শমিদীপ দত্ত, শিলিগুড়ি: মেয়ের এখনও বিয়ে না হওয়ায় সম্পত্তি ভাগাভাগি করবেন না বলেই ঠিক করেছিলেন ঊষারানি সিং। ছেলেকে সেকথা জানিয়েও দিয়েছিলেন। তবে ছেলে মায়ের সেই অনুরোধ মানল কোথায়? আসলে কথায় আছে, সম্পত্তির কাছে নাড়ির টানও ফিকে হয়ে যায়। হলও তাই। সম্প্রতি নিজের সিদ্ধান্তে অনড় থাকার মাশুল গুনতে হল ঊষারানিকে। ছেলের মারধরে মাথা ফাটায় তাঁকে ভর্তি হতে হল শিলিগুড়ি জেলা হাসপাতালে। শেষমেশ আর কোনও রাস্তা না পেয়ে ছেলের বিরুদ্ধে শিলিগুড়ি মহিলা থানায় অভিযোগ দায়ের করতে বাধ্য হলেন ওই অভাগা মা।
ওই ঊষারানি নন, সম্পত্তির লোভে ছেলের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে পুলিশের দ্বারস্থ হচ্ছেন অনেক মা-বাবাই। গত এক মাসের হিসেব ধরলে শিলিগুড়ি কমিশনারেট এলাকার প্রতিটি থানা, ফাঁড়ি মিলিয়ে এধরনের অভিযোগ জমা পড়েছে ৩৫টি। যেখানে ঘটা করে পিতৃদিবস, মাতৃদিবস উদযাপনের হিড়িক বেড়েছে, সেখানে এমন ঘটনা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় সমাজের অন্ধকার দিকটা।
পুলিশ সূত্রে জানা গিয়েছে, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখা যাচ্ছে মা কিংবা বাবার ওপর অত্যাচারের মূল কারণ হয়ে উঠছে সম্পত্তি। ৩৫টি অভিযোগের মধ্যে ২০টি ক্ষেত্রেই দেখা গিয়েছে, মা কিংবা বাবাকে বাড়ি থেকে বের করে দেওয়া হয়েছে। কোনওক্ষেত্রে আবার বের করার চেষ্টা চলছে।
এই যেমন বছর পঁয়ষট্টির গীতা ভৌমিকের কথা ধরা যাক। নিজের বাড়ি থাকলেও দুই ছেলের অত্যাচারে একটি ভাড়াবাড়িতে দিন কাটছে তাঁর। ছেলের বিরুদ্ধে পানিট্যাঙ্কি ফাঁড়িতে অভিযোগও দায়ের করেছেন। গীতা বললেন, ‘একটি গোডাউন ভাড়া দিয়ে আমার নিজের খরচ চলে। ছেলেরা এখনও সেটাও নিয়ে নিতে চাইছে।’ অসহায় ওই মহিলার প্রশ্ন, ‘আমি তাহলে যাব কোথায়?’
নিম্নবিত্ত নয়, বরং মধ্য ও উচ্চবিত্ত পরিবারেই সন্তান ও বাবা-মায়ের মধ্যে এমন বিবাদ বেশি বলে মত পুলিশকর্তাদের। আর এই কথা শুনেই মনে পড়ে যায় নচিকেতার সেই বিখ্যাত গানের লাইন, ‘ছেলে আমার মস্ত মানুষ, মস্ত অফিসার…’। নচিকেতা এই গান গাওয়ার পর কেটে গিয়েছে দেড় দশক। কিন্তু ছবিটা বদলায়নি।
এক পুলিশকর্তার পর্যবেক্ষণ, আসলে সম্পত্তি যত বেশি, তত বেশি ঝামেলা। এই যেমন মৃত ছোট ছেলের বিমার টাকা দিয়েই বড় ছেলের সঙ্গে মিলে বাড়ি তৈরি করেছিলেন বছর ষাটের এক মহিলা। তবে সেই বাড়িই কাল হয়ে গেল। সম্প্রতি ওই বৃদ্ধা ভক্তিনগর থানায় এসেছিলেন। বললেন, ‘বাড়ি তৈরির পর ছেলে ও ছেলের বৌ আমাকে বাড়ি থেকে বের করে দেওয়ার চেষ্টা করছে। বলছে এই বাড়িতে আমার কোনও অধিকার নেই। কিছুদিন আগে আমাকে দিয়ে বিমার কথা বলে সইও করিয়ে নিয়েছে।’
পুলিশ সূত্রে জানা গিয়েছে, ইদানীং সই জাল করে সম্পত্তি নিয়ে নেওয়া কিংবা ভুল বুঝিয়ে সই করে নেওয়ার প্রবণতা বাড়ছে। সম্প্রতি আশিঘর ফাঁড়িতে এধরনের একটি অভিযোগ জমা পড়েছে। যেখানে এক বৃদ্ধ জানিয়েছেন, স্ত্রী তীর্থ করতে যাওয়ায় তিনি বাড়িতে একাই ছিলেন। এই সুযোগকে কাজে লাগিয়েই ভুল বুঝিয়ে ছেলে জমি-বাড়ি সব লিখিয়ে নেয়।
যদিও অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অভিযুক্তদের ছেলেদের ধমক দিয়ে অভাগা ওই বাবা কিংবা মাকে বাড়িতে ঢুকিয়ে দিয়ে আসা ছাড়া অন্য কোনও উপায় থাকছে না পুলিশ প্রশাসনের কাছে। পুলিশের এক কর্তার কথায়, ‘অধিকাংশ ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে, মানসিক অত্যাচার করা হচ্ছে। এক্ষেত্রে মেইনটেনান্স অ্যান্ড ওয়েলফেয়ার অফ পেরন্টস অ্যান্ড সিনিয়ার সিটিজেন্স আইন অভিযুক্তের বিরুদ্ধে জারি হচ্ছে। এটা বেলেবল সেকশন হওয়ায় কোর্টেই অভিযুক্ত জামিন পেয়ে যাচ্ছে। আর মারধর করলে আইপিসি ধারায় ১৫ থেকে ২০ দিন জেলে রাখা যাচ্ছে।’ হাইকোর্ট পর্যন্ত মামলা গেলে তবেই বিচারকের নির্দেশমতো অভিযুক্তের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার শক্তি বাড়ছে বলে জানাচ্ছেন পুলিশকর্তারা। বিষয়টি স্বীকারও করছেন শিলিগুড়ি বার অ্যাসোসিয়েশনের সম্পাদক অলোক ধাড়া। তিনি বলছেন, ‘মেইনটেনান্স অ্যান্ড ওয়েলফেয়ার অফ পেরন্টস অ্যান্ড সিনিয়ার সিটিজেন্স অ্যাক্টে বাবা, মায়েরা তাঁদের সম্পত্তি ফিরিয়ে নিতে পারেন। তবে এতে করে কোনও শাস্তি ছেলেকে দেওয়া যায় না।’