সপ্তর্ষি সরকার, ধূপগুড়ি: সকালে ওঠো-পিকআপ ভ্যানে বাদুড়ঝোলা হয়ে আলুখেতে পৌঁছাও, মা-কাকিমার সঙ্গে আলু তোলো, সন্ধ্যায় ২০০ টাকা হাতে বাড়ি ফেরো। গত মাসখানেক ধরে এটাই রোজকার রুটিন চা বাগানের শ্রমিক মহল্লার নাবালক-নাবালিকাদের। শিশুশ্রম আইনকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে ধূপগুড়ির (Dhupguri) আলুখেতে চলে কাজ।
পেটের ভাত জোটাতেই যে রোজকার এই কাজে যাওয়া, মেনে নিল বানারহাট আদর্শ বিদ্যামন্দির হাইস্কুলের নবম শ্রেণির এক ছাত্র। দেবপাড়া বাগানের ওই নাবালকের কথায়, ‘বাবা অন্য রাজ্যে কাজ করতে গিয়েছেন। আমি মায়ের সঙ্গে আলু তুলতে আসি। সকাল সাতটায় গাড়ি চড়ে আসি। নিয়ে আসা খাবার দুপুরে খেয়ে আবার কাজ করি। রাতে বাড়ি ফিরি। এজন্য দুশো টাকা হাজিরা পাই।’
আলু তোলার ভরা মরশুমে গ্রামগঞ্জে পর্যাপ্ত খেতমজুরের মারাত্মক আকাল। তার ওপর এখন চলছে রমজান মাস। মুসলমান শ্রমিকদের একাংশ তাই রোদে আলুখেতের পরিশ্রমের কাজ থেকে দূরে থাকছেন। এইসময় কাজ করতে তাই ভরসা সুরেন্দ্রনগর, বান্দাপানি, কাঁঠালগুড়ির পাশাপাশি দেবপাড়া, রেডব্যাংক, সাইলি বাগানের বিভিন্ন বয়সের সস্তার মজুররা।
আর এই খেতমজুর জোগানের কাজে নেমেছে দালালরা। এজন্য মাথাপিছু ভালো কমিশনও কাটছে তারা। আদিবাসী চা শ্রমিকরা খেতে কাজ করলেও মজুরি হাতে পায় দালালরাই। নিজেদের অংশ কেটে ফেরার পথে মজুরি বুঝিয়ে দেওয়া হয় শ্রমিকদের। আলু তোলার খেতমজুর হিসেবে জোগান দিয়ে দৈনিক মাথাপিছু ৫০ টাকা বা তারও বেশি রোজগার করে দালালরা।
মহিলারা মূলত আলু তোলার কাজ করেন। জমির কেল ফাটানো থেকে বস্তায় ভরা, সেলাই, আলু এক জায়গায় ডাঁই করা কিংবা গাড়িতে লোড করার মতো বেশি পরিশ্রমের কাজ করেন পুরুষরাই। এজন্য স্থানীয় পুরুষরা ৩৫০-৫০০ টাকা এবং মহিলারা ২৫০-৩৫০ টাকা দৈনিক হাজিরা পান। চা বাগানের শ্রমিকদের ক্ষেত্রে পুরুষ হোক বা মহিলা, হাজিরা মেলে ২৫০ টাকা। স্কুল পড়ুয়াদের ক্ষেত্রে সেটা ২০০ টাকা। তাহলে পড়াশোনা? নিউ ডুয়ার্স জুনিয়ার হাইস্কুলের অষ্টম শ্রেণির ছাত্রীর কথায়, ‘কয়েকদিন কাজ করে আবার স্কুলে যাব।’
ভরা দিনের আলোয় স্কুল পড়ুয়াদের খেতমজুর হিসেবে নিয়ে আসা এবং সামান্য মজুরিতে তাদের খাটানো হচ্ছে। বিষয়টি নিয়ে জেলা শিশু সুরক্ষা আধিকারিক সুদীপ ভদ্র বলেন, ‘১৪ বছরের বেশি বয়সের নাবালক পারিবারিক কাজ করতেই পারে, কিন্তু স্কুলের সময়ে নয়। তাছাড়া শিশুদের এভাবে বাইরে অন্য কাজে যুক্ত করাটা আইনবিরুদ্ধ।’
ইংরেজদের পাল্লায় পড়ে একসময় ছোটনাগপুর মালভূমির বাসিন্দাদের ঠাঁই হয়েছিল তরাই-ডুয়ার্সের চা বাগানে। তাঁদের উত্তরসূরিরা আজ একশ্রেণির দালালের পাল্লায় পড়ে আজ আলুখেতে খেতমজুর।