাদেই অলকা আমার কাছে ধরা পড়ল, এক্সট্রা ম্যারাইটাল অ্যাফেয়ার্স চালিয়ে যাচ্ছে। আ বিচ। এই নে বাদাম, ধর। অনেক রাতেও দেখি মোবাইল নিয়ে বাথরুমে যাচ্ছে। তখনই সন্দেহ হয়েছিল। তক্কে তক্কে ছিলাম। ঘুমিয়ে পড়তেই ওর মোবাইল নিয়ে খুলে দেখি, শালা খুলতেও ঝামেলা। কী একটা প্যাটার্ন কোড করে রেখেছে। কিছুক্ষণ চেষ্টা করে ক্র্যাক করেছি। না করলেই ভালো হত রে।”
“আগে বাঢ়, আমাকে আর একটা দে। আজ আমি অনেক খাব। অলকা ইয়াগনিক, কী বলে, বেহরা …।”
“টনি, কলেজে পড়ার সময় হলুদ সেলোফেন পেপারে মোড়া চটি বই পড়েছি। তারপর ডিভিডি জোগাড় করে পর্নো দেখেছি। অলকার মেসেঞ্জার ওপেন করে দেখলাম সে সব তুশ্চু। বাচ্চা একটা ছেলের সঙ্গে চূড়ান্ত নোংরামি করে গেছে দীর্ঘদিন ধরে। পার্ভার্টেড, আ বিচ। অপশন দিয়েছিলাম, কন্টেস্ট করলে কোর্টে সব জানাব আমি। মিডিয়া সব জানবে। খবরের কাগজে বেরোবে। আর যদি কন্টেস্ট না করে, আমি একতরফা ডিক্রি পেয়ে যাব। অ্যালিমনি আমরা সেটেল করে নেব। আমি অলকাকে মেরেছিলাম। তাও নানা রকম গল্প বলে নিজের অন্যায় ডিফেন্স করার চেষ্টা করেছে।”
“এখন?”
“আসেনি, একটা ডেটও অ্যাটেন্ড করেনি। আমি ডকে দাঁড়িয়ে প্রশ্নের উত্তর দিয়েছি। এখন একা আছি, বেশ আছি। সব পেলে নষ্ট জীবন, একটা গান আছে। বাড়িতে কাকে ফোন করে বলব আমার ফিরতে দেরি হবে। বল, স্বাধীনতা হীনতায় কে বাঁচিতে চায় হে…।”
“রঙ্গলাল বন্দ্যোপাধ্যায়। দাসত্ব-শৃঙ্খল বল কে পরিবে পায় হে। হুঁ, এই বেশ ভালো আছিস। নিজে ড্রাইভ করে ফিরবি, বেশি নিস না। তিনটে হয়ে গেছে তোর।”
“ভাবিস না, স্টেডি আছি। একটা কথা টনি, তুই বোধহয় একটু বেশি ড্রিংক করিস। কন্ট্রোলে রাখিস। রোজ খেতে হলে লিমিটের মধ্যে রাখিস।”
“আ-হা, তোকে আমার অনেক কথা বলার আছে। জানিস, রাস্তায় হাজার লোকের মাঝে হাঁটতে থাকি। তবু আমার মনে হয় আমি একা। এটা বোধহয় কোনও অসুখ। আমি অত তাড়াতাড়ি মরব না। কত কাজ এখনও বাকি রয়েছে। লাল নীল মাছের সাঁতার কাটা দেখব না? মুনফিশ, গাপ্পি, জেব্রা ড্যানিও, নিয়ন টেট্রা। আচ্ছা অভয়, পৃথিবীর সব মেয়ে কি একরকম?”
টনির দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসল অভয়। সে টনিকে সাবধান করতে পারে, জোর করতে পারে না। টনির ভেতরে কিছু সমস্যা আছে। কোথাও একটা অস্বাভাবিক ব্যাপার আছে। হঠাৎ মাছের কথা আসে কোথা থেকে। (চলবে)