- শুভঙ্কর চক্রবর্তী
‘ফাঁকা জমি দেখতে যদি পাও
দেরি না করে খুঁটি পুঁতে দাও।
দৌড়ে যাও বিএলআরও-র কাছে
দেখবে, কাগজ রেডি করাই আছে।
নেতার ট্যাঁকে ঢুকলে দু-দশ লাখ
সরকারি জমি চুলোয় যায় যাক।’
উত্তরবঙ্গে এটাই এখন জমি মাফিয়াদের জপমন্ত্র। মালদার চাতরা বিল হোক বা শিলিগুড়ির রামকৃষ্ণ মিশন কিংবা কোচবিহারের নদীর চর, জমি মানেই সোনা। সেই সোনার জন্য খনির ভেতরে ঝুঁকি নিয়ে ঢুকতে হয় না। মাথার উপর শাসকদলের নেতার হাত, ভূমি দপ্তরের ঘুষখোর দু’-চারজন কর্মী আধিকারিকের সঙ্গে লেনদেনের সম্পর্ক, পুলিশের পকেটের চাহিদা মেটানোর ক্ষমতা থাকলে কিছুদিনেই মালামাল হয়ে যাওয়া যায়।
আচ্ছা বলুন তো কোটিপতি হওয়ার এর থেকে সহজ উপায় আছে? এখন ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম খুললেই কিছুক্ষণ পরপর দেখবেন মুকেশ আম্বানির ছেলে অনন্ত আম্বানি চলে আসেন। তারপর মিনিট দুয়েক ধরে ওঁর চালু করা খেলার মাধ্যমে সহজে বড়লোক হওয়ার রাস্তা বাতলে দেন। দেখলাম শচীন, ধোনির মতো ক্রিকেটাররাও সেই খেলার প্রচার করছেন। জমি মাফিয়ারা হয়তো ওঁদের কাজকর্ম দেখে হাসে। ভাবে, খুঁটি পুঁতলেই যেখানে লাখে কামাই সেখানে অত ঝক্কি কে সামলায় বাবা।
চলুন, একটা গড় হিসেব কষে দেখি। মোটামুটি মানের একজন চাকরিজীবী বা ব্যবসায়ীর মাসিক আয় ৩০ হাজার টাকা। অর্থাৎ বাৎসরিক আয় ৩ লক্ষ ৬০ হাজার টাকা। এবার আসি একজন জমি মাফিয়ার কথায়। শিলিগুড়ি শহরে একচিলতে দোকানঘর ৬০-৭০ লক্ষ টাকায় হাতবদল হয়। অর্থাৎ রাস্তার আশপাশে ছোট্ট একটা দোকান বসিয়ে দিতে পারলেই এক ধাক্কায় পকেটে ঢুকবে ৬০-৭০ লক্ষ। সেখান থেকে পুলিশ, কাউন্সিলার, নেতা, স্থানীয় ক্লাব, এখানে সেখানে বখরা দিলেও ৫০ লক্ষ টিকে যাবে। ভাবুন, একজন ছোট ব্যবসায়ী বা সাধারণ সরকারি/বেসরকারি কর্মী এক বছরে যা আয় করছেন কয়েক ঘণ্টায় তার থেকে কুড়িগুণ বেশি আয় করছে একজন জমি মাফিয়া৷
এটা তো সব থেকে কম আয়ের হিসেব। বড় প্লট পেলে সেখানে কোটি কোটি টাকা লেনদেন হয়। এবার বলুন, পড়াশোনা শেষকরে ডিগ্রি বগলদাবা করে চাকরির জন্য ধর্নায় বসা, না কি কয়েকজন মিলে কেজিএফ-এর মতো গুন্ডা গ্যাং বানিয়ে জমি দখল করে লক্ষ-লক্ষ টাকা কামানো- কোনটা সহজ?
কোচবিহার শহরে একের পর এক দিঘি দখল করে বহুতল বানিয়ে সামান্য কাউন্সিলার থেকে এক ব্যক্তি শহরের অঘোষিত হুজুর হয়ে উঠেছিলেন। জমি মাফিয়াগিরির টাকায় তৈরি করেছিলেন, নার্সিংহোম, হোটেল, শপিং মল, স্কুল থেকে আরও কত কী। তিনি আর ইহলোকে নেই। তাঁর ছেলে এখন লুটের টাকা ভোগ করছে। তবে জমি দখলের পুরোনো কারবার বন্ধ হয়নি।
মাঝে এক গুন্ডা নেতা রাজার শহরের হর্তাকর্তা হয়ে বসেছিলেন। বসেই পুকুরচুরি শুরু করলেন। কামেশ্বরী রোডে একের পর এক জমি দখল করে বিক্রি করে দিলেন। শালবাগানের জমি দখল করে হঠাৎ করেও সেখানে একদিন গ্যারাজ বানিয়ে দিলেন। এখন সেই জমি প্লট করে বিক্রির চেষ্টা হচ্ছে।
সেই গুণধর নেতা এবং তার ভাই মিলে দেদারে রেলের জমি প্লট করে কোটি কোটি টাকায় বিক্রি করে দিয়েছেন। দিনহাটা শহরে জমি কারবার নিয়ন্ত্রণের জন্য তো মদনমোহনবাড়িতে আস্ত একটা অফিস খোলা হয়েছে। শহরে পুকুর বোজানো, জমি কেনাবেচা সব কাজেই সেই অফিসে গিয়ে গুন্ডা ট্যাক্স জমা দিতে হয়। একটু একটু করে দোলাবাড়িদিঘি তো দখলই হয়ে গেল। এখন নজর পড়েছে ষষ্ঠিয়ার বিলে। তৃণমূলের একদল নেতা মিলে সিন্ডিকেট বানিয়ে সেখানে জমি কেনাবেচা শুরু করেছে।
এসব দেখবে কে? উদয়ন গুহ ফেসবুকে, সভাসমিতিতে হম্বিতম্বি করছেন ঠিকই, তবে মাফিয়ারা আছেন বহালতবিয়তেই।
আসলে মূল ব্যাপারটা হল, শ্রমহীন পুঁজি। এই যে চারদিকে এত গণ্ডগোল, মারামারি, মস্তানি এসবই হচ্ছে টাকার জোরে। আর সেই টাকার জোগান হচ্ছে শ্রমহীন পুঁজি বা বেআইনি পুঁজি থেকে। একজন ব্যবসায়ী, চাকুরিজীবী, কৃষক, শ্রমিক প্রত্যেকে শ্রমের বিনিময়ে অর্থ উপার্জন করেন। তাই উপার্জনের কষ্ট বা গুরুত্ব তাঁরা বোঝেন। কিন্তু মাফিয়া বা দালালদের পুঁজিতে শ্রম নেই। তাই লুটের টাকার একটা অংশ সন্তুষ্টিকরণে ব্যবহার করে তারা। আর সেই টাকাতেই সংগঠিত হয় নানা অপরাধ।
সেই অপরাধই হচ্ছে রায়গঞ্জে। শহরের বুকে বিলবাড়ি জলাশয় ভরাট হয়ে গেল। এখন প্লট করে বিক্রি হচ্ছে। বন্দর এলাকার প্রাক্তন তৃণমূল কাউন্সিলারের মস্তান ছেলেই যে সেই কাজ করছে এটা কারও অজানা নয়। সেখানে প্রশাসন, পুলিশের কর্তাদের চোখে ব্যামো হয়েছে। তাঁরা কিছুই নাকি দেখতে পান না।
মালদা শহরের চাতরা বিল দখল করে বহুতল উঠছে। একইসঙ্গে কিছু তৃণমূল নেতা, পুলিশ ও ভূমি দপ্তরের কর্তাদের সম্পত্তি বাড়ছে। সামসীর শতবর্ষ প্রাচীন রতনপুর হাটের জমি দখল শুরু হয়েছে। হরিশ্চন্দ্রপুরের নয়াটোলা গ্রামে খাসজমি দখল করে বিক্রি করে দিচ্ছেন মাফিয়ারা। জেলাজুড়ে এইধরনের হাজারো অভিযোগ আছে। প্রতিটি ক্ষেত্রেই সামনে আসছে তৃণমূলের নাম।
জমি মাফিয়াদের হাত এতটাই শক্ত যে আলিপুরদুয়ার শহরের ভাঙ্গাপুলে জলাভূমির চরিত্র পরিবর্তন করে বুজিয়ে ফেলা হয়েছে। তৃণমূলের এক ঠিকাদার নেতার নেতৃত্বে জমি মাফিয়া এবি জুটি শহরে দাপাচ্ছে। এক তৃণমূলের নেতা কাম মাফিয়া তো তপসিখাতায় কৃষি দপ্তরের কোটি কোটি টাকার জমি হজম করে ফেলল। এখন সেই টাকায় বিলাসবহুল হোটেল বানাচ্ছে।
সরকারি ব্যবস্থাপনায় উত্তরবঙ্গে চা বাগানের হাজার হাজার একর জমি লুট হয়ে গিয়েছে। জমি হাঙরদের নজরে পড়ায় চা শিল্পটাই উঠে যাওয়ার মুখে। সবার আড়ালেই বদলে যাচ্ছে আদিবাসী জমির চরিত্র। এখানে কিন্তু চুনোপুঁটিদের এন্ট্রি নেই। কোটি কোটি টাকার এই লেনদেন হচ্ছে ঠান্ডাঘরে। একেবারে শীর্ষস্থানীয় আমলা, নেতা, মন্ত্রীদের সঙ্গে। ধীরে ধীরে উত্তরের জঙ্গল দখলে সরকারিভাবেই বড় বড় জমি মাফিয়াদের নানা সুবিধা করে দেওয়া হচ্ছে।
এসব নিয়ে কিন্তু কথা হয় না। বলা ভালো, কথা বলতে দেওয়া হচ্ছে না। ট্যাঁ-ফোঁ করলেই টুঁটি চিপে ধরা হচ্ছে অন্যভাবে। আমাদের দেখানো হচ্ছে ফুটপাথ দখল, নদীর চর দখল, দু’-দশ বিঘা খাসজমি দখল। তা নিয়েই হইচই করছেন মুখ্যমন্ত্রী থেকে মুখ্যসচিব। মিডিয়াতে দিনভর চিৎকার চলছে। আর কায়দা করে নজর ঘুরিয়ে অতি সন্তর্পণে উত্তরের মাটির মালিকানা তুলে দেওয়া হচ্ছে বহুজাতিক নানা কোম্পানির হাতে।
জমি, মাটি বা ভূমি যেভাবেই চিহ্নিত করা হোক না কেন, তা হল সমস্ত বস্তুগত সম্পদের আদি উৎস এবং উন্নয়নের অন্যতম অস্ত্র। ক্ষমতার সঙ্গে মাটি বা জমির সম্পর্কও খুব পুরোনো। ‘লাঙল যার জমি তার’ এই স্লোগান দিয়েই পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতায় এসেছিল বামেরা। ‘অপারেশন বর্গা’ অর্থাৎ ভূমিহীনদের পাট্টা বা চাষের অধিকার দিয়ে কার্যত মিনি বিপ্লব ঘটিয়েছিল। তৃণমূলের ট্যাগলাইন, ‘মা মাটি মানুষ’। সিঙ্গুরের জমি আন্দোলনের মধ্য দিয়েই মুখ্যমন্ত্রী হয়েছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। বাম আমলেও জমি মাফিয়া ছিল। তবে তৃণমূলের শাসনে মাফিয়ারা কার্যত প্রাতিষ্ঠানিক মর্যাদা পেয়েছে।
প্রচণ্ড গরমে একপশলা বৃষ্টি হলে দেখবেন গরম আরও বেড়ে যায়। রাস্তা দিয়ে গরম ধোঁয়া উঠতে শুরু করে। জমি মাফিয়াদের দৌরাত্ম্য বন্ধে মুখ্যমন্ত্রীর পদক্ষেপ ওই একপশলা বৃষ্টির মতোই। আমি, আপনি এবং মুখ্যমন্ত্রীও ভালোভাবেই জানেন জমি মাফিয়াদের জেলে ঢোকাতে শুরু করলে তৃণমূলটাই উঠে যাওয়ার জোগাড় হবে। দু’দিন যা হল তারপর লোকে বলতে শুরু করেছে, ‘দেবাশিস প্রামাণিক বড্ড বাজে লোক। কিন্তু মুখ্যমন্ত্রী খুব ভালো।’ অতএব গোটা বিষয়টি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভালো ইমেজ তৈরি ছাড়া আর কিছুই নয়। আপাতত যা দশা তাতে রাজ্যকে জমি মাফিয়াহীন করা আর ধুলোহীন করার চেষ্টা করা সমান।
তাহলে কি উপায় নেই? আছে, উপায় একটা বাতলে দিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। ‘জুতা আবিষ্কার’ কবিতার সেই চামার কুলপতি বৃদ্ধের মাধ্যমে। রাজা হবুকে বৃদ্ধ পরামর্শ দিয়েছিলেন, ‘নিজের দুটি চরণ ঢাকো, তবে/ ধরণী আর ঢাকিতে নাহি হবে।’