- শৌভিক রায়
উচ্চমাধ্যমিক পাশ করার পর ফালাকাটা থেকে কোচবিহারের কলেজগুলিতে ফর্ম ফিলআপ করতে গিয়েছিলাম। প্রবল বর্ষায় সব রাস্তা বন্ধ। দেড় ঘণ্টার পথ ঘুরপথে পৌঁছাতে লেগেছিল প্রায় অর্ধেক বেলা। তখন হিন্দুস্থান মোড় হয়ে কোচবিহার যাওয়ার একটিই পথ। কিন্তু বৃষ্টিতে সেই রাস্তায় কাঠের ব্রিজ ভেঙেছে। ফলে রাস্তা বন্ধ।
ত্রিশ চল্লিশ বছর আগের সেই বৃষ্টিচিত্র এখন আর নেই। বৃষ্টির পরিমাপ ও তীব্রতা যেমন কমেছে, তেমনি চিরাচরিত কাঠের সেতুও অতীত হয়ে গিয়েছে। বিকল্প পথ বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে, দ্রুতগতির ফোর লেন আজ দূরত্বও অনেকটা কমিয়ে এনেছে।
উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় নৌকাঘাট-মেডিকেল কলেজ হয়ে শিবমন্দির পৌঁছনোর কথা কোনওদিন আমাদের ভাবনাতেও ছিল না। এয়ারভিউ মোড় থেকে কিরণচন্দ্র শ্মশানঘাট দেখতে দেখতে আর পুরোনো মহানন্দা সেতুর যানজটকে মনে মনে গালমন্দ করতে করতে আমরা পৌঁছাতাম ক্যাম্পাসে। দার্জিলিং মোড় পার হলেই তখন সবুজ চাঁদমণি চা বাগান। শিবমন্দির শান্ত ছোট্ট একটি জনপদ।
গজলডোবার কথা ধরা যাক। শিলিগুড়ি থেকে ওই পথে উত্তর-পূর্বে আসব একদিন, ভাবিনি বোধহয় কেউ কখনও। যেমন ভাবা যায়নি সাহুডাঙ্গি-আমবাড়ি-বেলাকোবা হয়ে পাহাড়পুর অবধি রাস্তাটি জাতীয় সড়কের বিকল্প হয়ে উঠতে পারে। মালবাজার-সেবকের মধ্যেও এখন নতুন ফ্লাইওভার গতি বৃদ্ধি করেছে। কমিয়েছে লেভেল ক্রসিংয়ে অনির্দিষ্ট সময় আটকে থাকার যন্ত্রণা। ময়নাগুড়ি রোডের ফ্লাইওভার তার টাটকা প্রমাণ। একের পর এক ফ্লাইওভার এখন উত্তর পথের সঙ্গী। কম বেশি অনিন্দ্যসুন্দর তারা প্রত্যেকেই।
কে কবে ভেবেছিল, ভারী শব্দের বিরাট বিরাট ট্রাকগুলো একদিন ইসলামপুরকে আর বিরক্ত করবে না! দুরন্ত পথ দ্রুত পৌঁছে দেবে কিশনগঞ্জে। বিচ্ছিরি ট্রাফিককে পাশ কাটিয়ে। রায়গঞ্জেও এই একই ছবি। শিলিগুড়ি মোড়ের পর কোন দিক দিয়ে যে পথ মালদার দিকে চলে যায় বোঝাই দায়। তার খানিক আগে ডালখোলা পেরোনোর সময় আজকাল আর মনেই পড়ে না, এখানকার লেভেল ক্রসিং কী মারাত্মক ত্রাস ছিল এই কিছুদিন আগেও!
আজকাল বহু প্রত্যন্ত এলাকাতেও ঝাঁ চকচকে রাস্তা। যোগাযোগ সহজ হয়ে যাওয়ায় শহরের ভিড় থেকে অনেকেই এখন গ্রামমুখী। একটা ছোট্ট বাগানবাড়ি, নির্জনে শান্তিতে দু’দিনের বসবাস। সপ্তাহের শুরুতে চেনা পথে আবার ফিরে এসে জীবনযুদ্ধ!
নতুন পথের দাপটে কত পথ হারিয়ে গেল! ফালাকাটা বীরপাড়া পথে রাস্তার ওপর ঝুঁকে পড়া শতাব্দীপ্রাচীন সেই মহীরুহরা লাশ হয়ে গেল কবে যেন! কোচবিহার বা মালদা থেকে শিলিগুড়ি পথ যা ছিল একসময় সত্যিই ছায়াবীথি, সেগুলি আজ কেমন ন্যাড়া। অস্বীকার করবার উপায় নেই, এই তীব্র গতি আমাদের ‘দিয়েছে বেগ কিন্তু কেড়ে নিয়েছে আবেগ’।
কবির ভাষায় মাঝে মাঝে বলতে ইচ্ছে করে, ‘সেইসব হারানো পথ আমাকে টানে।’ কিন্তু সে ইচ্ছে আদ্যন্ত রোমান্টিক। এই পরিবর্তন অত্যন্ত স্বাভাবিক। শুধু খটকা একটাই। উন্নয়নের এই বিরাট কর্মযজ্ঞে পর্যাবরণের কথা মনে রাখছি তো? ধ্বংস করছি না তো প্রকৃতির সবকিছুকে? গতি আনতে গিয়ে প্রশ্রয় দিচ্ছি না তো অগতিকে? ভাবা দরকার অবশ্যই।
(লেখক কোচবিহারের বাসিন্দা। শিক্ষক)