অমিতকুমার রায়, হলদিবাড়ি : কয়েক বছর আগেও ছিল না নাগরিকত্বের পরিচয়। আর তাই ভারত বা বাংলাদেশের কোনও হাসপাতালেই ক্যানসার আক্রান্ত বাবার চিকিৎসা করাতে পারেনি। চোখের সামনে রোগ-যন্ত্রণায় কাতরাতে কাতরাতে প্রিয় বাবাকে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়তে দেখেছিল কিশোর। তখনই মনে জেদ চাপে পড়াশোনা শিখে ভবিষ্যতে ‘বড় ডাক্তার’ হবে।
আট বছর আগে ছিটমহল বিনিময় চুক্তি কার্যকর হওয়ার পর দেশের নাগরিকত্ব লাভ করে বিশেষভাবে সক্ষম ওই কিশোর। মূল ভূখণ্ডে এসে দেশের স্কুল থেকে উচ্চমাধ্যমিক পাশ করে। কিন্তু ডাক্তারি পড়ার সুযোগ কখনই ভোলেনি সে। অবশেষে সর্বভারতীয় নিটে বসে ডাক্তারি পড়ার সুযোগ পেয়েছেন সেদিনের সেই কিশোর উত্তর বড় হলদিবাড়ির তেঁতুলতলার স্থায়ী শিবিরের বাসিন্দা কুপন রায়। স্বভাবতই এখন উচ্ছ্বাস সাবেক ছিটের বাসিন্দাদের। কারণ ছিটমহলের বাসিন্দাদের মধ্যে এই প্রথম কেউ ডাক্তারি পড়ার সুযোগ পাচ্ছেন।
বাংলাদেশের অভ্যন্তরে অবস্থিত ২ নম্বর কোটভাজনী ছিটের বাসিন্দা ছিলেন কুপন। ছিটে থাকাকালীন বাংলাদেশের দেবীগঞ্জ থানা এলাকার গাজোকাটি উচ্চতর বিদ্যালয়ে পঞ্চম শ্রেণিতে পড়াকালীন তার বাবা নেন্দ রায় ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। কুপন বলছেন, ‘ছিটমহলের বাসিন্দা হওয়ায় কোনও নাগরিকত্ব ছিল না। তাই ভারত বা বাংলাদেশের কোনও হাসপাতালেই বাবার চিকিৎসা হয়নি। এক বছর পর কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের যৌথ উদ্যোগে ২০১৫ সালের ৩১ জুলাই গভীর রাত থেকে ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে ছিটমহল বিনিময় চুক্তি কার্যকর করা হয়। কাঁটাতার পেরিয়ে এক দিদি, ভাই ও মাকে সঙ্গে নিয়ে হলদিবাড়িতে অস্থায়ী শিবিরে চলে আসি। তারপরেই নাগরিকত্বের পাশাপাশি দেশে স্কুলে পড়ার সুযোগ লাভ করি।’
জন্মগত বিশেষভাবে সক্ষম কুপন। তাঁর দুই পায়ের অস্থি সংক্রান্ত সমস্যা রয়েছে। এপারে এসে নিজের লক্ষ্যপূরণে ষষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি হয়ে হলদিবাড়ি হাইস্কুল থেকে উচ্চমাধ্যমিক পাশ করেন তিনি। নতুন দেশে এসে কোনও পরিচিতি না থাকায় শুধুমাত্র নিজের ইচ্ছাশক্তি, অধ্যবসায় ও মানসিক দৃঢ়তা দিয়ে কোনও কোচিং ছাড়া একাই পড়াশোনা করে পরপর দু’বার সর্বভারতীয় নিটে সাফল্য লাভ করেন। কুপন জানাচ্ছেন, অজ্ঞতা ও শারীরিক অসুস্থতার কারণে গত বছর সময়মতো কাউন্সেলিংয়ে হাজির হতে পারেননি। কলেজ নির্বাচন না হওয়ায় ভর্তি হওয়ার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হতে হয়। এবছর নতুন উদ্যমে প্রস্তুতি নিয়ে গতবারের তুলনায় ভালো র্যাংক করেন তিনি।
এবছর নিটের ফল প্রকাশ হতেই দেখা যায়, কুপন সর্বভারতীয় প্রতিবন্ধী কোটায় ১৫৪৬ র্যাংক করেছেন। এইমস, এসএসকেএম, এনআরএস, আরজি কর-এর মতো মেডিকেল কলেজেও পড়াশোনার সুযোগ পান। কিন্তু অসুস্থ মাকে ছেড়ে দূরের কলেজে ভর্তি হতে নারাজ কুপন। তাই সিদ্ধান্ত নেন উত্তরবঙ্গ মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালেই পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়ার।
কুপনের মা সরবলা রায় বলছেন, ‘ছেলের পড়াশোনার জন্য জামালদহের একটি সংস্থা সাহায্য করছে। গত বছর কুপনের ভর্তির জন্য ওই সংস্থার তরফে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এমনকি কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য দপ্তরে তদ্বির করা হয়েছিল।’ চার মেয়ে ও দুই ছেলেকে নিয়ে সংসার সরলাদেবীর। বাংলাদেশে তিন মেয়ের বিয়ে হয়েছে। স্বামীর মৃত্যুর পর এক মেয়ে ও দুই ছেলেকে নিয়ে হলদিবাড়িতে আসেন তিনি। দিনমজুরি করে সংসার চালাতে গিয়ে কুপনের পড়াশোনার খরচ ও পুষ্টিকর খাবারের জোগান দিতে না পারায় আক্ষেপ ঝরে পড়ে তাঁর গলায়।
হলদিবাড়ি উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক দীপক দত্তর কথায়, ‘কুপন হলদিবাড়ির গর্ব। নিজের মেধা ও অধ্যবসায়ে ও এত দূর এগিয়েছে। আগামী মাসের ৮ তারিখ উত্তরবঙ্গ মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে ওর ভর্তি হওয়ার কথা।’ কুপনের চোখে এখন ভবিষ্যতের স্বপ্ন। সমাজ গড়ার স্বপ্ন। বলছেন, ‘একজন ভালো ডাক্তার হয়ে সমাজের দরিদ্র মানুষের চিকিত্সা করতে চাই। আমার মতো যেন কোনও শিশুকে বিনা চিকিৎসায় চোখের সামনে বাবাকে মরতে দেখতে না হয়।’ এখন সেই স্বপ্নেই বুঁদ তিনি।