- শুভঙ্কর মুখোপাধ্যায়
কলম্বাসের কান্ট্রিতে ক্রিকেট। সে এক আজব তামাশা বটে!
‘ক্রিকেট’ শব্দটা শুনেই এক মার্কিন সাহেব চোখটোখ কুঁচকে বললেন, ‘ব্যাড নেটওয়ার্ক’! সন্দেহ হল, উনি কি তবে আমেরিকার সেলফোন ও ইন্টারনেট প্রভাইডার কোম্পানি ‘ক্রিকেট’-এর কথা বলছেন! আমার সংশয় বুঝতে পেরে সেই সাহেব বললেন, ‘হোয়াট এ জোক! ইউ মিন দি ইনসেক্ট, রাইট’? বোঝো, শেষে কি না ঝিঁঝিপোকা! এরপর অনেক কষ্ট করে সেই সাহেবকে বোঝাতে হল যে, ক্রিকেট খেলা বিশ্বের চারটি মহাদেশে ব্যাপক জনপ্রিয়!
এবার ক্রিকেট খেলাটা কেমন বুঝতে সেই সাহেব কম্পিউটারে ত্রিমাত্রিক গ্র্যাফিকসের একটা সফটওয়্যার খুলে বসছিলেন প্রায়। বুদ্ধি করে বললাম, ক্রিকেট অনেকটা বেসবলের মতো। অবশেষে বিষয়টা সাহেবের ‘কমন’ পড়ল। দুই গাল হাসি ছড়িয়ে উনি বললেন, ‘গট ইট’! আসলে আমেরিকানরা নিজেরা যা করে না, সেটা যে পৃথিবীতে আছে, সেটা তারা বিশ্বাসই করে না। এ হেন মার্কিন মুলুকে কিনা চলছে টোয়েন্টি টোয়েন্টি ক্রিকেটের বিশ্বকাপের আসর!
খবর শুনে সেই ভিরমি খাওয়া সাহেবকে বলেই ফেললাম, আয়োজক দেশের কোটায় আমেরিকাও এবার প্রথম বিশ্বকাপ খেলছে, সঙ্গে কানাডাও। এবার সাহেব ভরসা পেলেন। সুযোগ বুঝে ওঁকে জানিয়ে দিলাম, আমেরিকা কিন্তু পাকিস্তানের মতো ‘রক্তে ক্রিকেট’-এর দলকে হারিয়ে দিয়েছে। এবং মার্কিন ক্রিকেট দলের অধিনায়ক এক ইন্ডিয়ান, অভিবাসী গুজরাটি মায়াঙ্ক প্যাটেল। শুনে সাহেবের মন গলল!
উৎসাহিত হয়ে বললাম, আমেরিকার তিনটি রাজ্যে টি-টোয়েন্টি ক্রিকেট বিশ্বকাপের জন্য স্টেডিয়াম তৈরি হয়েছে। নিউ ইয়র্ক, টেক্সাস এবং ক্যালিফোর্নিয়া। প্রায় পঁয়ত্রিশ হাজার মানুষ খেলা দেখতে পারবেন প্রতিটি স্টেডিয়ামে। নর্থ ক্যারোলিনাতেও একটা স্টেডিয়াম হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু ঘাস কেটে পিচ বানালে তাতে সবুজ ধ্বংস হবে এবং বিঘ্নিত হবে এলাকার মানুষের প্রভাতী ও সান্ধ্য ভ্রমণ। এই অভিযোগের চাপে সেখানে স্টেডিয়াম বানানো বন্ধ হয়ে গিয়েছে।
আইসিসির পাঠানো পাওয়ার পয়েন্ট প্রেজেন্টেশন অনুসরণ করে, মার্কিন ক্রিকেট সংস্থার প্রধান ভারতীয় অভিবাসী পরাগ মারাঠে নিজে সব স্টেডিয়াম তৈরির কাজ তদারকি করেছেন। ১৪ জুন পর্যন্ত, দশদিন ধরে দশটি ম্যাচ হবে আমেরিকায়। তারমধ্যে ভারত খেলবে চারটি ম্যাচ। টিকিটের দাম ভারতীয় মুদ্রায় ৫ হাজার টাকা। রবিবার ভারত-পাক ম্যাচের টিকিটের দাম অবশ্য ২৫ হাজার টাকা। এরমধ্যেই সব টিকিট শেষ।
কিন্তু এ সব নিয়ে এশীয় অভিবাসীরা যতটা উত্তেজিত, তার কণামাত্রও দেখা যায়নি আমেরিকানদের মধ্যে।
এই তো সেদিন পাক-মার্কিন খেলা লাইভ দেখানো হয়েছে ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারের টঙে টাঙানো সিনেমা হলের পর্দার মতো ঢাউস টিভি-তে, পথচলতিদের জন্য। বিজ্ঞাপন ভেবে সেদিকে ফিরেও তাকায়নি কোনও আমেরিকান! জাতীয় স্তরের কোনও মার্কিন মিডিয়ায় কোনও খবর বেরোয়নি টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ ক্রিকেট নিয়ে। অনেক খুঁজে পাওয়া গিয়েছে, নিছকই স্থানীয় সংবাদপত্র ‘নিউ ইয়র্ক পোস্ট’-এর দুইয়ের পাতায় ‘সোনা রুপোর দর’-এর সাইজের একটা সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। আর চাঁদ সদাগরের মনসাপুজোর মতো নিয়মরক্ষার একটা খবর বেরিয়েছে ‘স্পোর্টস উইকলি (ইউএসএ টুডে)’-তে!
তাহলে বেচারা আমেরিকান আমজনতা ক্রিকেটের কী বুঝবে? এই গল্প শুরুর সেই মার্কিন সাহেবকে বোঝাতে চেয়েছিলাম, ক্রিকেট তিন প্রকার। ওয়ান ডে, টি-টোয়েন্টি আর পাঁচদিনব্যাপী টেস্ট! এ সব শুনে ভ্যাবাচ্যাকা খাওয়া সেই সাহেব এন্তার ‘বোকা বোকা’ প্রশ্ন করতে শুরু করলেন। বুঝলাম, আমেরিকানদের কাছে ক্রিকেটটা বোম্বাগড়ের রাজবাড়ির সেই খেলার মতো! ‘কুমড়ো নিয়ে ক্রিকেট খেলে কেন রাজার পিসী’?
(লেখক আমেরিকার ন্যাশভিলের বাসিন্দা। প্রবন্ধকার)