- অনিন্দিতা গুপ্ত রায়
এ বছর ৮ মার্চ ক্যালেন্ডারে শিবরাত্রি। একটা তুলনামূলক আলোচনা করাই যেত, মেয়েদের কাছে কোনটির গুরুত্ব বেশি, কেন শিবপুজোর মতো শক্তি আরাধনা বিশেষভাবে মেয়েদের পুজো এবং সুযোগ্য বর প্রাপ্তির একটি পথ হিসেবে নির্ধারিত হয়ে গেল ইত্যাদি নিয়ে। নিছক তরল পদার্থের মতো ‘পাত্রস্থ’ হয়ে নিজের পরিচিতি খুঁজে পেতে চাওয়াই জীবনের একমাত্র মোক্ষ, এ কথার প্রচার টিভি সিরিয়াল থেকে সামাজিক মাধ্যমে কিছু তো কম নয়। আর শিবরাত্রির মতো আচারকে কেন্দ্র করে এই বিষয়টিকে আরও গুরুত্ব দেওয়ার প্রাধান্যও চলে আসছে।
নারী দিবসে দাঁড়িয়ে আমরা কি সত্যিই পারি না অন্তত কয়েকটি মেয়েকে এই দিনটির তাৎপর্য বোঝাতে, যাঁরা অধিকাংশই জানেন না নারী দিবস কী ও কেন! ইতিহাসটুকু জানা তো জরুরি। ব্যক্তিগতভাবে একটি মেয়ে-স্কুলে পড়ানোর সুবাদে এটুকু দেখি যে, মেয়েরা অনেকটা সাহস নানা বিষয়ে এতদিনে অর্জন করতে পেরেছে, যাকে সমাজ কখনো-কখনো স্পর্ধা বলেও দাগিয়ে দেয়। ভবিষ্যতে কী করতে চাও, জানতে চাইলে প্রায় প্রত্যেকেই বলে নিজের পায়ে দাঁড়াতে চায়। আবার মধ্যবিত্ত সমাজে প্রায় কেউই ভাবতে পারে না সংসারে নারী উপার্জন করবে আর পুরুষ ঘর সামলাবে, এমন সম্ভাবনা।
এই একই সমাজে কিন্তু তথাকথিত নিম্নবিত্ত ঘরে আকছার দেখা যায় মহিলাটি উদয়াস্ত পরিশ্রম করছে, পুরুষটি আলসেমি আর নেশা করে দিন কাটাচ্ছে। মেয়েরাই সাইকেল চালিয়ে পিঠে বাচ্চা বেঁধে বাড়ি বাড়ি কাজ বা অন্য শ্রম দিয়ে বর-বাচ্চা প্রতিপালনও করছে। তবে ঘরে ঘরে পুরুষ, নারীর ভাগের কাজের সমীকরণ কিছুটা সদর্থকভাবে পালটেছে, তাইই হয়তো মেয়েদের নিজেকে প্রকাশের জায়গাটিও চোখে পড়ছে।
আমি নারী তাই আমি সব পারি, এই ধরনের বিজ্ঞাপনী স্লোগান আদৌ এখন পছন্দ নয় মেয়েদের। বরং সময় পরিস্থিতি তাদের এ কথা বলতে শেখাচ্ছে নারী হলে সব পারার দায়বদ্ধতা নিয়ে আমি জন্মাইনি বা সে আশা তোমরা আমার কাছে েকারো না। কারণ সে আবার স্তুতির ছলে অন্যরকম শোষণেরই পন্থা। নারী মাতৃত্বের কাছে বড় নিরুপায়। তাই মাতৃত্বের দাবিতেই তাঁদের ন্যায্য প্রাপ্য সামান্যতম সুবিধা নিয়েও বক্রোক্তি হজম করে হয় কাজ চালাও, নয় ছেড়ে দাও-এটাই নিয়ম। কিন্তু নিজের মতো করে কাজের জায়গা খুঁজে নিজের কণ্ঠস্বর প্রতিষ্ঠা করতে মেয়েরা মোটেই কোনও কাজকে ছোট বলে মনে করে না। তাই ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের বড় ডিগ্রি নিয়েও চাকরি ছাড়তে বাধ্য হওয়া মেয়ে টেক্সটাইলের জ্ঞান কাজে লাগিয়ে পোশাকের বিপণনে সংকুচিত হয় না।
ইউনিভার্সিটির তুখোড় ছাত্রীটি কর্পোরেট স্বামীর সংসারে নিজেকে নিঃশেষ করে মাঝবয়সেও সিদ্ধান্ত নেয় ক্যাফে, বুটিক বা পার্লার করে হলেও নিজের ‘আইডেন্টিটি’ তৈরির। নিছক অমুকের বৌ বা তমুকের মা হয়ে বাঁচতে বাঁচতে ক্লান্ত মেয়ে আবার খুঁজে বের করে হারিয়ে যাওয়া গানের খাতা। আর যে ঘরের কাজ মূল্যহীন বলে এতদিন দাগিয়ে দেওয়া হত, সেই প্রতিদিনের ঘরকন্না রান্নাবাড়ির কাজের সাদামাঠা বিবরণের ভ্লগ বানিয়েই দেশে বা প্রবাসে বসে উপার্জন করে সেই মেয়েরা দেখিয়ে দিয়েছে পারিশ্রমিক না মিললেও তা সাধারণ কাজ আদৌ নয়। মেয়েরা জানে, এবার সময় নিজেই আধার হয়ে ওঠার, তবেই আঁধার কাটবে।
(লেখক জলপাইগুড়ির শিক্ষক, সাহিত্যিক)