রূপায়ণ ভট্টাচার্য, হাথরস: কথা বলার সময় উপরের নিম গাছ থেকে ক্রমাগত মাথায় পড়ে চলেছে নিম ফুল। মাথার চুলে লেগে থাকে ফুলগুলো। বক্তা জানতেও পারছেন না। এত আন্তরিকতা নিয়ে কথা বলায় নিমগ্ন তিনি। কতদিন পর মনের কথা বলতে পারছেন কাউকে! টুকরো টুকরো বাক্য। অপমান, অসহায়তা, ক্ষোভ লেগে তরুণের সংলাপে।
— আমাদের হাতটা কেটে দেওয়া হয়েছে। আমরাই যেন প্রতিবাদ জানিয়ে সব অন্যায় করে ফেলেছি।
— ওই যে বাইরে দেখুন, ওরা তিনটে ছেলে ঘুরে বেড়াচ্ছে। ওরা ঠাকুর। অপরাধ করে দিব্যি আছে। আমরা দলিত। আমরা বাড়ি থেকে বেরোতে পারছি না।
— আমার দিদির মৃতদেহ আমরা কেউ দেখিনি। দেখতে দেওয়া হয়নি। ওটা ওর দেহ ছিল কি না, আমরা আজও নিশ্চিত নই।
— সরকারের দেওয়া টাকা শেষ হলে খাব কী জানি না। সরকার কী চায়, এই গ্রাম থেকে আমরা উঠে চলে যাই?
কথা চলছে এবং একেবারে দরজার উলটোদিকের মাঠে গ্রামের প্রায় শ-খানেক মানুষ প্যান্ডেল খাটিয়ে গীতা পাঠ করছেন। মাইকে তারস্বরের নামগানে ঢাকা পড়ে যাচ্ছে এদিকের কথাবার্তা। ওই গীতা পাঠের ভিড়েই বহু আলোচিত গণধর্ষণে অভিযুক্ত ঠাকুররা। একেবারে সিনেমার দৃশ্যের মতো মনে হচ্ছে এসব শুনতে শুনতে, দেখতে দেখতে। সত্যিই কি এসব চোখের সামনে হচ্ছে? নাকি মনের ভ্রম?
কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারী, ভোটের বাজারে লক্ষ লক্ষ ভাষণে এই জায়গার নাম উঠে এসেছে। হাথরস, হাথরস! সেই হাথরসের বহু আলোচিত গণধর্ষিতার বাড়ির বাইরের উঠোনে বসে আছি। কথা বলছেন তাঁর ভাই। পাশে বসে বাবা। মাঝখানে দাঁড়িয়ে দাদা। বারবার মাথায় ঘুরছে, সেই মৃত মেয়েটিও হয়তো এখানে নিম ও বাবলা গাছের এই ছায়ায় দৌড়োদৌড়ি করে বেড়াত। গৃহপালিত গোরুটি খাচ্ছে সামান্য দূরে। তাকে হয়তো আদর করত।
হাথরস নিয়ে প্রতিবাদের ঝড় তোলা মানুষজন জানে না, চার বছর ধরে এই পরিবার একঘরে। অভাবনীয় অবস্থায় দিন কাটছে, সিআরপিএফের পাহারায়। বাইরের বিশ্বের সঙ্গে যোগাযোগ বলতে টিভি। বাড়িতে একটাই মোবাইল। সেটা ছোট ছেলের।
এভাবে লোক কি বাঁচে? বাড়ির চারদিকে জওয়ানরা বসে। ঢোকার মুখে মেটাল ডিটেকটর। পাশে ব্যারিকেড করে রাখা ঘরে দুই জওয়ান। চারপাশে আরও গোটা কুড়ি জওয়ান। বাড়ির বাসিন্দাদের মধ্যে ছয়জন বড়, তিনজন ছোট। নিজের গ্রামেও একা বেরোনোর অধিকার নেই ওদের। মাসের বাজার করে আনতে হয় সিআরপিএফের সঙ্গে গিয়ে। আদালতের নির্দেশ, এদের নিরাপত্তা দিতে হবে। তাই এক কোম্পানি জওয়ান দূরের কলেজে আস্তানা গেড়েছে। পালা করে এই অদ্ভুত ডিউটি। সেখানে জঙ্গিপুরের এক বাঙালি জওয়ানের সঙ্গে দেখা হল।
আসলে হাথরস নয়, আসল জায়গার নাম বুলগরহি। আগ্রা থেকে যে রাস্তাটা আলিগড় চলে যাচ্ছে, সেখানে হাথরস-আগ্রা, দুই জেলার সীমানায় একটা অতি ছোট্ট গ্রাম। এ ধরনের ছোট জায়গার সঙ্গেই ‘গরহি’ শব্দ লেখা থাকে। যেতে যেতে সব গ্রামের নামের বোর্ড রাস্তার ধারে পাওয়া যায়। চন্দাপা, বাধনা, বিসানা, কেবলগরহি, নাগলাপুরা…।
আগ্রার শেষ বড় শহর সাদাবাদ পেরোনোর মাইল তিনেক পর একটা বিশাল মন্দির তৈরি হচ্ছে। ডানদিকের সরু রাস্তা ধরে, বাজরার খেতের মাঝ দিয়ে, বাবলা গাছের বেড়ার পাশ গিয়ে মাইলখানেক গেলে সেই বহু আলোচিত বাড়ি। জেলা শহর হাথরস ওখান থেকে অনেকটাই দূর। গ্রামে ঢুকে বেশি খুঁজতে হয়নি বুলগরহির ধর্ষিতার বাড়ি। রুক্ষ গ্রাম। ঢোকার মুখে ডানদিকের মাঠে পূজাপাঠ চলছে। যজ্ঞ, গান, প্রসাদ বিতরণ।
ভাবছিলাম, ওখানেই কারও কাছে জেনে নেব বাড়ির হদিস। দরকার পড়ল না। রাস্তার উলটোদিকের বাড়িতেই দেখি, সিআরপিএফ ক্যাম্প। বিহারের সাসারামে বাড়ি এক জওয়ানের। তিনিই নিয়ে গিয়ে বসালেন উঠোনে। ভেতর থেকে ডেকে আনলেন নির্যাতিতার ভাইকে। কথার মাঝে নিঃশব্দে পাশে এসে বসলেন বাবা।
মেয়েকে হারানোর চোখের জল ফুরিয়ে গিয়েছে ভদ্রলোকের। এখন সেখানে অজানা আশঙ্কা। এভাবে কতদিন চলবে জীবন? ‘দুই ছেলে গাজিয়াবাদে চাকরি করত। এখন তো নিরাপত্তার জন্য ওদের বাইরে যেতে দিচ্ছে না সরকার। অত বড় ঘটনা হল। সরকার থেকে কেউ আসেনি খোঁজ নিতে। আমরা দলিত। গ্রামে সব রাজপুত, পণ্ডিত, ব্রাহ্মণ- উঁচু জাতের লোক। সরকার এত ভোট হারাতে চায় না’ বলে যেন নিজেকে শোনানোর ঢঙে যোগ করলেন, ‘চার বছর ধরে সিআরপিএফ রাখতে এত খরচ হচ্ছে। তার বদলে একটা চাকরি দিতে পারত।’
জাতীয় সড়ক থেকে এত কাছের গ্রামে এমন বন্দিজীবন কাটে, কল্পনাতেও আসত না এখানে না এলে। নাম তো দেওয়া যাবে না, ছবিও না। এঁরা এখন আক্ষরিক অর্থেই দলিত। অস্পৃশ্য।
কোনও নেতা এসেছিলেন ভোটের প্রচারে? প্রশ্ন শুনে মাথা নাড়েন তিনজনই। এই গ্রামেই কোনও পার্টির নেতা আসেনি। জানতে চাই, ভোট দিতে যাবেন? ভোট দিতে তো যেতে হবে জওয়ানদের পাহারায়। এ বাড়িতে ছয়জন ভোটার। কারা পাবে ভোট? বড় ছেলেটি সটান বলেন, ‘আর যেই পাক, বিজেপি পাবে না।’ তাঁর সমস্যা আরও তীব্র। কিশোরী মেয়েকে বাইরে আত্মীয়ের বাড়িতে রেখে পড়াতে হচ্ছে। এ গ্রামে থাকলে পড়াশোনা হবে না।
হাথরস নিয়ে বাংলায় হইচই করা প্রচুর নেতা-কর্মীরা জানেন না, গণধর্ষিতার বাবা কুড়ি বছর কাটিয়েছেন বাংলায়। বার্নপুরে ইস্পাত কারখানায় কাজ করতেন। বড়দা ওখানে পড়েছেন হায়ার সেকেন্ডারি পর্যন্ত। মনের ওই অবস্থার মধ্যেও বাংলা থেকে আসা সাংবাদিকের কাছে বাবা ঝালিয়ে নেন আসানসোলের কাছের রেলস্টেশনগুলোর নাম। অনেক গল্প করেন বার্নপুরের। কথা বলতে থাকেন ভাঙা বাংলায়। আবেগে বুজে আসে গলা, যখন বলেন, ‘ওখানে বেশ ভালো ছিলাম।’
তাঁর কথা বলার লোক বলতে এখন শুধু জওয়ানরা। তাঁদের সামনেই মন্তব্য করতে শোনা গেল, ‘আমাদের সঙ্গে যা হল, তারপর আর কেউ এমন ঘটনা হলে প্রতিবাদ করবে না। সেটাই হয়তো সরকার বোঝাতে চাইছে।’
উঠোনে বসে বাবা ও দুই ছেলে দেখাচ্ছিলেন, দু’পাশের দুটো বাড়িতে থাকে চারজন অভিযুক্ত। একজন বাদে বাকিরা মুক্ত। কতদূর আর বাড়ি? উচ্চবর্ণের ছেলেগুলো বাড়ি ফিরে হুমকি দিচ্ছে। কার্যত গোটা গ্রাম তাদের দিকে।
ফিরে আসব। ধর্ষিতার বাড়ির গেটে বিহারের এক জওয়ান যা বললেন, চিরদিন মনে থাকবে। কাশ্মীরের যুদ্ধক্ষেত্র থেকে তিনি এখন এখানে। চার বছর ধরে হাথরসের এই অখ্যাত গ্রামের আজব ডিউটিতে। স্বগতোক্তির ঢঙে শোনালেন, ‘এত ছোট একটা গ্রাম। এত অল্প ক’জন মানুষ। তাদের সমস্যা মেটাতে পুলিশ পাহারা দিলে তাও কথা ছিল। সিআরপিএফ লাগছে। তা হলে সব রাজ্য, দেশের কী দুর্দশা ভাবা যায় না।’
বাড়ির সামনে গীতা পাঠের আসর শেষ তখন। লোক নেই, মাইকের আওয়াজ নেই। স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি, যজ্ঞকুণ্ডের আলো সামান্য রয়ে গিয়েছে। নির্যাতিতা হতভাগিনীর গ্রাম বুলগরহিকে কে আলো দেখাবে?
ময়নাগুড়ি: দেখতে দেখতে তিন মাসের বেশি সময় হয়ে গেল। রামশাই (Ramsai) মেদলা ক্যাম্পের জঙ্গলে সেভাবে…
কার্তিক দাস, খড়িবাড়ি: মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় (CM Mamata Banerjee) ভার্চুয়ালি উদ্বোধন করেছিলেন অধিকারীর বারাসতভিটার সুস্বাস্থ্যকেন্দ্র…
সানি সরকার, গজলডোবা: প্রাক বর্ষায় চারদিক সবুজময়। কিন্তু মাটির নীচের ‘চেনা সোনা’ উধাও। গত কয়েকমাসের…
ফালাকাটা: হাতির হামলায়(Elephant Attack) ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হল ফালাকাটার(Falakata) বংশীধরপুর, রাইচেঙ্গা ও কালীপুর গ্রামে। শনিবার রাতে…
বালুরঘাট: বর্তমানে নীলগাই বিপন্ন প্রজাতিতে পরিণত হয়েছে। অনেকে এই নীলগাই দেখে বাছুর ও হরিণের মিশ্রণ…
দেবাশিস দাশগুপ্ত গত ৭ মে নিজের মুর্শিদাবাদ কেন্দ্রে বিভিন্ন বুথে ঘুরে ঘুরে ভূত তাড়িয়েছেন।…
This website uses cookies.