Friday, July 5, 2024
Homeকলামসেলিম আর সুজনরা মনে করাচ্ছেন মায়াবতীকে

সেলিম আর সুজনরা মনে করাচ্ছেন মায়াবতীকে

 

  • রন্তিদেব সেনগুপ্ত

লোকসভা ভোটের আগে একটা রব উঠেছিল, সিপিএম এবার ঘুরে দাঁড়াবে। সিপিএম নেতারা তো এমন দাবি করছিলেনই, অনেক ভোট বিশেষজ্ঞও বলতে শুরু করেছিলেন, এবারের ভোটে সিপিএম হারিয়ে যাওয়া জমি ফিরে পাবে। অনেকে এ-ও বলতে শুরু করেছিলেন, অন্তত গোটা দু’-তিনেক আসনে সিপিএম এবার জিতে যাবে। আর বহু আসনেই সিপিএম এবার পৌঁছে যাবে দ্বিতীয় স্থানে।

মুর্শিদাবাদ, দমদম, যাদবপুরে সিপিএম প্রার্থীদের প্রচারে সমর্থকদের ভিড় দেখে উৎসাহিতও হন অনেকে। ফল বেরোনোর পর দেখা গেল, আসলে এ সবই ছিল মরীচিকা মাত্র। সিপিএমের ভাগ্যে কোনও শিকেই ছেঁড়েনি। উপরন্তু, সিপিএম নেমে গিয়েছে তৃতীয় স্থানে, বহু আসনেই তাদের জামানত পর্যন্ত বাজেয়াপ্ত।

অনেক কিছু আশা করার পর এই ভয়াবহ বিপর্যয় সিপিএম নেতৃত্বকে হতবাক করেছে। এই বিপর্যয়ের কী ব্যাখ্যা দেবেন, তাঁরা নিজেরাই বুঝে উঠতে পারছেন না। যদিও দলের কর্মীদের মন রাখতে সিপিএম রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিম এই বিপর্যয়ের ভিতর নতুন সিপিএমকে জন্ম নিতে দেখেছেন। কিন্তু তাঁর এই দেখায় কতজন সিপিএম কর্মী-সমর্থক ভরসা রাখতে পেরেছেন তা-ও গবেষণার বিষয়।

এত ঢক্কানিনাদ করেও সিপিএম পায়ের তলার মাটি ফেরাতে পারল না কেন? গত পাঁচ বছরে এই রাজ্যে সিপিএমের রাজনীতিটি যদি কেউ খতিয়ে দেখেন, তাহলেই বুঝতে পারবেন, সিপিএমের রাজনীতির গোড়াতেই গলদ রয়ে গিয়েছে। সিপিএম যে আসলে কার বিরুদ্ধে লড়াই করতে চায়, বা করছে, সেটাই তারা পরিষ্কার করতে পারেনি। এমনকি এই লোকসভা ভোটের সময়ও পরিষ্কার হয়নি সিপিএমের মূল লড়াইটি আসলে কার বিরুদ্ধে।

গত পাঁচ বছরে এখানে সিপিএমের লড়াইয়ের মূল অভিমুখটি ছিল তৃণমূল কংগ্রেস, মূলত মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরোধিতা। এই রাজ্যে রাজনৈতিকভাবে নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষা করতে গেলে মমতা বিরোধিতা তাদের করতেই হবে। সেই বাধ্যবাধকতা আছে, এটা বোঝা যায়। কিন্তু ভোটটি যখন লোকসভার, আরও পরিষ্কার করে বললে কেন্দ্রে বিজেপিকে প্রতিহত করার, তখন লড়াইয়ের অভিমুখটি যদি ঠিক না থাকে, তাহলে মানুষের সমর্থন আদায় করা কঠিন। সিপিএমের ঠিক সেটাই হয়েছে।

গত কয়েক বছরে সিপিএমের প্রচারের ধরন যদি লক্ষ্য করেন, বিশেষ করে এবার লোকসভা ভোটের সময়ও, দেখবেন মমতা এবং তৃণমূলের বিরুদ্ধে এখানে সিপিএমের সুর যতটা চড়া, ততটা চড়া সুর কিন্তু বিজেপির বিরুদ্ধে নয়। এমনকি অনেক ক্ষেত্রেই বিজেপির সুরে সুরও মিলিয়ে ফেলেছে সিপিএম। আর এখানেই বিজেপি বিরোধিতায় তাদের আন্তরিকতা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। প্রশ্ন উঠেছে, লোকসভা নির্বাচনে সিপিএমের মূল প্রতিপক্ষ কি তাহলে বিজেপি নয়?

সিপিএমের সদ্য অনুষ্ঠিত রাজ্য কমিটির বৈঠকে এ নিয়ে আলোচনাও হয়েছে। সিপিএমের রাজ্য কমিটির একটি সূত্র বলছেন, দলীয় নেতৃত্ব এখন মানছে লড়াইয়ের অভিমুখটা ঠিক ছিল না। অতি মাত্রায় তৃণমূল বিরোধিতা করতে গিয়ে বিজেপি বিরোধিতায় সেভাবে জোর দেওয়া হয়নি। ফলে বিজেপি বিরোধী ভোটাররা সিপিএমকে লোকসভা ভোটে  ভরসা করতে পারেননি।

এ যদি একটি দিক হয়, তাহলে আর একটি দিক হচ্ছে, তৃণমূল স্তরের মানুষদের মন বুঝতে সিপিএম পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছে। রাজ্য সরকারের লক্ষ্মীর ভাণ্ডার, কন্যাশ্রী এই ধরনের সামাজিক প্রকল্পগুলি যে তৃণমূল স্তর এবং প্রান্তিক শ্রেণির মানুষের দৈনন্দিন জীবনধারণের ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক দিশা দেখিয়েছে- সেটাই বুঝতে পারেনি সিপিএম। আগাগোড়া তারা, ‘শিক্ষা নয়, ভিক্ষা চাই’ এই ধরনের কটূক্তি করে এই তৃণমূল স্তরের এবং প্রান্তিক শ্রেণির মানুষদের কার্যত অপমান করে গিয়েছে। বরং সিপিএম ব্যস্ত থেকেছে সরকারি কর্মীদের ডিএ বৃদ্ধির আন্দোলনে, যার কোনও প্রভাবই আমজনতার ভিতর পড়েনি।

সিপিএম কর্তারা বলছেন, সরকারি এই প্রকল্পগুলিকে নিয়ে নানারকম কটূক্তি করা যে বুমেরাং হয়ে ফিরেছে, সেটিও দলীয় নেতৃত্ব বুঝতে পেরেছে। রাজ্য কমিটির সভায় সেটি স্বীকারও করা হয়েছে। এবং প্রকাশ্যেও দলের কোনও কোনও নেতা বলেওছেন, ‘শিক্ষা নয়, ভিক্ষা চাই’ এই ধরনের প্রচার অনুচিত।

সিপিএম নেতৃত্ব এবার লোকসভা ভোটের পর বুঝতে পারছে, গ্রামীণ, প্রান্তিক সাধারণ মানুষের ভিতর তাদের দলের যে জনভিত্তিটি ছিল, সেটি সম্পূর্ণ নষ্ট হয়ে গিয়েছে। এমনকি যে তরুণ নেতা-নেত্রীদের তারা তুলে আনতে চাইছে, তাঁরা কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস রাজনীতিতে দক্ষ হলেও তৃণমূল স্তরের সঙ্গে সেভাবে তাঁদের যোগসূত্র নেই। থাকলে ‘শিক্ষা নয়, ভিক্ষা চাই’  মার্কা অপরিণামদর্শী প্রচার তাঁরা করতেন না।

সিপিএমের এক নেতা বলছিলেন, দলটি কালে কালে শহুরে মধ্যবিত্ত এবং উচ্চবিত্তদের দলে পরিণত হয়েছে। এই মধ্যবিত্ত এবং উচ্চবিত্ত নির্ভর হয়ে ২০২৬ কেন ২০৩১-এও সিপিএম ঘুরে দাঁড়াতে পারবে না।

রাজ্য কমিটির বৈঠকে সিপিএমের অনেক নেতাই এ-ও স্বীকার করেছেন, এই রাজ্যে বিরোধী রাজনীতির পরিসরটি তাদের হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে। এবং সেই পরিসরটি দখল করে ফেলছে বিজেপি। অদূরভবিষ্যতেও যে বিরোধী পরিসরটি সিপিএম দখল করতে পারবে সে সম্ভাবনাও এই নেতারা দেখতে পাচ্ছেন না।

আর এভাবে তৃণমূল বিরোধী রাজনীতিতে ক্রমশ অপাঙক্তেয় হয়ে পড়ার জন্য তাঁরা দলের দিশাহীনতা এবং ভুল রাজনৈতিক কৌশলকেই দায়ী করছেন। ক্ষমতা থেকে চলে যাওয়ার পর দীর্ঘদিন আন্দোলনবিমুখ হয়ে থাকার ফলে সেই শূন্যস্থানটি যে বিজেপি দখল করতে পেরেছে মানছেন তাঁরা।  সেইসঙ্গে সিপিএম সূত্র বলছে, ২০১৯-এর লোকসভা ভোটে তৃণমূলকে আটকাতে বিজেপিকে ভোট দেওয়ার যে কৌশল জেলা এবং আঞ্চলিক স্তরে সিপিএম গ্রহণ করেছিল, সেটা এবারও  অব্যাহত রয়েছে।  এবারও সিপিএমের ভোট বিজেপিতেই গিয়েছে। সিপিএমের দলীয় পর্যবেক্ষণেই সেটি ধরা পড়েছে।

সিপিএম নেতারা স্বীকার করুন চাই না করুন, তৃণমূলকে ঠেকাতে দলের ভোট এভাবে বিজেপিকে উপঢৌকন দিয়ে সিপিএমের লাভ কিছুই হয়নি। বরং ভোটের বাজারে বিজেপি তাতে হৃষ্টপুষ্ট হয়েছে। আর সিপিএমের রক্তাল্পতা আরও বৃদ্ধি পেয়েছে। নিজের নাক কেটে পরের যাত্রাভঙ্গ করার নির্বুদ্ধিতাপ্রসূত প্রয়াসের সার্থক উদাহরণ।

সামনের সপ্তাহেই এই রাজ্যের চারটি বিধানসভা কেন্দ্রে উপনির্বাচন। এই চারটি উপনির্বাচনেই তৃণমূলের সঙ্গে মূল লড়াই বিজেপির। যদিও বাম-কংগ্রেসও তাদের প্রার্থী দিয়েছে। এই হেরে যাওয়া লড়াইয়েও সিপিএম তার ভোট বিজেপিকে উপহার দেবে কি না সেটাও দেখার। সেলিম-সুজনদের সঙ্গে উত্তরপ্রদেশের ভোটকাটুয়া বহেনজি মায়াবতীর সাদৃশ্য যে ক্রমেই প্রকট হচ্ছে।

Uttarbanga Sambad
Uttarbanga Sambadhttps://uttarbangasambad.com/
Uttarbanga Sambad was started on 19 May 1980 in a small letterpress in Siliguri. Due to its huge popularity, in 1981 web offset press was installed. Computerized typesetting was introduced in the year 1985.
RELATED ARTICLES
- Advertisment -
- Advertisment -spot_img

LATEST POSTS

Migrant Worker | ঘুমের ঘোরে ট্রেন থেকে পড়ে মৃত্যু পরিযায়ী শ্রমিকের, দেহ ফেরাতে পরিবারের...

0
হরিশ্চন্দ্রপুরঃ পরিবারের মুখে হাসি ফোটাতে সংসারে আর্থিক সচ্ছলতা আনতে গত মঙ্গলবার করমন্ডল এক্সপ্রেসে চেন্নাই রওনা হয়েছিলেন হরিশ্চন্দ্রপুর থানা এলাকার সালালপুর এলাকার বাসিন্দা বছর চব্বিশের...

TMC Leader Arrest | ‘মমতা-অভিষেকের উপর আস্থা আছে’, দিল্লি থেকে নেমেই বার্তা ধৃত গৌতমের

0
বাগডোগরা: 'মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়-অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপর আমার আস্থা আছে।' গ্রেপ্তার হওয়ার পর দিল্লি থেকে বাগডোগরা বিমানবন্দরে নেমে এমনটাই জানালেন তৃণমূলের ডাবগ্রাম-ফুলবাড়ি ব্লকের সহ সভাপতি গৌতম...

Euro Cup 2024 | গোল দিয়েই বিতর্কিত ভঙ্গিমায় উচ্ছ্বাস প্রকাশ! তুরস্কের ডেমিরালকে ২ ম্যাচের...

0
উত্তরবঙ্গ সংবাদ ডিজিটাল ডেস্ক: ২ ম্যাচের জন্য ইউরো কাপ-২০২৪ থেকে নির্বাসিত করা হল তুরস্কের ডিফেন্ডার মেরি ডেমিরালকে। তুরস্কের এই ফুটবলার অস্ট্রিয়ার বিরুদ্ধে শেষ ষোলোর...

Rain Forecast | ভারী বৃষ্টির পূর্বাভাস মালদা-দক্ষিণ দিনাজপুরে, টানা ৫ দিন দুর্যোগের সম্ভাবনা

0
পতিরাম: লাগাতার বৃষ্টিতে নাজেহাল উত্তরবঙ্গ। এরই মাঝে ভারী বৃষ্টির পূর্বাভাস দিল মাঝিয়ান আবহাওয়া পর্যবেক্ষণ কেন্দ্র। আগামী ৫ দিন মালদা এবং দক্ষিণ দিনাজপুরে ১৫০ মিলিমিটার...

Keir Starmer | ১৪ বছর পর ব্রিটেনে ক্ষমতার পালাবদল, প্রধানমন্ত্রী হয়ে কী বললেন স্টার্মার?

0
উত্তরবঙ্গ সংবাদ ডিজিটাল ডেস্ক: ১৪ বছর পর ব্রিটেনে ক্ষমতার পালাবদল হল। কনজারভেটিভ পার্টি (টোরি)-কে পরাজিত করে নিরঙ্কুশ জয় পেল লেবার পার্টি। ব্রিটেনের নতুন প্রধানমন্ত্রী...

Most Popular