- নব দত্ত
বিনা নোটিশে কোনও ধরনের উচ্ছেদ সমর্থন করা যায় না। সুপ্রিম কোর্টে ২০১০ সালের ৮ অক্টোবর বিচারপতি জিএস সিং এবং অশোককুমার গঙ্গোপাধ্যায় হকার সংক্রান্ত রায়ে জানালেন, হকারের যেমন হকিং করার মৌলিক অধিকার আছে, তেমনই একইসঙ্গে পথচারীদের স্বাধীনভাবে রাস্তায় চলার অধিকার আছে। এই নির্দেশের পরেই দেশে আইন তৈরি হল The Street vendors protection of livelihood and regulation। ২০১৪ সালের এই আইন বাংলা পথ বিক্রেতা (জীবিকা সুরক্ষা ও পথ ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ) আইন। এই আইন ২০১৮ সালে রাজ্য সরকার বিধানসভায় পাশ করল। চালু হল এই সংক্রান্ত বিধি নিয়ম।
আইন অনুযায়ী, শহরের হকার সংখ্যা জনসংখ্যার আড়াই শতাংশ ধরে নিয়ে শহরের পরিকল্পনা করতে হবে। এই সংখ্যা পেরিয়ে না গেলে কোনও হকারকেই অবৈধ বলা যাবে না। বাস্তবে আইন মেনে সরকার, পুলিশ, প্রশাসন, হকার ইউনিয়ন এবং অঞ্চলের শাসকদলের অসাধু নেতারা চলছে না। শহরে সমীক্ষায় হকারদের তিন শ্রেণিতে ভাগ করে তার তালিকা প্রস্তুত করতে হবে। শহর ভেন্ডিং কমিটি হবে, আইন অনুযায়ী প্রত্যেক হকারকে সার্টিফিকেট দেওয়া হবে। তাঁরা ৩/৪/৫ ফুট জায়গার বেশি পাবেন না। প্রত্যেক জনবহুল চৌরাস্তার মোড় থেকে ৫০ মিটারের মধ্যে হকার বসতে পারবে না। প্রত্যেক জায়গায় তিন ভাগের এক ভাগে হকার বসতে পারবে। পুরসভা এদের কাছ থেকে আবর্জনা পরিষ্কারের খরচ, মেইনটেনান্স বাবদ একটা টাকা নিতে পারবে। এই আইন মেনে যদি সবটা হত তাহলে পথচারীর ক্ষোভ, সরকারের বুলডোজারের প্রয়োজন হত না।
আমার জানা যতটুকু আছে তাতে, এবার উচ্ছেদ অধিকাংশই করা হয়েছে যাঁরা ফুটপাথ দখল করে, ঘিরে, প্লাস্টিক, টিন, সিমেন্টের দেওয়াল তুলে ব্যবসার নামে রাস্তা চলাচল বন্ধ করে দিয়েছেন। এবং বহু ক্ষেত্রে এঁরা পুলিশের মদতে, শাসকদলের দুর্নীতিপরায়ণ কিছু ব্যক্তিকে নিয়মিত অর্থ দিয়ে এইসব বেআইনি কাজ করছেন। কিছু হকার আইন মানেন না। শুধু তাই নয়, সরকারি সার্ভিস রোড, ক্যারেজ ওয়েতে দখল করে অন্যদের ভাড়া খাটান। হকার সংগ্রাম কমিটির নেতা বলছেন, রাজ্যে এই নেতারা প্রায় ২৬৫ কোটি টাকা বছরে তোলেন। তবে আমি মনে করি, কয়েকজন হকারের প্রশাসনের একাংশের সহযোগে এইসব বেআইনি কাজের জন্য গোটা হকার পেশায় যুক্ত সবাইকে দায়ী করা ঠিক হবে না।
এবার যে উচ্ছেদের ঘটনা হল, পুলিশ, পুরসভা কোথাও এই ধরনের আগাম নোটিশ দেয়নি। এটা সাধারণ ন্যায়ের পরিপন্থী। কলকাতা, শিলিগুড়ির মতো জায়গায় সাম্প্রতিককালে হকার বেড়েছে। বিশেষত ফুড হকার। একই সঙ্গে অনেকেই আইনের কোনও তোয়াক্কা না করে দোকানে স্থায়ী সিমেন্টের, টিনের শেড বানিয়ে নিচ্ছেন।
অবশ্যই এটা কোনও প্রশাসনের পক্ষে মেনে নেওয়া সম্ভব নয়। প্রশ্ন হল, সিটি ভেন্ডিং কমিটি হলেও তার কার্যকারিতা পাঁচ বছরেও হল না কেন? এটা রূপায়ণে সচেষ্ট থাকলে আজ মারামারি, জবরদখল, বুলডোজার, নাগরিক স্বার্থ বিরোধী এসব হত না। হকারদের অর্থনীতি একটা সচল গরিব অর্থনীতিকে চাঙ্গা রাখে। মুখ্যমন্ত্রীর রাস্তা, ফুটপাথ ঘিরে চলার পথ সংকীর্ণ বা বন্ধ করে দখল উচ্ছেদমুক্ত করাকে আমি পুরোপুরি অন্যায্য বলে মনে করি না। প্লাস্টিকের ছাউনি দিয়ে ঘিরে যেভাবে বহু জায়গায় হকারদের দোকান, স্টল করা হয়েছে, অনেক জায়গায় পুরসভা কর্মীদের আবর্জনা পরিষ্কার, নিকাশির কাজ করতে দেওয়া হয় না। সেটা কাঙ্ক্ষিত নয়।
কিন্তু দখলমুক্ত করার নামে অসম্মানের প্রচেষ্টা হলে প্রতিবাদ করতে হবে। দ্রুত আলোচনা করে আইন মেনে ভেন্ডিং কমিটি গঠন দরকার। সমীক্ষার মাধ্যমে আবেদনকারী সমস্ত ভেন্ডার, হকারদের সার্টিফিকেট প্রদান, ফুটপাথের এক-তৃতীয়াংশ জায়গা ছেড়ে বসা, রাস্তার মোড় থেকে পঞ্চাশ ফুট জায়গার ছেড়ে বসা- এই সবই আইন স্বীকৃত। এইভাবেই সমস্যার নিষ্পত্তি করতে উদ্যোগ প্রয়োজন।
(লেখক পরিবেশবিদ)