- কৌশিক দত্ত
বুরুন অঙ্কে ১৩ পেয়েছিল। তাই নিয়ে কী কাণ্ড। গোঁসাইবাগানের ভূতেরা পর্যন্ত হিমসিম খেয়ে গেল। আমাদেরও একই অবস্থা। ভোটের অঙ্ক মিলছে না। কোথাও তেমন রিগিং হল না, দু-একটা লাশ পড়ল না। এ আবার কেমন ভোট?
পাঁচ দফার ভোট ইতিমধ্যে শেষ। মালদা-মুর্শিদাবাদ-বীরভূমের মতো মারকাটারি জায়গায় ভোট হয়ে গেল প্রায় নিঃশব্দে। একটা বুথে রি-পোল পর্যন্ত হল না। কেমন যেন শ্মশানের শান্তি।
অঙ্কটা ভালোই এগোচ্ছিল। হঠাৎ একটা খুচরো ঘটনা সব ওলটপালট করে দিল। মানে ধূপগুড়ির কথা বলছিলাম। যে অশান্তির জেরে দু’দিন দাঁত-নখ বের করে দেখাল উত্তরবঙ্গে শান্ত বলে পরিচিত ওই শহরটি। তাও কি না উত্তরবঙ্গে ভোটপর্ব চুকে যাওয়ার পর। কেন এমন হল?
একটু খতিয়ে দেখা যাক। মাঝরাতে একটি ধর্মস্থানে হামলা করল জনাকয়েক দুষ্কৃতী। জনাকয়েক বলছি, কারণ, ধর্মস্থানের মূর্তিকে কারও একার পক্ষে সরানো সম্ভব ছিল না। পুলিশ নাকি বলছে, অপ্রকৃতিস্থ কারও কাজ। তাহলে ধরে নিতে হয়, জনাকয়েক পাগল বা মাতাল দলবেঁধে গিয়েছিল হামলা করতে। তাও কি না এমন একটা ধর্মস্থান, যেখানে আড়াই বছর আগে একই কায়দায় হামলা হয়েছিল। মাতাল বা পাগলের স্মৃতিশক্তির উপর শ্রদ্ধা হচ্ছে। আরও অবাক কাণ্ড, ঠিক তার পাশে আরেকটি ধর্মস্থানে একটা ঢিল পর্যন্ত ছোড়েনি দুষ্কৃতীরা। শোনা গিয়েছিল, আরও কয়েকটি ধর্মস্থানে হামলা হয়েছে। কিন্তু সেগুলো নিতান্তই ছোট ঘটনা।
তর্কের খাতিরে ধরে নেওয়া যাক, দুষ্কৃতীরা অন্য সম্প্রদায়ের। আশপাশ থেকে খবর পেয়েছি, ওই ‘অপ্রকৃতিস্থরা’ নাকি ধর্মস্থান ঝাঁট দিয়ে পরিষ্কার করেছিলেন। বিশ্বাস করুন, পরধর্মে এত শ্রদ্ধাশীল বিধর্মী মাতাল বা পাগলের কথা আগে কখনও শোনা যায়নি। তাহলে কারা হামলা করেছিল? ঘটনার চারদিন পরেও পুলিশ তা জানতে পারেনি। ভবিষ্যতে পারবে, এমন আশাও বোধহয় কেউ করেন না। যারা ওইদিন পুলিশ সুপারের মুচলেকা আদায় করেছিলেন, তাঁরাও না।
ঘটনাস্থল খলাইগ্রামের মোরঙ্গা মোড় উত্তরবঙ্গের আর পাঁচটা শহরতলির মতো। মিলেমিশে হিন্দু-মুসলিমের বাস। ধূপগুড়ি শহরের দিকে এগোলে হিন্দুদের আধিক্য, উলটোদিকে শালবাড়ি পর্যন্ত মুসলিম বসতি। গত ১০০ বছরে এই এলাকায় সাম্প্রদায়িক অশান্তির রেকর্ড নেই। আড়াই বছর আগে যখন ওই ধর্মস্থানে হামলা হয়েছিল, তখনও অশান্তি হয়নি।
একটা প্রশ্ন মনে খচখচ করছে। ভোরে ধর্মস্থানে হামলার খবর পেয়ে পুলিশ ও প্রশাসন কেন দ্রুত ব্যবস্থা নিল না? আড়াই বছর আগে হামলার সময় কিন্তু খবর জানাজানি হতে সকাল ৭টার মধ্যে পুলিশ ও প্রশাসন মূর্তি সরিয়ে বিসর্জন দিয়ে ফেলেছিল। এবার পুলিশের ঘটনাস্থলে পৌঁছে ব্যবস্থা নিতে বেলা ১১টা বেজে গেল। অথচ ওই জায়গায় এমন পরিস্থিতি মোকাবিলার সফল অভিজ্ঞতা পুলিশের ছিল। তাহলে কি গণ্ডগোল জিইয়ে রাখার জন্য চাপ ছিল পুলিশের উপর?
পুলিশ সময়ে না গেলেও সকাল সকাল ঘটনাস্থলে হাজির হয়ে যায় এবিভিপি। আরএসএসের ছাত্র সংগঠন। ধর্মস্থানে হামলা বলে কথা, এই সংগঠনটির তো হাজির হতেই হবে। বেলা বাড়তে আরও হাজার হাজার ‘ধর্মপ্রাণ’ মানুষ জড়ো হয়ে গেলেন। কী উন্মাদনা তাঁদের! স্থানীয়রা, এমনকি ধূপগুড়ি শহরের মানুষও স্বীকার করবেন, সেদিন যারা দাপিয়ে বেড়িয়েছে, তাদের অধিকাংশ এলাকায় চেনা মুখ নয়। তাহলে প্রশ্নটা হল, এত লোককে কে খবর দিলেন আর কী উদ্দেশ্য? কোনও সংবাদমাধ্যমে তো ধূপগুড়ি তখনও ‘ব্রেকিং নিউজ’ হয়নি।
আরও অবাক লাগল এটা শুনে যে, দোষীদের শাস্তির থেকেও পুিলশের কাছে ওই উত্তেজিত জনতার দাবি ছিল, মিডিয়াকে ডাকতে হবে। এসপি-ডিএমকে ঘটনাস্থলে আসতে হবে। এত প্রচারের দাবি কেন? টিভি চ্যানেল আর সংবাদপত্রের মাধ্যমে যাতে রাজ্যজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে সাম্প্রদায়িক অশান্তির খবর?
আরও কিছু তথ্য উল্লেখ করার মতো। যেমন, এমন একটা রাতে হামলা হল, যখন ধূপগুড়ির এসডিপিও এবং অ্যাডিশনাল এসপি দুজনই শহরের বাইরে। স্থানীয় পুলিশ ফোর্সের একাংশও দক্ষিণবঙ্গে ভোটের জন্য ব্যস্ত। ফলে পরিস্থিতি সামলাতে ফোর্স এল আলিপুরদুয়ার, জলপাইগুড়ি আর শিলিগুড়ি কমিশনারেট থেকে। সেই সুযোগে অশান্তি জিইয়ে রাখতে অনেকটা সময় পাওয়া গেল।
আবার প্রশাসন ও শাসকদলের কথা ভাবুন। পুলিশ প্রথম পর্বে যতটা নিষ্ক্রিয় ছিল, বেলা বাড়ার পর ততটাই সক্রিয় হল। অর্থাৎ প্রথম পর্বে রাজ্য সরকারের কট্টর বিরোধী ছাত্র সংগঠনকে ময়দান ছেড়ে দেওয়া হল। তারা যতটা সম্ভব প্ররোচনা দিল। অনেক পরে মাঠে নামলেন শাসকদলের নেতারা। স্থানীয় ওই নেতাদের মুখের সামনে হম্বিতম্বি করে গেল এলাকার বাইরে থেকে আসা একদল উঠতি বয়সের তরুণ। নেতারা চুপ করে শুনলেন।
এরপর অবরোধ, আগুন জ্বালানো, আইসি-র মাথা ফাটানো ইত্যাদি হল। আরও বেলার দিকে ব্যাপারটা আরেক ধর্মস্থানে হামলার মতো বাড়াবাড়ির পর্যায়ে চলে গেল। ঠিক তখন স্থানীয় বিজেপি নেত্রী মাঠে নামলেন। নিজের দলের সমর্থকদের আটকে দিলেন দায়িত্ব নিয়ে। শাসকদলের স্থানীয় নেতারা তখনও চুপ করে ছিলেন। ভাবতে অবাক লােগ, ধূপগুড়িতে শাসকদলের বিধায়ক আছেন। পুরসভাতেও শাসকদল ক্ষমতায়। তাহলে সেই দলের সংগঠন কেন মাঠে নামল না? এই নীরবতা, নিষ্ক্রিয়তা কি ইচ্ছাকৃত? কেমন একটা মিলিজুলি বোঝাপড়ার গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে না?
উত্তরবঙ্গে ভোট শেষ। দক্ষিণবঙ্গেও দু’দফা ভোট হয়ে গেল। রাজ্যের শাসকদল আর প্রধান বিরোধী দলের কোনও নেতাই বুক ঠুকে বলতে পারবেন না, কোন আসনের ফল কী হবে। তবে, বিভিন্ন মহল থেকে খবর আসছে, শাসক বা বিরোধী কেউ স্বস্তিতে নেই। কারণ, রাম-রহিেমর ভোট ভাগ করার সরল পাটিগণিতটা এবার অনেক জায়গায় মেলেনি। তার চাপেই কি মেরুকরণের তত্ত্ব আরেকবার ঝালিয়ে নেওয়া জরুরি হয়ে পড়েছিল? ভোটারদের বুঝিয়ে দেওয়া দরকার ছিল- তুমি কোন দলে, রাম না রহিম? এর বাইরে অন্য কিছু ভেবো না।
এখনও দু’দফার ভোট বাকি রাজ্যে। তার সবটাই দক্ষিণবঙ্গে। সেখানকার ভোটারদের মেরুকরণ তত্ত্ব আরেকবার বোঝাতেই কি গিনিপিগ করা হল ধূপগুড়িকে?
যে যাই বলুন, গন্ধটা খুব সন্দেহজনক।