Saturday, June 29, 2024
Homeউত্তর সম্পাদকীয়গণতন্ত্র চালাচ্ছে মার্কেট রিসার্চ কোম্পানি

গণতন্ত্র চালাচ্ছে মার্কেট রিসার্চ কোম্পানি

 

  • প্রতীক        

অতি সম্প্রতি এক সাক্ষাৎকারে প্রশান্ত কিশোর বলেছেন, ২০২৪ লোকসভা নির্বাচনে কংগ্রেস এমন কিছু উন্নতি করেনি। কারণ দেশের ২০ শতাংশ মানুষ সংখ্যালঘু – ১৮ শতাংশ মুসলমান আর অন্যান্য সংখ্যালঘু আরও ২ শতাংশ। তারা কংগ্রেসের ‘ফ্রি ভোটব্যাংক’, আর কংগ্রেস পেয়েছে ২৩ শতাংশ ভোট। অর্থাৎ সংখ্যালঘু বাদে মাত্র ৩ শতাংশ ভোটারের ভোট আদায় করতে পেরেছে রাহুল গান্ধির দল। এই তত্ত্বের আগাগোড়া সবটাই ভুল তথ্যের উপর দাঁড়িয়ে আছে। যেহেতু তথ্যগুলোই ভুল, সেহেতু তত্ত্বটির একমাত্র ঠিকানা বাজে কাগজের ঝুড়ি।

প্রথমত, কংগ্রেস পেয়েছে ২১.১৯ শতাংশ ভোট (২০১৯ সালে পেয়েছিল ১৯.৪৬ শতাংশ)। দ্বিতীয়ত, সর্বশেষ আদমশুমারি অনুসারে মুসলমানরা এদেশের জনসংখ্যার ১৪.২ শতাংশ। তার সঙ্গে খ্রিস্টান, শিখ, বৌদ্ধ, জৈন, আরও ছোট ছোট ধর্মের মানুষ এবং যাঁরা নিজেদের কোনও ধর্মের সঙ্গে যুক্ত বলেননি তাঁদের যোগ করলে তবে হয় ২০.২ শতাংশ। কিন্তু সংখ্যালঘুরা গোটা দেশে কংগ্রেস ছাড়া কাউকে ভোট দেন না – একথা একেবারে ভুল। পশ্চিমবঙ্গেই যেমন সেই ২০১১ সাল থেকে বেশিরভাগ সংখ্যালঘু মানুষ ভোট দিয়ে আসছেন তৃণমূল কংগ্রেসকে, তার আগে দিতেন বামফ্রন্টকে। তামিলনাডু সহ অনেক রাজ্যেই আঞ্চলিক দলগুলো বেশিরভাগ সংখ্যালঘুর ভোট পেয়ে থাকে। এবারেও পেয়েছে।

সবচেয়ে বড় কথা,  জনসংখ্যার সকলেই ভোটার নাকি? শিশুরাও ভোট দেয়? তার উপর কংগ্রেস এবার লড়েছে ৩২৮ আসনে, কিন্তু ২০১৯ সালে লড়েছিল ৪২৩ আসনে। প্রায় একশো কম আসনে লড়ে কংগ্রেস ভোট বাড়িয়েছে প্রায় ২ শতাংশ। আসন যে প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে তা বলাই বাহুল্য। অতএব এটা ফেলে দেওয়ার মতো সাফল্য নয়।

এখন কথা হল, প্রশান্তের তত্ত্বটি যখন নেহাত আবর্জনা, তখন লেখার শুরুতেই এতগুলো শব্দ তা নিয়ে খরচ করলাম কেন? কারণ প্রশান্তকে যে ভারতীয় রাজনীতির একজন বিশেষজ্ঞ বলে মনে করা হয়, করণ থাপারের হাতে ল্যাজেগোবরে হওয়ার পরেও যে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম তাঁর সাক্ষাৎকার নিতে এখনও উদ্গ্রীব, তার কারণ ভোট কুশলী হিসাবে তাঁর কীর্তি। ২০১৪ সালে নরেন্দ্র মোদি ক্ষমতায় আসার সঙ্গে সঙ্গে সারা দেশে প্রশান্ত বিখ্যাত হয়েছিলেন। সংবাদমাধ্যম জানিয়েছিল, ওই জয়ের কারিগর তিনিই। প্রশান্তের খ্যাতির সূত্রে ভারতীয় রাজনীতিতে প্রতিষ্ঠা পেয়েছিল এক নতুন পেশা, যার নাম ইংরেজিতে ‘ইলেকশন স্ট্র্যাটেজিস্ট’। বাংলায় ভোট কুশলী বলতে পারি।

ভোট কুশলী ব্যাপারটা দেখতে শুনতে এত ভালো যে বঙ্গে দিশেহারা বামপন্থীদের মধ্যেও কথাবার্তা শুরু হয়েছে – একজন প্রশান্ত বা সুনীল কানুগোলু (কংগ্রেসের ভোট কুশলী সংস্থা মাইন্ডশেয়ার অ্যানালিটিক্সের কর্ণধার) দরকার। পশ্চিমবঙ্গ, বিহার, তামিলনাডু, উত্তরপ্রদেশের মতো যথেষ্ট সংখ্যালঘু থাকা রাজ্যে কাজ করা সংস্থার একদা কর্ণধার প্রশান্তের মূর্খামি দেখে সেই বামপন্থীরা কী বুঝবেন জানি না, আমি যা বুঝলাম বলি।

হয় প্রশান্ত এতটাই কংগ্রেসবিদ্বেষী ও মুসলমানবিদ্বেষী যে বিদ্বেষে তাঁর বুদ্ধিসুদ্ধি লোপ পেয়েছে। নয় তাঁর সাফল্যের পিছনে ১০০ শতাংশ কৃতিত্ব আইপ্যাকের সেইসব কর্মীদের, যাঁদের নাম কেউ জানে না। তিনি শুধু মাইনে করা কর্মীদের পরিশ্রম আত্মসাৎ করে নাম কিনেছেন। কিন্তু কর্পোরেট দুনিয়ায় এ তো প্রায় নিয়ম। ফলে তেমন হয়ে থাকলে রাজনীতির দিক থেকে ভাবনার কিছু নেই। তৃতীয় একটা সম্ভাবনা আছে, যা বেশি চিন্তার।

ব্যাপারটা কি আসলে এরকম, যে এই সংস্থাগুলো যা করে তা আসলে বিজ্ঞাপন জগতে যাকে ‘মার্কেট রিসার্চ’ বলে তার বেশি কিছুই নয়? লক্ষণীয়, আইপ্যাক বা মাইন্ডশেয়ার সেইসব মক্কেলকেই জেতাতে পেরেছে যারা জেতার অবস্থায় ছিল। ২০১৪ লোকসভা নির্বাচন বিজেপি জিততই, কারণ ইউপিএ সরকারের প্রতি বিপুল অসন্তোষ তৈরি হয়েছিল। ২০২১ পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা নির্বাচন বিজেপি জিতে যাবে বলে যতই হাওয়া তৈরি হয়ে থাক, বিজেপির না ছিল সংগঠন, না ছিল মমতার সমতুল্য কোনও মুখ।

২০০৫ সালে বিহারের মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পর থেকে নীতীশ কুমারের সরকার যে অনেক কাজ করেছিল তা তাঁর অতি বড় শত্রুও অস্বীকার করে না। ফলে ২০১৫ সালে জেডিইউ-আরজেডি জোটের জয়ও এমন কিছু অত্যাশ্চর্য ব্যাপার ছিল না, খিঁচ ছিল নীতীশ মহাগঠবন্ধনে যোগ দেওয়ায়। তামিলনাডুর মানুষ পরপর দু’বার একই দলকে জেতান না। ১৯৮৪ সাল থেকে চলে আসা সেই ধারা ভেঙে এমনিতেই ২০১৬ সালে এআইএডিএমকে পরপর দু’বার জিতে গিয়েছিল। সুতরাং ২০২১ সালে ডিএমকের জয় প্রায় অনিবার্য ছিল। ২০১৭ সালের উত্তরপ্রদেশ বিধানসভা নির্বাচনে কিন্তু সংগঠনহীন, কর্মসূচিহীন কংগ্রেস আইপ্যাকের সাহায্য নিয়েও সাতটার বেশি আসন জেতেনি। সুনীলও কি কংগ্রেসকে তেলেঙ্গানা জেতাতে পারতেন সংগঠন এবং রেবন্ত রেড্ডির মতো আক্রমণাত্মক নেতা না থাকলে? কর্ণাটক জেতা হত সিদ্দারামাইয়া আর ডিকে শিবকুমার ছাড়া?

অনেকে অবশ্য স্বীকার করেন যে এই সংস্থাগুলো বা তাদের কর্ণধাররা জাদুকর নন। কিন্তু তাঁদের মতে, এরা ‘ভ্যালু অ্যাড করে’। সে ভ্যালু কি পরিমাপযোগ্য? হলে প্রশান্তের মতো মহাপণ্ডিত কি ভ্যালু অ্যাড করেন? যদি পরিমাপযোগ্য না হয়, তাহলে কীসের ভিত্তিতে রাজনৈতিক দলগুলো কোটি কোটি টাকা খরচ করছে এদের পিছনে? দলগুলোর টাকা মানে তো আসলে নাগরিকদেরই টাকা। কর্পোরেটগুলো পিছন দরজা দিয়ে যে চাঁদা দলগুলোকে দেয় (নির্বাচনি বন্ডেই হোক আর নগদেই হোক) সে টাকাও তো তারা উশুল করে নেয় নাগরিকদের পকেট থেকেই। শুধু তাই নয়, এই সংস্থাগুলোর পরামর্শেই তো আজকাল ক্ষমতাসীন দলগুলোর, অর্থাৎ রাষ্ট্রের নীতি নির্ধারণ হচ্ছে। তাহলে কি কতকগুলো মার্কেট রিসার্চ কোম্পানি নির্ধারণ করছে আমাদের গণতন্ত্রের অভিমুখ?

এদের কাজের সীমা কতটুকু? কেউ বলেন, এরাই নাকি দলের প্রার্থীতালিকা থেকে নির্বাচনি প্রচার – সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করে। আবার কিছুদিন আগে মমতা এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, আইপ্যাকের ভূমিকা নেহাতই সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রচার চালানো। এসব গোপনীয় ব্যাপার, ফলে সম্যক জানা অসম্ভব। কিন্তু একটা ব্যাপারে সকলেই একমত। ভোট কুশলী সংস্থার আবশ্যিক কাজ হল মক্কেল পার্টির জন্য ভোটারদের সম্পর্কে পুঙ্খানুপুঙ্খ তথ্য সংগ্রহ এবং বিশ্লেষণ। তথ্য কাটাছেঁড়া করেই তারা দলগুলোকে পরামর্শ দেয় – এটা বলুন, ওটা বলবেন না। অমুক প্রকল্প চালু করুন, তমুক কাজে পার্টির ভাবমূর্তি নষ্ট হচ্ছে।

সন্দেহ নেই, তথ্যপ্রযুক্তির যুগে রাজনীতিতে সাফল্য পেতে গেলে তথ্য আর প্রযুক্তিকে কাজে লাগাতে হবে। সে কারণেই তো আইপ্যাকের প্রস্থানের পর ডিএমকে ভোট কুশলী হিসাবে নিযুক্ত করেছে পপুলাস এমপাওয়ারমেন্ট নেটওয়ার্ক (পেন)-কে। তবে আইপ্যাক বা মাইন্ডশেয়ারের সঙ্গে পেনের তফাত আছে। পেনের কর্ণধার এমকে স্ট্যালিনের জামাই ভি সবরীসন। এখনও পর্যন্ত পেন অন্য কোনও দলের হয়ে কাজ করেনি। তারা মূলত পার্টি এবং ডিএমকে সরকারের বার্তা ডিজিটাল উপায়ে সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়ার কাজ করে। সেই লক্ষ্যে স্ট্যালিনের মোবাইল অ্যাপ বানিয়েছে তারা এবং মুখ্যমন্ত্রীর নিয়মিত পডকাস্ট চালু করেছে। কীভাবে মানুষের কাছ থেকে ডিজিটাল পদ্ধতিতে তথ্য সংগ্রহ করে রাজনৈতিক কাজে লাগানো যায়, তা নিয়ে প্রশিক্ষণও দেয় ডিএমকে কর্মীদের। কিন্তু ডিএমকের রাজনীতি তারাই নিয়ন্ত্রণ করছে, এমন অভিযোগ বা প্রশংসা এখনও অবধি শোনা যায়নি। অথচ তৃণমূল কংগ্রেসের রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত আইপ্যাক নিচ্ছে – এমন অভিযোগ উঠেছে প্রশান্ত ছেড়ে যাওয়ার আগে ও পরে।

আবার মধ্যপ্রদেশ, ছত্তিশগড়, রাজস্থানের নির্বাচনে সুনীল কাজ করুন – এমনটা নাকি সেখানকার কংগ্রেস নেতারা চাননি। তাহলে রাজনৈতিক দলের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে এখন দলের কর্মীদের লড়তে হচ্ছে মার্কেট রিসার্চ কোম্পানির সঙ্গে? গরিব মানুষের গণতন্ত্র ভারতের জন্য এটা কি ভালো লক্ষণ?

(লেখক সাংবাদিক)

Uttarbanga Sambad
Uttarbanga Sambadhttps://uttarbangasambad.com/
Uttarbanga Sambad was started on 19 May 1980 in a small letterpress in Siliguri. Due to its huge popularity, in 1981 web offset press was installed. Computerized typesetting was introduced in the year 1985.
RELATED ARTICLES
- Advertisment -
- Advertisment -spot_img

LATEST POSTS

World record | এক ইনিংসে ৬০৩, প্রোটিয়াদের বিরুদ্ধে মহিলাদের ক্রিকেটে ফের বিশ্বরেকর্ড ভারতের

0
উত্তরবঙ্গ সংবাদ ডিজিটাল ডেস্কঃ মহিলাদের ক্রিকেটে ফের বিশ্বরেকর্ড ভারতের। দক্ষিণ আফ্রিকার বিরুদ্ধে প্রথম টেস্টের প্রথম ইনিংসে ৬০৩ রান করল ভারত। মেয়েদের ক্রিকেটে এটাই টেস্টে...

Bus | সিকিমের বাসে নগদে ‘না’, ভাড়া অনলাইনে

0
সানি সরকার, শিলিগুড়ি: ফের প্রতিবেশী রাজ্যকে টেক্কা দেওয়ার চেষ্টা সিকিমের (Sikkim)। এরাজ্যে সরকারি পরিবহণ ব্যবস্থা নিয়ে যখন বিস্তর প্রশ্ন রয়েছে, তখন বাস (Bus) ভাড়ার...

Chopra | বেহাল নিকাশি ব্যবস্থা, জমা জল ডিঙিয়ে ক্লাসে শিক্ষিকা-ছাত্রীরা

0
চোপড়া: জলকাদা ডিঙিয়ে ক্লাসে ঢুকতে হচ্ছে ছাত্রীদের। কারণ, বেহাল নিকাশি ব্যবস্থা। যার জেরে চলতি বর্ষায় চোপড়া গার্লস হাইস্কুল (Chopra Girls High School) চত্বর জল...

DY Chandrachud | ‘বিচারকরা মানুষের সেবক’ মন্তব্য সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতির

0
উত্তরবঙ্গ সংবাদ ডিজিটাল ডেস্ক: ‘বিচারব্যবস্থা মন্দির হলেও, বিচারকদের দেবতা ভাবা ঠিক নয়’ শনিবার কলকাতায় দাঁড়িয়ে এমনই  মন্তব্য করলেন সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি ডি ওয়াই চন্দ্রচূড়।...

T-20 World Cup | হিটম্যানকে নিয়ে রসিকতা সৌরভের, ফাইনালে হারলে রোহিত বার্বাডোজ মহাসাগরে ঝাঁপ...

0
উত্তরবঙ্গ সংবাদ ডিজিটাল ডেস্কঃ আহমেদাবাদে গত বছর ১৯ নভেম্বর ওয়ানডে বিশ্বকাপের ফাইনালে অস্ট্রেলিয়ার কাছে হেরেছে ভারত। ৭ মাসের ব্যবধানে আজ আরেকটি বিশ্বকাপ ফাইনাল খেলবে...

Most Popular