প্রসেনজিৎ দাশগুপ্ত, নয়াদিল্লি: ভারতের নতুন সংসদ ভবনে স্থিত ‘অখণ্ড ভারত’ ম্যুরাল বিতর্কে জল মেপে চলতে চাইছে ঢাকা। এই বিষয়ে তড়িঘড়ি কোনও প্রতিক্রিয়া দিতেও চাইছে না বাংলাদেশ৷ প্রত্যাশিত ভাবেই ‘অখণ্ড ভারত’ বিতর্কের আঁচ এসে পৌঁছেছে ‘বক্সীগঞ্জে পদ্মাপারে’ও, নেপাল ও পাকিস্তানের মতই বাংলাদেশের প্রধান বিরোধী শিবির বেগম খালেদা জিয়ার বিএনপি (বাংলাদেশ ন্যাশনাল পার্টি) এর কিছু প্রভাবশালী নেতারা এই বিষয়ে আস্তিন গুটিয়েছেন, তবুও পরিস্থিতি নিরিখে এ ইস্যুতে কোনও রকম পরিকল্পনাহীন মন্তব্য বা অবস্থান নেওয়া থেকে দূরত্ব বজায় রাখতে চায় বাংলাদেশ, বিশ্বস্ত সূত্রে জানা গেছে এমনই তথ্য।
মোদী সরকার নির্মিত নতুন সংসদ ভবনের ম্যুরালের মাধ্যমে ‘অখণ্ড ভারতের’ এক মানচিত্র ফুটিয়ে তোলা হয়েছে যা নিয়ে বিতর্ক তুঙ্গে। কেন্দ্রীয় সরকারের মস্তিষ্ক প্রসূত সেই ‘অখণ্ড ভারতে’র মধ্যে রয়েছে আফগানিস্তান, পাকিস্তান, নেপাল, বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা ও মায়ানমার। নেপালের প্রধানমন্ত্রী পুষ্পকুমার দহলের (প্রচণ্ড) সাম্প্রতিক ভারত সফরের সময় এই ম্যুরাল নেপালের রাজনীতিতে ঝড় তুলেছে। একই ঝড় লক্ষ্য করা গেছে পাকিস্তানেও। ভবিষ্যতে এ বিতর্ক ভারতের অন্য প্রতিবেশী দেশগুলোতেও বড় হয়ে দেখা দিতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে বিশেষজ্ঞ মহলের একাংশে।
এ ক্ষেত্রে উল্লেখ্য, ম্যুরাল নিয়ে ইতিমধ্যে বিতর্ক উস্কে গেছে ভারতের নিকটতম প্রতিবেশী রাষ্ট্র- বাংলাদেশেও। নেপাল প্রধানমন্ত্রীর সফরের মধ্যেই বাংলাদেশেও, বিশেষ করে বিরোধী শিবিরে এই প্রসঙ্গে দেখা দিয়েছে উত্তেজনা। সূত্রের দাবি, খালেদা জিয়ার বিএনপি’এর কিছু নেতা এই নিয়ে ইতিমধ্যে ভারতের উদ্দেশ্যে বাছা বাছা বিশেষণ প্রয়োগ করেছেন। অভিযোগের আঙুল উঠেছে ‘ভারতদরদী’ শেখ হাসিনা সরকারের ‘মুখে কুলুপে’র উদ্দেশ্যেও, কারণ সংশ্লিষ্ট মানচিত্রে উল্লেখ না থাকলেও খুলনা, সিলেট, যশোর, রাজশাহীর মতো অঞ্চল তাতে অন্তর্ভুক্ত যা সহজেই অনুমেয়। সে ক্ষেত্রে হাসিনা সরকার কেন ‘নির্বাক’, মোদী সরকারের কেন মানচিত্র নিয়ে ‘অতিরঞ্জিতকরণ’; সে নিয়েও উঠেছে প্রশ্ন। বলাবাহুল্য এহেন পরিস্থিতিতে চাপে পড়েছে হাসিনা সরকার। অথচ পরিস্থিতি নিরিখে এ মুহূর্তে কোনও গঠনমূলক কূটনৈতিক অবস্থান নিতেও অপারগ বাংলাদেশ।
এই অপারগতা নিয়ে মুখ খুলেছে নয়াদিল্লিস্থিত বাংলাদেশ হাই কমিশন৷ নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক হাই কমিশনের এক উচ্চপদস্থ আধিকারিক জানিয়েছেন, ম্যুরাল বিতর্কে কার্যত উভয় সঙ্কটে পড়েছে বাংলাদেশ। একদিকে বিরোধীদের চাপ, অন্যদিকে বছর শেষে বাংলাদেশে সাধারণ নির্বাচন, এই দুইয়ের জাঁতাকলের মধ্যে পড়ে হাসিনা সরকারের রীতিমতো হাঁসফাঁস অবস্থা। আধিকারিক জানাচ্ছেন, দিল্লির সঙ্গে বরাবর ‘সুসম্পর্ক’ ঢাকার। দুই দেশের দ্বিপাক্ষিক কূটনৈতিক সম্প্রীতির আবহে সম্প্রতি ভারত থেকে লোকো ইঞ্জিন প্রেরণ বা নেপাল প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরকালে প্রস্তাবিত নেপাল থেকে ভারত হয়ে বাংলাদেশে বিদ্যুৎ সরবরাহের মত একাধিক গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পের ‘নীল নকশা’ নির্মীয়মান। তাছাড়া ডিসেম্বরে সাধারণ নির্বাচনের আগে নরেন্দ্র মোদী সরকারের থেকে আরও কিছু জনমুখী পরিকল্পনা পাওয়ার প্রত্যাশী বাংলাদেশ, তিস্তা চুক্তি যার অন্যতম। এই মুহূর্তে তাই এমন কোনও পদক্ষেপ গ্রহণে যদি দিল্লি বিরাগভাজন হয়, সেক্ষেত্রে সমস্যা বাড়তে পারে হাসিনা সরকারের৷ তা-ই ম্যুরাল বিতর্কে সব দিক রক্ষা করে হাসিনা সরকারের ‘নিরপেক্ষ’ সরকারি অবস্থান কী হওয়া উচিৎ সে নিয়ে চলছে চুলচেরা বিশ্লেষণ।
তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে জরিপ কদা হচ্ছে এমন কোনও পদক্ষেপ যাতে ‘শ্যাম ও কূল’ দুই রাখা যায়, সে নিয়েই শীর্ষস্তরে চলছে তুমুল ভাবনাচিন্তা। তবে কতদিন বিষয়টিকে ভাবনাচিন্তার স্তরে রাখা যাবে, সে নিয়েও বাড়ছে উৎকণ্ঠা। কারণ আজ নয়তো কাল ‘অখণ্ড ভারত’ বিতর্কে নিজ অবস্থান স্পষ্ট করতে হবে ঢাকাকে৷ ‘বিধান ভবন’ও এ নিয়ে তৎপরতা বাড়াচ্ছে, হাসিনার নির্দেশে খুঁজে দেখার চেষ্টা চালানো হচ্ছে কোনও একটি ‘মধ্যবর্তী পন্থা’, যাতে ‘ঘর ও বাহির’ অর্থাৎ বাংলাদেশের রক্ষণশীল তথা উদারমনা সমাজে সদর্থক বার্তা প্রেরণ, একইসাথে ভারতের সঙ্গেও যেন সুসম্পর্কে কোনও ছেদ না পড়ে তা চূড়ান্ত করা। এ মুহূর্তে তেমনই কাঙ্খিত সম্ভাবনা ব্যক্ত করার লক্ষ্যে কাজ করছে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। যোগাযোগ রাখা হচ্ছে দিল্লির সঙ্গেও, দাবি হাই কমিশন সূত্রে।