সোমবার, ১৭ মার্চ, ২০২৫

সীমান্তের কাঁটাতারে ঝুলে একটি শ্রেণি

শেষ আপডেট:

 

  • মৌমিতা আলম

ভোলাদাদু বললেন, মাটির নীচে আমি জলদস্যুদের অনেক মণিমুক্তো লুকিয়ে রাখতে দেখেছি। তাই শুনে গ্রামের সব লোক মাটি খুঁড়তে শুরু করল। খুঁড়েই যায়, খুঁড়েই যায়। সকাল গড়িয়ে রাত, দুপুর গড়িয়ে বিকেল… অনেক খোঁজাখুঁজির পর, ভোলাদাদু বললেন আসলে আমি দুপুরবেলা ঘুমিয়েছিলাম আর সেই সময় ঘুমের মধ্যে স্বপ্ন দেখেছিলাম জলদস্যুদের…।

এটা গল্পকার মনোজ দাসের গল্প।

গল্প হলেও সত্যি- এমন ট্যাগলাইন মেনেই চলছে আমাদের জীবন। আমরাও তাই খুঁজে চলেছি বাবরি থেকে জ্ঞানবাপী থেকে আজমের, আজমের থেকে…

চলতেই থাকবে যতদিন না ভোলাদাদুকে আমরা প্রশ্ন করতে শিখি! ততদিনে ফুলকপির দাম বাড়বে, বাড়ির দাম বাড়বে, বেকারত্বের সংখ্যা আকাশ ছোঁবে, দমবন্ধ বিষাক্ত হাওয়া থেকে বাঁচতে আমরা অক্সিজেন সিলিন্ডার পিঠে নিয়ে ঘুরব, আরও ডজনখানেক বিলিয়নিয়ার সৃষ্টি করে ভারত বিশ্বের আসনে সর্বশ্রেষ্ঠ হবে। আর ঘৃণা দিয়ে আমরা তলিয়ে যাব আরও অন্ধকারে। মধ্যবিত্ত, উচ্চবিত্ত তবুও চারদেয়ালের মাঝে একা বসে মুঠোফোনে বিষাক্ত ঘৃণা উগরে সুখ ঘুম দেব। আর গ্রামের মানুষ কাজ হারিয়ে, টাকা দিয়ে শিক্ষা কিনতে না পেরে আরও পিছিয়ে যাবে।

আমার দেশের পতাকাকে কিছু বিকৃত লোক অপমানিত করেছে, অবশ্যই শাস্তির যোগ্য। কিন্তু তাদের দেশের পতাকা নিয়ে বিষ উগরে, তাদের মেডিকেল ভিসা না দেওয়ার, পেঁয়াজ না দেওয়ার, সমস্ত বাণিজ্য বন্ধ করে দেওয়ার দাবি জানিয়ে, ঘৃণা ছড়িয়ে বিষাক্ত করে দেওয়া হচ্ছে দু’দেশের পরিবেশ।

১৯৪৭ সালে দেশভাগ যন্ত্রণার। র‍্যাডক্লিফ-এর ধারালো ছুরিতে যে রক্তপাত তখন শুরু হয়েছিল তার উপশম না করে ভারতীয় উপমহাদেশের তিন ভাই- ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশের রাজনৈতিক নেতারা নিজেদের লাভের জন্যই জিইয়ে রেখেছে ক্ষত। নিজেদের দেশের সমস্যা মেটাতে না পারলে চরম উগ্র জাতীয়তাবাদ সৃষ্টি করে সংখ্যাগুরুদের একসঙ্গে নিয়ে আসার জন্য বারবার এদের প্রয়োজন হয় এক শত্রু দেশ।

যে অজানা শত্রুর ভয়ে দৈনন্দিন জীবনের চাওয়াপাওয়া দাবি না জানিয়ে জনগণ মেতে থাকবে সেই অজানা, অচেনা শত্রুর অনিষ্টসাধনে। তাই বারবার ভারতে ভোটের সময় উঠে আসে পাকিস্তানের নাম আর বাংলাদেশে ভারতকে শত্রু দেশ হিসেবে স্থাপিত করতে মেতে ওঠে একদল। আর আমরা মধ্যবিত্ত সেটা নিয়ে লেগে পড়ি যুদ্ধে সামাজিক মাধ্যমে। ভুলে যাই আমাদের মৌলিক দাবিগুলোর কথা। তাই বাংলাদেশের ক্রিকেট টিম হারলে লাখ লাখ টাকার বাজি ফাটাই, ভারতের সঙ্গে পাকিস্তানের খেলা থাকলে এদেশের মুসলিমদের লিটমাস টেস্ট! অথচ ক্রিকেট খেলে এই গরিব দেশের কী লাভ হয় কে জানে! কোটি কোটি টাকার মালিকানা নিয়ে ক্রিকেট বোর্ড আসলেই একটি কর্পোরেট সংস্থা।

অতীত ক্ষতর উপশম মানবাধিকারের এক অন্যতম প্রধান শর্ত। ১৯৪৭-এর পর এত বছর কেটে গিয়েছে। পশ্চিম বাংলা ক্ষত বুকে নিয়ে আপন করে নিয়েছে ওপার থেকে ঘরবাড়ি ছেড়ে আসা লোকেদের। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর নাৎসি বীভৎসতার ক্ষত উপশমে জার্মানি বারবার স্বীকার করেছে তাদের সামগ্রিক গিল্ট-কে। তাঁদের শিক্ষা ব্যবস্থায় পড়ানো হয় বারবার সেইসব দিনের বীভৎসতার কথা। যাতে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম আর সেই কালো, অন্ধকার দিনে পা না বাড়ায়। সেখানে আমাদের সংস্কৃতি থেকে ইতিহাস- সবই ব্যবহৃত হচ্ছে ঘৃণা ছড়ানোর জন্য।

বারবার ইসলামিক রাজাদের শাসনকালে হওয়া ঐতিহাসিক ভুল শুধরে নেওয়ার কথা বলে জনগণকে উসকে দেওয়া হচ্ছে। গত কয়েক বছরে যাঁদের পিটিয়ে মারা হয়েছে বা যারা মেরেছে, তাদের শ্রেণিগত অবস্থান খুঁটিয়ে দেখলেই খুব পরিষ্কার হয়ে যায় যে এতে আসলে ক্ষতি কার!

যে সাবির আলিকে গোমাংস খেয়েছেন এই অজুহাতে পিটিয়ে মারা হল আর যারা পিটিয়ে মারল তাদের শ্রেণিগত অবস্থান কী? সাবির একজন পরিযায়ী শ্রমিক আর যারা মারল তাদের শ্রেণিগত অবস্থান? যদিও ক্রিমিন্যাল বলে যাদের জেলে রাখা হয় তাদের শ্রেণিগত অবস্থানের পরিসংখ্যান আছে বলে আমার জানা নেই। করলেই সমস্যা রাষ্ট্রের। এমনটা কেন? যে মানুষটি দরিদ্রতায় জর্জরিত, তাকে হিংসার কবলে নিয়ে আসা সহজ, মিথ্যে গেলানো সহজ।

ওয়ার্ল্ড ইকনমিক ফোরামের রিপোর্ট অনুসারে, ভুল ও মিথ্যা খবর প্রচারে ভারত এখন শীর্ষে। দুটো দেশের দুটো অপদার্থ সরকার আর তদুপরি পুঁজির স্বার্থে কাজ করে ২৪×৭ ঘণ্টা ঘৃণা চালানো মিডিয়া বিষিয়ে দিচ্ছে, বিপন্নতার দিকে ঠেলে দিচ্ছে দুই দেশের সংখ্যালঘুদের। সংখ্যালঘু শুধুই সংখ্যালঘু- তাঁদের কোনও ধর্ম হয় না, তাঁরা স্থান বিশেষে হিন্দু, মুসলিম, আহমেদিয়া, বালোচ যা কিছু হতে পারে। সংখ্যালঘু হল নিপীড়িত শ্রেণি।

ওপার বাংলা থেকে আসা মানুষজনদের চিকিৎসা দেব না, হোটেলে খাবার দেব না- এগুলো ঘৃণার কারবারিদের কারবার। ক্ষত উপশমে সাধারণ মানুষকে আরও কাছাকাছি আসতে হবে। বুঝতে হবে সেদেশের সাধারণ মানুষ এবং এদেশের সাধারণ মানুষদের ভিতরে কোনও পার্থক্য নেই। ওপার বাংলায় মহিদুল ১০০ টাকায় পেঁয়াজ কিনলে এপার বাংলাতেও দিলীপ টমেটো কিনছে ১০০ টাকায়। তিস্তার জল শুকিয়ে গেলে বিপন্ন হবে দু’দেশের লোকেই। শিক্ষার অধিকার, স্বাস্থ্যের অধিকার, কাজের দাবির মৌলিক প্রশ্নে সরকার ব্যর্থ। আর সেই কবেই তো স্যামুয়েল জনসন, যিনি প্রথম ইংরেজি অভিধান তৈরি করেন, বলে গিয়েছেন,

“Patriotism is the last refuge of the scoundrel.”

হ্যাঁ, রাজনৈতিক নেতারা যখন সমস্যা সমাধানে ব্যর্থ হবে, তখন ঘুরিয়ে দিতে চাইবে জনগণের অভিমুখ দেশপ্রেম, উগ্র জাতীয়তাবাদের দিকে। ধর্মের চশমা দিয়ে সব ঘটনা দেখলে ঘৃণার বাজার বাড়বে। ইতিহাসের সঠিক তথ্য জানতে হবে। আজমের খুঁড়ে দেখতে গেলে দেখতেই হবে আজমের শরিফ ঘিরে টিকে থাকা দীর্ঘ সকল ধর্মের সমন্বয়ের ইতিহাস। জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডর পর যে কমিটি গঠন করে ব্রিটিশরা তার রিপোর্টে বলা হয়, ভারতীয়রা একটি বিদ্রোহর পরিকল্পনা করছে আর সেটির সিদ্ধান্ত হয় আজমের ওরশ-এ। ঐতিহাসিক সাকিব সালিম লিখছেন, ১৯৬২ সালের ভারত-চিন যুদ্ধের সময় আজমের দরগা দু’কিলো সোনা দান করেছিল প্রতিরক্ষামন্ত্রককে। কেনা হয় এক লাখ টাকার ডিফেন্স সার্টিফিকেট। যিনি সোনা হাতে তুলে দেন সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীর হাতে, তিনি আর কেউ নন, আজকের বিখ্যাত অভিনেতা নাসিরুদ্দিন শাহের বাবা আলে মোহাম্মদ শাহ।

ইতিহাস থেকে অর্ধসত্য পড়লে বা বিকৃত ইতিহাস পড়লে ঘৃণা নিয়ে রক্তক্ষয় অবধারিত। হলোকাস্ট মেমোরিয়াল ডে তে নাৎসিবাহিনীর অসউইজ ক্যাম্প থেকে নিজের মিথ্যে বয়স বলে বেঁচে ফেরা, যার সামনেই তার মাকে ঢুকিয়ে দেওয়া হয় গ্যাস চেম্বারে, সেই মিসেস পোলাক সাবধান করে দিয়েছেন আমাদের ঘৃণা সম্পর্কে,

‘আমাদের ঘৃণার প্রোপাগান্ডা সম্পর্কে সচেতন থাকতেই হবে। এটা শুরু হয় একটি ছোট ঝরনার মতন আর তারপর ফেটে পড়ে। তখন কারও কিছুই করার থাকে না।’

হ্যাঁ ঠিক তাই। ঘৃণা নিয়ে আরও রক্তক্ষয়। তাতে বরাবর লাভ হয়েছে একশ্রেণির। দেশভাগ কিন্তু শুধু ধর্মের ভিত্তিতে নয়, ধর্মের আড়ালে দুটো সম্প্রদায়ের উচ্চশ্রেণির মানুষের নিজেদের ক্ষমতালিপ্সাও লুকিয়ে ছিল। তাই দেশভাগে সাধারণ মানুষ সর্বস্বান্ত হলেও, এপারের ক্ষমতার অলিন্দে থাকা লোকজন ওপারে গিয়েও ক্ষমতার অলিন্দেই ছিলেন। ভালোবাসা, সৌহার্দ্য ছাড়া ক্রমাগত বিরূপ হতে থাকা পৃথিবীতে মানুষ প্রজাতির টিকে থাকা মুশকিল।

একই ভূখণ্ডের দুটো দিক। একই হাওয়া, মাটি, জল। সেই কাঁটাতারে ঝুলছেন একটি শ্রেণি : কিছুই না পাওয়া সর্বহারা শ্রেণি স্বর্ণা দাশ, ফেলানি খাতুন। আমরা যেন ভুলে না যাই।

(লেখক শিক্ষক। ময়নাগুড়ির বাসিন্দা)

Uttarbanga Sambad
Uttarbanga Sambadhttps://uttarbangasambad.com/
Uttarbanga Sambad was started on 19 May 1980 in a small letterpress in Siliguri. Due to its huge popularity, in 1981 web offset press was installed. Computerized typesetting was introduced in the year 1985.

Share post:

Popular

More like this
Related

পাহাড়ে হোমস্টে বিপ্লবে লাল সংকেত

প্রশান্ত মল্লিক কুড়ি-বাইশ বছর আগে, যখন হোমস্টে পর্যটনের ধারণা সবেমাত্র...

যোগেন মণ্ডল : এক ইতিহাসের নায়ক

অশোক ভট্টাচার্য ১৮৭২ সালের জনগণনা থেকে জানা যায়, অবিভক্ত বাংলার...

কত রাধিকা ফুরোল  

  সেবন্তী ঘোষ   কবি পুরুষের চোখে নারী চিরকাল ‘শুশ্রূষার ...

তোমার কথা হেথা কেহ তো বলে না

লীনা গঙ্গোপাধ্যায় ঝকঝকে নির্মেঘ আকাশ, বসন্তের মন প্রাণ উথাল...