কোচবিহার: কারও বাবা নেই। কারও মা লোকজনের বাড়িতে কাজ করেন। পেটের টানে কারও মা আবার মিড-ডে মিলের রান্নার সহযোগী হিসেবে কাজ করেন। ফলে মেয়েকে ভালোভাবে মানুষ করবেন সেই ক্ষমতা তাদের নেই। আর যে কারণে ইচ্ছা না থাকলেও কষ্টকে বুকে চাপা রেখে ছোট থাকতেই বাড়ির লোকজন তাদের রেখে গিয়েছেন নিরাশ্রয় নারী ও শিশু সেবাভবনে। কোচবিহার শহরের চাকির মোড় লাগোয়া গুড়িয়াহাটি-২ গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকার এই মেয়েদের হোমের ৫ আবাসিক এবার উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় সাফল্য পেয়েছে।
তারা হল জয়িতা বর্মন, পিউলি কার্জি, কমলিকা বর্মন, প্রতিমা বর্মন ও সোহিনী দে। বুধবার পরীক্ষার ফলাফল বের হলে দেখা যায় এই পাঁচজন পরীক্ষার্থীই উচ্চমাধ্যমিকে প্রথম বিভাগে পাশ করেছে। এর মধ্যে জয়িতা ৪১৫, পিউলি ৩৭৫, কমলিকা ৩৭৩, প্রতিমা ৩৪৩ ও সোহিনী ৩১১ নম্বর পেয়েছে। তাদের কৃতিত্বে হোমের অন্দরে খুশির হাওয়া ছড়িয়ে পড়েছে।
তাদের হোমে রেখে যাওয়ার পেছনে অভাবী বাবা-মায়েদের মূল উদ্দেশ্য ছিল, লেখাপড়া যেমনই হোক, মেয়ে পেট ভরে দু’বেলা খাবার তো খেতে পারবে। আর এভাবেই গত ৮-১০ বছর ধরে হোমে রয়েছে জয়িতারা। চলতি বছরে নিরাশ্রয় নারী ও শিশু সেবাভবন থেকে এই পাঁচজন আবাসিকই উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়েছে।
কোচবিহারের দিনহাটার পখিহাগা গ্রামের বাসিন্দা জয়িতা বর্মনের বাবা মারা গিয়েছে ১০ বছর আগে। মা পরিচারিকার কাজ করেন। বাড়িতে ভাই আছে। ছোট থেকেই জয়িতার ঠাঁই হয়েছে হোমে। জয়িতা আগামীদিনে নার্সিং ট্রেনিং নিতে চায়। সেই ইচ্ছা পূরণ না হলে কলেজে পড়বে।
কমলিকা কোচবিহারের পসারিহাটের বাসিন্দা। বাড়িতে তার বাবা-মা ও ভাই রয়েছে। তবে বাড়ির আর্থিক অবস্থা খুবই খারাপ। মা মিড-ডে মিলের সহযোগী হিসেবে কাজ করেন। ৯ বছর ধরে সে হোমে রয়েছে। কমলিকা বলে, ‘লেখাপড়ার কোনও বাঁধাধরা নিয়ম ছিল না। যখন ইচ্ছা হত পড়তাম।’ সে-ও আগামীদিনে নার্সিং ট্রেনিং করতে চায়। আর তা না হলে ভূগোল নিয়ে পড়তে চায়।
প্রতিমার বাড়ি কলাকাটা এলাকায়। বাবা মনোরোগী। মা মেয়েকে নিয়ে শহরে চলে এসেছিলেন। মেয়েকে হোমে রাখেন। মা নিজে শহরে এক মহিলাকে দেখাশোনার কাজ করেন। রানিবাগান এলাকায় কোনওভাবে মাথা গুঁজে থাকেন। উচ্চমাধ্যমিকে মেয়ের সাফল্যের কথা জানতে পেয়ে মা খুশিতে আত্মহারা হয়ে উঠেছেন। প্রতিমার স্বপ্ন ছিল শিক্ষিকা হওয়ার। কিন্তু বর্তমানে শিক্ষক-শিক্ষিকাদের চাকরি যেভাবে চলে যাচ্ছে, তাতে এখন আর ভরসা পাচ্ছে না। হোমে লেখাপড়ার পাশাপাশি প্রতিমা গান শিখেছে। হাতের কাজ হিসেবে ব্যাগ তৈরি করাও শিখেছে।
হোমের আবাসিকই উচ্চমাধ্যমিকে প্রথম বিভাগে পাশ করায় খুশি কর্তৃপক্ষ। হোম পরিচালন সমিতির সম্পাদক অলক রায় বলেন, ‘উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় আমাদের পাঁচজন মেয়েই প্রথম বিভাগে পাশ করেছে। এতে আমরা খুবই খুশি।’ হোমের ম্যানেজিং কমিটির অন্যতম সদস্য সঞ্জয় সরকারও আবাসিকদের এমন ফলাফলে গর্বিত।