শুভঙ্কর চক্রবর্তী, শিলিগুড়ি: সিআইডি’র বিশেষ দলের তদন্তে একের পর এক চাঞ্চল্যকর তথ্য। শিলিগুড়িতে তোলাবাজি, বেআইনি জমির কারবারে কোটি কোটি টাকার লেনদেন। নাম জড়াল আরও কয়েকজন তৃণমূল নেতার। পাশাপাশি শিলিগুড়ি-জলপাইগুড়ি উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (এসজেডিএ)-র এক উচ্চপদস্থ আধিকারিক এবং একাধিক বোর্ড সদস্য ও পদাধিকারীর বিরুদ্ধে নানা দুর্নীতির প্রমাণ হাতে এসেছে গোয়েন্দাদের। সিআইডি’র সংকেত পেয়েই বুধবার জমির বেআইনি কারবারের জেরে পুলিশ গৌতম দেবের ঘনিষ্ঠ ফুলবাড়ির তৃণমূল নেতা দেবাশিস প্রামাণিককে গ্রেপ্তার করেছে। শিলিগুড়ি পুরনিগমের দুই কাউন্সিলার, ডাবগ্রাম-ফুলবাড়ি এলাকার আরেক তৃণমূল নেতা এবং এসজেডিএ’র এক প্রাক্তন পদাধিকারী ও এক আধিকারিককে গ্রেপ্তারির প্রস্তুতি শুরু করেছে সিআইডি।
শিলিগুড়ি হংকং মার্কেট ও বিধান মার্কেটে তোলাবাজি এবং বেআইনি নির্মাণের বেশকিছু অভিযোগ জমা পড়েছিল মুখ্যমন্ত্রীর কাছে। সেইসব অভিযোগের তদন্তে নেমে চক্ষু চড়কগাছ সিআইডি’র। দুই মার্কেটে তোলাবাজি ও বেআইনি নির্মাণ বাবদ কোটি কোটি টাকা লেনদেনের হদিস পেয়েছেন গোয়েন্দারা। কয়েকজনকে জিজ্ঞাসাবাদও করেছেন তাঁরা। তাতে উঠে এসেছে দুই মার্কেটে শুধু ছয়টি বেআইনি নির্মাণ থেকেই আড়াই কোটি টাকা তোলা আদায় হয়েছে। গোয়েন্দা সূত্রের খবর, দুই মার্কেটে বেআইনি কারবার নিয়ন্ত্রণ করছেন শিলিগুড়ি পুরনিগমের বড় দায়িত্বে থাকা এক প্রভাবশালী কাউন্সিলার। আর্থিক লেনদেনের বেশকিছু প্রমাণ, কল রেকর্ডিং পেয়েছেন তদন্তকারীরা।
ভক্তিনগর থানা লাগোয়া ইস্টার্ন বাইপাস ও সেবক রোডে তিনটি নির্মীয়মাণ শপিং মল ও দুটি আবাসন নিয়েও তদন্ত শুরু হয়েছে। নিয়ম ভেঙে সেগুলি তৈরি হয়েছে বলেই অভিযোগ। তাতে একাধিক জমি মাফিয়া এবং হংকং মার্কেটে তোলাবাজিতে অভিযুক্ত কাউন্সিলার ছাড়াও আরও এক প্রভাবশালী কাউন্সিলারের টাকা খাটছে বলে গোয়েন্দারা জানতে পেরেছেন। একটি শপিং মলে বিহারের এক ব্যক্তি কয়েক কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছেন। প্রাথমিক তদন্তে জানা গিয়েছে, সেই ব্যক্তি বিহারে একাধিক জমি কেলেঙ্কারিতে যুক্ত। ওই ব্যক্তির সঙ্গে কীভাবে সম্পর্কে গড়ে উঠল শিলিগুড়ির কাউন্সিলারদের তা জানার চেষ্টা করছেন গোয়েন্দারা। কাউন্সিলারদের টাকা বিহারে কোনও ব্যবসায় বিনিয়োগ করা হয়েছে কি না তার খোঁজখবরও শুরু হয়েছে।
অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের নাম করে তোলাবাজির ৩০টিরও বেশি অভিযোগে শিলিগুড়ির বাহুবলী এক অবাঙালি যুব নেতা সম্পর্কে খোঁজখবর শুরু করেছে সিআইডি। ওই নেতার দুই শাগরেদকে জিজ্ঞাসাবাদও করা হয়েছে। সূত্রের খবর, ওই যুব নেতার বিরুদ্ধে বেআইনি কল সেন্টার, সিংগিং বার থেকে লক্ষ লক্ষ টাকা তোলা আদায়ের কিছু প্রমাণ মিলেছে। বেআইনি কারবারে শিলিগুড়ির কয়েকজন সাংবাদিক সম্পর্কেও বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহ করেছেন তদন্তকারীরা। এনজেপি এলাকায় এক সাংবাদিক জমি মাফিয়াদের হয়ে পুলিশ ও নেতাদের মধ্যস্থতাকারী হিসাবে দীর্ঘদিন থেকেই কাজ করছেন। তাঁর একাধিক সম্পত্তির হদিস পেয়েছেন গোয়েন্দারা। কয়েকজন সাংবাদিকের আয়বহির্ভূত প্রচুর সম্পত্তির খোঁজও মিলেছে।
শিলিগুড়িতে এসজেডিএ’র নিয়ন্ত্রণাধীন জমি হাতবদলে সাত কোটি টাকা লেনদেনের তদন্তও শুরু করেছে সিআইডি। হাওলার মাধ্যমে শিলিগুড়ির বাইরে অন্য জেলায় সেই টাকা হাতবদল হয়েছে বলেই অনুমান করা হচ্ছে। এসজেডিএ’র প্রকল্প থেকে দুর্নীতি করে কামানো টাকায় শিলিগুড়ি পুরনিগমের বিতর্কিত এক কাউন্সিলার বেলাকোবায় ছোট চা বাগান এবং গজলডোবাতে বাগানবাড়ি বানিয়েছেন বলেও গোয়েন্দাদের কাছে খবর পৌঁছেছে। সেই বাগানবাড়িতেও গিয়েছিলেন গোয়েন্দারা। গড়পড়তা বেতনের চাকরি করা ওই কাউন্সিলারের বিলাসবহুল বাড়ি ও আয়বহির্ভূত সম্পত্তি নিয়েও উঠেছে প্রশ্ন। গ্রেপ্তারির আঁচ পেয়ে বুধবার সকালেই গা-ঢাকা দিয়েছেন কাউন্সিলার।
জমি কারবারে কেজিএফ গ্যাংয়ের চার মাথাকে পাকড়াও করতে এদিন সিআইডি এবং পুলিশ ইস্টার্ন বাইপাস, সেবক রোড সহ বেশ কয়েকটি জায়গায় তল্লাশি চালায়। তবে কাউকেই গ্রেপ্তার করা যায়নি। গোয়েন্দা সূত্রের খবর, পুলিশের একাংশের সংকেত পেয়ে এলাকা ছেড়ে পালিয়ে গিয়েছেন গ্যাংয়ের চাঁইরা। গ্রেপ্তারি এড়াতে কলকাতায় গিয়ে তৃণমূলের কয়েকজন নেতাকে ধরে মুক্তি পাওয়ার চেষ্টা করছেন ডাবগ্রাম-ফুলবাড়ি এলাকার এক তৃণমূল নেতা। সূত্রের খবর, এসজেডিএ’র এক উচ্চপদস্থ আধিকারিক ও প্রাক্তন বোর্ড সদস্যকে গ্রেপ্তার করতে উপর মহলের নির্দেশের অপেক্ষা করছেন গোয়েন্দারা। কলকাতা থেকে সবুজ সংকেত পেলে শিলিগুড়িতে আরও কয়েকজন প্রভাবশালী তৃণমূল নেতা যে কোনও সময় গ্রেপ্তার হতে পারেন।