Wednesday, July 3, 2024
Homeউত্তর সম্পাদকীয়বাংলায় কাল্পনিক ইন্ডিয়া জোট হলে...

বাংলায় কাল্পনিক ইন্ডিয়া জোট হলে…

সব প্রতিবেশী রাজ্য বাংলাকে ঘিরেছে গেরুয়া দিয়ে। তবে ভোটে সবচেয়ে লাভ মমতার হলে সবচেয়ে ক্ষতি শুভেন্দুর।

  • শুভাশিস মৈত্র

লোকসভা ভোটের ফল প্রকাশ হতে দেখা গেল, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি যিনি নিজেকে প্রকাশ্যেই ঈশ্বর প্রেরিত দূত দাবি করেন, ঘোষণা করেন তাঁর জন্মদাত্রী তাঁর মা নন, ঈশ্বর; ঈশ্বরই তাঁকে বিশেষ অ্যাসাইনমেন্ট দিয়ে এই নশ্বর পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন- তাঁরও ভোট বারাণসীতে ২০১৯-এর থেকে প্রায় দশ শতাংশ কমে গিয়েছে। ঈশ্বর প্রেরিত দূতেরও যে ভোট কমে, তা এই প্রথম ভারতীয়রা জানতে পারলেন। এটা এবারের ভোটে এক নতুন শিক্ষা।

এবার একটু আমাদের পশ্চিমবঙ্গের ভোটের ফলের দিকে তাকানো যাক। সব বুথফেরত সমীক্ষা ভুল প্রমাণ করে দেখা গেল, বিজেপির ভোট এবং আসন দুই-ই ২০১৯-এর তুলনায় কমেছে বাংলায়। মোদি মন্ত্রীসভার দুজন বর্তমান এবং দুই প্রাক্তন মন্ত্রী এবারে প্রার্থী হয়ে পরাজিত। মহুয়া মৈত্র, যাঁকে বধ করার জন্য গোটা হিন্দুত্ববাদী সিস্টেম এক জোট হয়েছিল, বাংলার জনতা সেই মহুয়াকে তাঁর সম্মান ফিরিয়ে দিয়েছেন। এটা খুব উজ্জ্বল এক দৃষ্টান্ত হিসেবে নির্বাচনি ইতিহাসে থেকে যাবে।

রাজ্যের তৃতীয় এবং চতুর্থ রাজনৈতিক দল, কংগ্রেস এবং সিপিএম-এর দুই সর্বোচ্চ নেতা, অধীর চৌধুরী এবং মহম্মদ সেলিম, মুর্শিদাবাদ জেলার পাশাপাশি দুটি লোকসভা কেন্দ্র থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে একযোগে পরাজিত। যাদবপুর, শ্রীরামপুরে, ডায়মন্ড হারবার সহ বেশ কয়েকটি কেন্দ্রে কয়েকজন উজ্জ্বল কম বয়সিকে প্রার্থী করেও সিপিএম ব্যর্থ হল শূন্যতার অপমানের বদলা নিতে! সোশ্যাল মিডিয়ায় বামপন্থীদের ভয়ংকর সব পোস্ট দেখা যাচ্ছে, এই রাজ্যের নির্বোধ জনগণ নাকি টাকার লোভে টিএমসিকে ভোট দিয়ে চলেছে!

তৃণমূল কংগ্রেসের একদল মন্ত্রী ও নেতা, চুরি, ঘুষ, চাকরি বিক্রির অভিযোগে জেলে। রাজ্যে চাকরিবাকরি প্রায় নেই বললেই চলে। সরকারের বিরুদ্ধে কত যে মামলা আদালতে রয়েছে আর কত যে মামলা হাতে নিয়ে তদন্তের নামে হন্তদন্ত ছোটাছুটিতে ব্যস্ত সিবিআই, তার হিসেব এখন আর কারও কাছে নেই।  তা সত্ত্বেও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দলের ভোট, আসন ক্রমাগত বেড়েই চলেছে, এবারের ভোটও তার পাথুরে প্রমাণ। পারিবারিক সূত্রে রাজনীতিতে আসা অভিষেকের ডায়মন্ড হারবারে জয়ের বেলুন আর ঢাকের বাদ্যি শুনে একদা আরামবাগের সিপিএম নেতা অনিল বসুর ‘চমকপ্রদ’ ফলের কথা মনে করিয়ে দিল।  ওদিকে অবশেষে নবীনের বার্ধক্যের সুযোগ নিয়ে ওডিশায় ক্ষমতায় এসেছে বিজেপি। বিহার, অসম তো আগেই গেরুয়া। বাংলাকে ঘিরে ফেলা হচ্ছে। মমতা সাবধান না হলে ২০২৬-এ বিপদ বাড়তে পারে।

এখানে একটা কথা তর্কের খাতিরে বলে রাখা ভালো। রাজ্যে ‘ইন্ডিয়া জোট’ হলে মমতা কংগ্রেসকে দুটি আসন দিতেন। রাজি না হওয়ায় অধীরকে হারতে হল। এখন অর্থহীন বলা, তবু যে আলোচনাটা হলে ভালো হয়, সেটা হল, যদি উদ্দেশ্য হয় বিজেপিকেই হারানো, আইএসএফকে নিয়ে টিএমসি, কংগ্রেস, সিপিএমের একটা কাল্পনিক ইন্ডিয়া জোট করে বিভিন্ন আসনে তাদের প্রাপ্ত ভোট যোগ করে একবার দেখুন তো, বিজেপির আসন কোথায় গিয়ে দাঁড়ায়!

বিজেপি দীর্ঘ সময় ধরে তাদের দলের একটা ছবি তৈরি করেছিল; এই দলটা অন্য দলের থেকে আলাদা, পার্টি উইথ ডিফারেন্স। নরেন্দ্র মোদির দশ বছর সময়কালে দুর্নীতিপরায়ণ নেতাদের দলে এনে ভোট করা, সাংসদ কেনাবেচা, রাজ্যে রাজ্যে সরকার ফেলে ক্ষমতায় টিকে থাকার নিম্নমানের রাজনীতি, অসাংবিধানিক ইলেক্টোরাল বন্ড বাঁচাতে মরিয়া চেষ্টা- সব মিলিয়ে বিজেপির ব্র্যান্ড ভ্যালুতেই কুড়ুলের আঘাত হেনেছেন মোদি। এর মূল্য বিজেপি দিতে শুরু করেছে।  এটাকে পুনর্নির্মাণ করতে বহু সময় লাগবে।

প্রধানমন্ত্রী ভেবেছিলেন হিন্দু মহিলাদের মঙ্গলসূত্র মুসলমানরা নিয়ে ছুট লাগাবে, এই জাতীয় কথা দিয়েই এবারের ‘৪০০ পার’-এর লক্ষ্য ছুঁয়ে ফেলবেন। কিন্তু হল না। খুব বড় ধাক্কা খেয়েছে মোদির উচ্চাকাঙ্ক্ষা। দল ভাঙানোর দক্ষতার যে রাজনীতি মোদি-শা করেছেন গত দশ বছর ধরে তা এবারে মহারাষ্ট্রে দেখা গেল মুখ থুবড়ে পড়ল।

প্রাথমিকভাবে পাওয়া তথ্য বলছে, এবারের লোকসভা ভোটে বিজেপি প্রার্থীদের মধ্যে দলবদলিয়াদের পরাজয় তুলনায় বেশি হয়েছে। বিজেপি নেতারা এতদিন বলে এসেছেন তাঁদের ক্ষেত্রে নাকি অ্যান্টি-ইনকামবেন্সি হয় না। তাঁরা সব সময় প্রো-ইনকামবেন্সির সুফল ভোগ করেন। এবারের ভোটের ফল এই ভাবনাকে সাত হাত মাটির তলায় পুঁতে দিয়েছে। ঘটনা হল,  তিনটি টার্মের পর ১৯৬২-র লোকসভা ভোটে জওহরলাল নেহরুর নেতৃত্বে কংগ্রেসের আসনও দশটি কমে গিয়েছিল। জওহরলালের পাশে আজকের অনেক নেতাই তো চড়াই পাখি!

যদি ফের রাজ্যের কথায় আসা যায়, তাহলে যে কথাটা বলার, তা হল এই ভোটের ফল মমতাকে বিরোধী রাজনীতির মাঠে আগের থেকে বেশি গুরুত্বপূর্ণ করে তুলেছে। যদিও কর্মসূত্রে বিভিন্ন রাজ্যে গিয়ে একটা জিনিস চোখে পড়েছে, ২০১১-’১২ সালে সারা দেশে মমতার যে বিশ্বাসযোগ্যতা ছিল বর্তমানে তার সিকিভাগও নেই। ভারতের বিভিন্ন রাজ্যের মানুষের কাছে পশ্চিমবঙ্গের পরিচয় এখন একটি উচ্ছৃঙ্খল রাজ্য, যেখানে রাজনৈতিক হিংসা প্রতিদিনের ব্যাপার।

এবারে রাজ্যের ভোটে যদি সব থেকে উঁচু আসনটি পেয়ে থাকেন মমতা, তাহলে সব থেকে নড়বড়ে আসনটি পেয়েছেন শুভেন্দু অধিকারী। তিনি দল বদলে বিজেপিতে এসে দলের শীর্ষনেতাদের বিশ্বাস অর্জন করে সুকান্ত-দিলীপদের মাথার উপর দিয়ে বিজেপিকে পরিচালনা করছিলেন। বিজেপির শীর্ষ নেতৃত্বের কাছে তিনি হয়ে উঠেছিলেন পলিটিকাল পি সি সরকার, যিনি পকেটে হাত ঢোকালেই নাকি আসন বেরিয়ে আসবে! ২০২১ এবং ২০২৪-এর পর প্রমাণ হল, এই গল্পটায় জং ধরে গিয়েছে।

কোনও সন্দেহ নেই সন্দেশখালিতে গরিব মানুষের জমি কেড়ে নেওয়া, কাজ করিয়ে পয়সা না দেওয়া, জমি দখল করে ভেরি তৈরি করার মতো কাজ দীর্ঘদিন ধরে করে গিয়েছে তৃণমূল কংগ্রেসের সশস্ত্র মাতব্বরেরা। কিন্তু বিজেপির তোলা মুসলিম তৃণমূল নেতাদের হাতে হিন্দু মহিলাদের যৌন নির্যাতনের অভিযোগ যে জল মেশানো, তা স্টিং অপারেশনে স্পষ্ট হয়েছে।  সেখানে, অর্থাৎ বসিরহাট আসনে বিজেপি প্রার্থী দেখা যাচ্ছে হেরেছেন প্রায় ৩ লক্ষ ৩৩ হাজার ভোটে আর সিপিএমের নিরাপদ হালদারের জামানত জব্দ হয়েছে।

বাংলার রাজনীতি এক ধরনের শূন্যতার শিকার। আজ থেকে ৫৬-৫৭ বছর আগে কিছু নেতার পাল্লায় পড়ে বহু সম্ভাবনাময় মেধাবী বাঙালি ছাত্র-ছাত্রী বিপ্লব হবেন এই আশায় পথে নেমে হারিয়ে গিয়েছিলেন। তাঁরা বেঁচে থাকলে তাঁদের একটা বড় অংশ হয়তো সক্রিয় রাজনীতিতে যোগ দিতেন। আজ আর মেধাবী বাঙালি ছেলেমেয়েরা মেইনস্ট্রিম রাজনীতিতে তেমন আসছেন না। আসছেন না কারণ সামনে এমন কোনও মুখ নেই, যাঁকে দেখে আকর্ষণ বোধ করবেন। এই শূন্যতার মূল্য খুব খারাপভাবে দিতে হচ্ছে বাঙালিকে এবং তা আরও বহুকাল দিয়ে যেতে হবে।

এবং সব শেষে বলার, সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে এবারের এই লোকসভা ভোটের আরেকটি শিক্ষা, ‘নরেন্দ্র মোদি অপরাজেয়’, এই ‘মিথ’ খানখান হয়ে যাওয়া।

(লেখক সাংবাদিক)

Uttarbanga Sambad
Uttarbanga Sambadhttps://uttarbangasambad.com/
Uttarbanga Sambad was started on 19 May 1980 in a small letterpress in Siliguri. Due to its huge popularity, in 1981 web offset press was installed. Computerized typesetting was introduced in the year 1985.
RELATED ARTICLES
- Advertisment -
- Advertisment -spot_img

LATEST POSTS

Gangarampur | খাবারের গুণগত মান যাচাই করতে গঙ্গারামপুরে দোকান-রেস্তোরাঁয় অভিযান খাদ্য সুরক্ষা দপ্তরের

0
গঙ্গারামপুরঃ শহরে বিভিন্ন নামী রেস্তোরাঁ, মিষ্টির দোকান কিংবা বেনামি খাবারের দোকানে বিশেষ অভিযান চালিয়ে চক্ষুচড়কগাছ সরকারি আধিকারিকদের। কোথাও বিষাক্ত রং সহ নিষিদ্ধ কেমিক্যাল ব্যবহার...

Nagrakata | ক্যান্সার আক্রান্ত স্ত্রীকে আনন্দ দিতে সহায় সম্বলহীনদের সঙ্গে ৪০ তম বিবাহবার্ষিকী পালন...

0
নাগরাকাটাঃ ক্যান্সার আক্রান্ত স্ত্রী কে নিয়ে সহায় সম্বলহীনদের সঙ্গে নিজের ৪০ তম বিবাহবার্ষিকী উদযাপন করলেন নাগরাকাটার আংরাভাসা এক নম্বর গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকার সমাজসেবী রাজেন...

Stampede Death | ধর্মপ্রচারের জন্য গোয়েন্দার চাকরি ছাড়েন স্বঘোষিত ধর্মগুরু ভোলেবাবা, সৎসঙ্গে মৃত বেড়ে...

0
উত্তরবঙ্গ সংবাদ ডিজিটাল ডেস্কঃ উত্তরপ্রদেশের হাথরসের সিকান্দরারাউ এলাকায় চলছিল ‘সৎসঙ্গ’। সেই ধর্মীয় অনুষ্ঠানে পদপিষ্ট (Stampede Death) হয়ে মৃত্যু হয়েছে প্রায় ১১৬ জনের। এমনটাই জানিয়েছে...

Chopra Assault case | চোপড়ার বিধায়ক হামিদুলকে ফোন মুখ্যমন্ত্রীর, সালিশি সভা আটকাতে নির্দেশ

0
চোপড়া: চোপড়াকাণ্ডের জেরে বিধায়ক হামিদুল রহমানকে ফোন করলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এদিন হামিদুল নিজে থেকে মুখ্যমন্ত্রীর ফোনের কথা স্বীকার করেছেন। হামিদুল বলেন, 'মুখ্যমন্ত্রী আমাকে...

Chopra | আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে জেসিবি গ্যাঙের ছবি প্রকাশ্যে, এখনও চাপা আতঙ্ক চোপড়ায়

0
চোপড়া: যুগলকে নিগ্রহের ঘটনায় তৃণমূল নেতা তাজমুল ওরফে জেসিবি গ্রেপ্তার হলেও এখনও চাপা আতঙ্ক রয়েছে চোপড়ায়। অভিযোগ, দাপুটে তাজমুল গ্রেপ্তার হলেও তার গ্যাঙের অনেকেই...

Most Popular