রূপায়ণ ভট্টাচার্য
দেশটার উত্তর-পশ্চিমে মালি। উত্তর-পূর্বে নাইজার। দক্ষিণ-পূর্বে বেনিন। দক্ষিণ-পশ্চিমে আইভরি কোস্ট। দক্ষিণে ঘানা ও টোগো।
একেবারে সব দিক বন্ধ। ছয় দেশ দিয়ে অবরুদ্ধ একেবারে।
এই আফ্রিকান দেশটার নাম বারকিনা ফাসো। পৃথিবীতে এই মুহূর্তে ৪৪টি দেশ ভূগোলের বিচারে ডেড লকড। মানে এসব দেশের কোনওদিকেই সমুদ্র নেই। যেমন পাশের ভুটান, নেপাল ও আফগানিস্তান। বারকিনা ফাসোও তাই।
এসবের মধ্যে বারকিনা ফাসোকে নিয়ে লিখতে বসার একটাই কারণ। হঠাৎই এক অদ্ভুত কারণে বিশ্বে আলোচনার কেন্দ্রে দেশটা।
এমনিতে ইউরোপ বাদে অবরুদ্ধ দেশগুলোর অবস্থা শোচনীয়। রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সমস্যা লেগেই থাকে। আন্তর্জাতিক জল না থাকা এক বিশাল সমস্যা। সেখানে জল পাওয়ার লড়াই প্রবল। তার জন্য নিয়মিত রক্ত ঝরে, গুলি চলে, অর্থ লুটপাট লেগে থাকে।
এমন প্রেক্ষাপটেই বারকিনা ফাসোর মিলিটারি শাসক ইব্রাহিম ট্রায়োরের নাম উঠছে বারবার। সোশ্যাল মিডিয়ায় ঘুরছে তাঁকে নিয়ে অসংখ্য সব ভিডিও। যেখানে ট্রায়োরে কতটা মহান দেখানো হচ্ছে। তাঁর মহানুভবতার গল্প ছড়িয়ে পড়েছে বিভিন্ন প্রান্তে। বিদেশি এয়ার হোস্টেস তাঁর চেহারা দেখে ব্যঙ্গ করছে, অথচ ট্রায়োরে নির্বাক। এতটাই নাকি মহানুভব ও ক্ষমাশীল।
একটু খোঁজ করলেই দেখা যাচ্ছে, অধিকাংশ ভিডিও এআই দিয়ে তৈরি। কোনটা সত্যি, কোনটা ফেক- খুঁজে বের করা কঠিন। এমনও ভিডিও পাবেন, যেখানে জাস্টিন বিবের, রিহানা, বিয়ন্সে গান গাইছেন ট্রায়োরেকে কুর্নিশ করে। কেউ বলছে কবিতা। বিতর্কিত আমেরিকান গায়ক আর কেলি চোখে জল নিয়ে গাইছেন, ‘গড প্রোটেক্ট ইব্রাহিম ট্রায়োরে’। অবশ্যই এআই দিয়ে তৈরি। বিবের, রিহানা, বিয়ন্সেও জীবনে এমন কোনও গান করেননি।
ট্রায়োরের বয়স মাত্র ৩৭। তিনি যে সোশ্যাল মিডিয়াকে ব্যবহার করে জনপ্রিয়তা বাড়ানোর সুবিধে নেবেন, তা জানা কথাই। সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে তিনি যখন ক্ষমতা দখল করেন, তাঁকে কেউই চিনত না দেশে। এখন একটি ভাষণ সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়ার পর আমূল বদলে গিয়েছে ছবি। সেখানে তিনি যে বক্তব্য রেখেছেন, তা কে লিখে দিয়েছেন, প্রশ্ন আছে। প্রশ্ন নেই একটা ব্যাপার নিয়ে। ভাষণের আবেদন ছিল মারাত্মক। অবধারিতভাবে কোনও বিখ্যাত লেখক লিখে দিয়েছেন।
ক্ষমতায় আসার পরই তিনি বুঝিয়ে দিয়েছিলেন, এতদিন এলাকার দাদা ফ্রান্সকে মানতে রাজি নন আর। ফ্রান্সকে তাড়িয়ে রাশিয়ার দিকে ঝুঁকতে চান। সেই পুরোনো সোভিয়েত ইউনিয়ন নেই, রাশিয়াকেও ঠিক কমিউনিস্ট দেশ বলা কঠিন। তবু পুতিনের কথামতোই চলছেন ট্রায়োরে। আর্থিক নীতি অনেকটাই বামঘেঁষা। বারকিনা ফাসোর খনিজ দ্রব্য প্রচুর। সোনার খনিই অনেক। এতদিন ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, অস্ট্রেলিয়ার মালিক ছিল সোনার খনির। বারকিনা ফাসোর প্রেসিডেন্ট সব চুক্তি বাতিল করে সরকারের হাতে নিয়ে নিয়েছেন সব স্বর্ণভাণ্ডার।
২০২৩ সালে তিনি রাশিয়া-আফ্রিকা সম্মেলনে অধিকাংশ আফ্রিকান নেতার সামনে বলেছিলেন, ‘পুতুলদের মতো আচরণ বন্ধ করুন। যে পুতুলগুলো নাচে শুধু সাম্রাজ্যবাদের দালালরা দড়ি ধরে টানাটানি শুরু করলে।’
ওই একটা ভাষণ থেকে স্পষ্ট, তিনি শুধু বারকিনা ফাসো নন, পুরো আফ্রিকা মহাদেশের নেতা হিসেবে নিজেকে তুলে ধরতে চান। রাশিয়ান মিডিয়াও তাঁকে দারুণ প্রচার দিয়েছিল সে সময়।
বারকিনা ফাসোতে অতীতে টমাস সাঙ্কারা নামে এক কিংবদন্তি কমিউনিস্ট নেতা ছিলেন। লোকে তাঁকে বলত ‘আফ্রিকার চে গেভারা।’ ইতিমধ্যেই সাঙ্কারার সঙ্গে ট্রায়োরের তুলনা শুরু হয়ে গিয়েছে। অনেকে বলছেন, ওই সাঙ্কারা কি আবার ফিরে এলেন? ট্রায়োরে যেভাবে উঠে এসেছেন, সেই সামরিক অভ্যুত্থানে উঠে এসেছিলেন সাঙ্কারা। তখন তিনি ৩৩। চার বছর আর একটি অভ্যুত্থানে সাঙ্কারা নিহত হন।
একটা সময় আফ্রিকান মহাদেশে এমন কিছু মুখ ছিল, যাঁদের প্রভাব বিশ্ব রাজনীতিতে দারুণ ছিল। অতি পরিচিত ছিলেন তাঁরা। লাইবিরিয়ার আয়রন লেডি এলেন জনসন সারলিফ, দক্ষিণ আফ্রিকার নেলসন ম্যান্ডেলা, ইথিওপিয়ার হাইলে সেলাসি, জিম্বাবোয়ের রবার্ট মুগাবে, জাম্বিয়ার কেনেথ কাউন্ডা, কেনিয়ার জোমো কেনিয়াট্টা, মিশরের মুবারক, সাদাত ও আসাদ, ঘানার কোফি আন্নান, কঙ্গোর প্যাট্রিস লুলুম্বা, তাঞ্জানিয়ার জুলিয়াস নায়ারে, সেনেগলের লিওপোল্ড সেনঘর।
তাঁরা ক্রমশ অস্তমিত হওয়ার পর দিকচক্রবালের পুরোটা জুড়ে শূন্যতা।
সেই জায়গাটা নিতে মরিয়া ট্রায়োরে। তিনি সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট করেন দুটো ভাষায়। ফরাসি ও ইংরেজি। সেখানে মুণ্ডুপাত হয় ইউরোপিয়ানদের। কথাগুলো খুব দ্রুত স্পর্শ করেছে তরুণ প্রজন্মের আফ্রিকানদের। সেসব দেশে এখনও বর্ণবৈষম্য, ক্রীতদাস প্রথা শেষ হয়ে যায়নি। কারও কাছে ট্রায়োরে হয়ে উঠেছেন ‘সেন্ট ট্রায়োরে’।
সন্ন্যাসী ট্রায়োরে? অথচ কথাবার্তায় কমিউনিজমের ছাপ! এই যে বিপ্লব, তার মধ্যে কোথাও লুকিয়ে থাকে একনায়কতন্ত্রের পদধ্বনি। আমাদের দেশ বা রাজ্যের বর্তমান ও অতীতে চোখ রাখলে তা স্পষ্ট হবে আরও। বিশেষ করে কারও নাম না করলেও চলে।
বিশ্বজুড়ে স্বাধীনতার একটা মানচিত্র প্রকাশিত হয় প্রতিবার। তাতে দেশগুলোকে তিনভাগে ভাগ করা হয়। পুরোপুরি স্বাধীন। আংশিক স্বাধীন। পরাধীন। বেগুনি রং দিয়ে পরাধীন দেশগুলোকে চিহ্নিত করা হয়। হলুদ রং দিয়ে আংশিক স্বাধীন দেশকে। সবুজ মানে পুরোপুরি স্বাধীন। আমরা ইদানীং প্রতিবারই থাকি হলুদ রংয়ের ছায়ায়। এখানে শুধু চিন, রাশিয়া বা উত্তর কোরিয়া নয়, আফ্রিকার অধিকাংশ দেশকে দেখানো হচ্ছে পরাধীন হিসেবে। বাকস্বাধীনতা নেই। স্বাধীন বলতে আফ্রিকায় দেখানো হয়েছে শুধু দক্ষিণ আফ্রিকা, নামিবিয়া, বৎসোয়ানা, সেনেগল ও ঘানাকে।
দুটো জিনিসকে সূচক ধরা হয়েছে স্বাধীনতা মাপতে গিয়ে। গ্লোবাল ফ্রিডম ও ইন্টারনেট ফ্রিডম। ভারতে জরুরি অবস্থার পঞ্চাশ বছর উপলক্ষ্যে নানা রকম দিবস পালন করছে মোদি সরকার। বলা হচ্ছে, স্বাধীনতার আর একবার মৃত্যু হয়েছে। সবই ভোটের কথা ভেবে। এখানে জানিয়ে রাখা ভালো, এই মুহূর্তে গ্লোবাল ফ্রিডমে ভারতকে দেওয়া হয়েছে ১০০-তে ৬৩, ইন্টারনেট ফ্রিডমে আরও কম- ১০০-তে ৫০। তাই আমরা আংশিক স্বাধীনের দলে। বাংলাদেশও তাই। তাদের নম্বর সেখানে ৪৫ ও ৪০। পাকিস্তান ৩২ ও ২৭। ইন্টারনেটের প্রেক্ষাপটে তারা পরাধীন।
এই যে বারকিনা ফাসোর ট্রায়োরে এত কথা বলছেন, সেখানে ইন্টারনেট ফ্রিডম বলতে কিছু নেই। গ্লোবাল ফ্রিডমেও তারা পরাধীনদের দলে। ১০০-র মধ্যে মাত্র ২৫। অথচ কী মজা দেখুন, ট্রায়োরেকে নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় যে হাইপ তৈরি করা হচ্ছে, তার প্রধান অস্ত্র ইন্টারনেট। উত্তর কোরিয়ার একনায়ক কিম জং উনও নিজেকে এভাবে বিশ্ব চরাচরে নিজেকে তুলে ধরতে পারেননি। অথচ তিনি ১৩ বছর ধরে ক্ষমতায়।
স্বাধীনতার সূচকে যে দেশগুলোকে পরাধীন দেখানো হচ্ছে, তার অধিকাংশতেই একনায়কদের জঙ্গল। আমরা ভাগ্যবান, এই পরিস্থিতি ভারতে অন্তত সরকারিভাবে নেই। আবার এটাও সত্যি, জরুরি অবস্থার ৫০ বছর পরেও আমরা বিশ্বের বিচারে পূর্ণ স্বাধীন হতে পারলাম না। আংশিক স্বাধীনদের মধ্যে পড়ে রয়েছি আজও। বাক স্বাধীনতা নিয়েও প্রশ্ন আছে।
জয়প্রকাশ নারায়ণ, মোরারজি দেশাই, জর্জ ফার্নান্ডেজের মতো নেতারা কি এমন স্বাধীনতা চেয়েছিলেন? জরুরি অবস্থার অজস্র খারাপ দিকের মধ্যে একটা ভালো দিক ছিল, সরকারি অফিসগুলো ঠিকঠাক সময়ে চলত। সময়ে চলত ট্রেন। ঘুষ নেওয়ার লোক কমে স্রেফ ভয়ে। আজ ওই ব্যবস্থাগুলোর আদৌ উন্নতি হয়েছে কি? ট্রায়োরের বয়সি তরুণ নেতারাই বা সর্বভারতীয় স্তরে উঠছেন কই?
অবশ্য ট্রায়োরে সামরিক অভ্যুত্থানে ক্ষমতায় আসার পর প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, ২০২৪ সালের জুলাইয়ের মধ্যে নির্বাচন হবে দেশে। সব প্রতিশ্রুতি জলে। দেশের তেমন উন্নতি হয়নি। ফ্রান্সকে দূরে সরিয়ে তিনি যে এখন রাশিয়া-তুরস্ক শিবিরে খোলাখুলি চলে গেলেন, তারা কেউই ধোয়া তুলসীপাতা নয়। বলা হচ্ছে, ট্রায়োরের ভালো যোগ রয়েছে রাশিয়ার বহু আলোচিত প্রাইভেট মিলিটারি সংস্থা ওয়াগনারের সঙ্গে।
ট্রায়োরে প্রথমে ছিলেন নীচুতলার মিলিটারি অফিসার। তাঁর উত্থান রকেটের গতিতে। সংবাদ সংস্থা রয়টার্সের একটি খবর হতচকিত করে দিয়ে যায়। অভ্যুত্থানের পর তিনি যখন রাজধানীওয়াগাডুগুতে ঢুকছেন, সে সময় যে জনতা তাঁর দিকে জাতীয় পতাকা দেখাচ্ছিল, তাদের অনেকের হাতেই ছিল রাশিয়ান পতাকা তারপর থেকে আলোচনা প্রবল, বর্তমান আফ্রিকার সবচেয়ে আলোচিত প্রেসিডেন্টের ক্ষমতায় আসার পিছনে রাশিয়ার হাত রয়েছে কি না।
অবশ্যই এই মুহূর্তে ৩৭ বছরের প্রেসিডেন্টকে নিয়ে বিশ্ব দুই ভাগ। একদল তাঁকে চে গেভারার মতো আইকন হিসেবে দেখাচ্ছেন। একদল বলছেন, প্রচারপ্রিয় বলিয়ে কইয়ে ধান্দাবাজ। ট্রায়োরে বুদ্ধি করে দেশের তরুণ প্রজন্মকে নিয়মিত বোঝাচ্ছেন, বৃদ্ধদের ক্ষমতা থেকে সরিয়ে তরুণদের শীর্ষে আনাই তাঁর লক্ষ্য। ক’দিন আগে দেশের কয়েকশো নাগরিককে খুন করে ট্রায়োরের সরকার ও জিহাদিরা মিলে। ট্রায়োরের বিরুদ্ধে আরও অভিযোগ ঝুলছে- তিনি নাকি সোনার খনিগুলো বিদেশিদের হাত থেকে কেড়ে নিজেই পকেট ভরছেন। সব আমাগো দেশের গল্প হয়ে যায়।
কেউ কেউ আবার গদি পেলে ছাড়তে চান না। ক্যামেরুনের প্রেসিডেন্ট পল বিয়া ৪৩ বছর নট নড়নচড়ন। আগের সাত বছর প্রধানমন্ত্রিত্ব ধরলে শাসনকাল ৫০ বছর। ইকোয়েটেরিয়াল গিনির প্রেসিডেন্ট এমবাসোগো ৪৩ বছর ধরে এক পদে। এই যে ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আলি খামেনেই ১৯৮৯ থেকে পদে। আফ্রিকায় কঙ্গো, উগান্ডা, এরিট্রিয়া- সব দেশেই মিলিটারিরা ক্ষমতায় এসে আর যান না।
আসলে একনায়কতন্ত্র ও গণতন্ত্রের মধ্যে একটা অতিসূক্ষ ফারাক রয়েছে। সেটাই কখনও এক হয়ে যায় সবার অজান্তে। বহু মৃত রাষ্ট্রনায়কের জীবন তা বলে দিয়ে গিয়েছে, বহু রাষ্ট্রনায়ক জীবন দিয়ে তা দেখাচ্ছেন আজও। আমি, আপনি ও আপনারা সবাই তাঁদের নাম শুনেছি। চিনি। কখনও বন্দনা করি, কখনও ভাসিয়ে দিই সমালোচনার তিস্তা-তোর্ষা-মহানন্দায়।