Thursday, February 13, 2025
Homeরংদার রোববারউপন্যাসঅলীক পাখি (পর্ব-৭)

অলীক পাখি (পর্ব-৭)

  • বিপুল দাস

তপন টের পেল অপমানে তার শরীরজুড়ে আগুনের মতো রক্তস্রোত ছুটে যাচ্ছে। কানফান সব ঝাঁঝাঁ করছে। এই মেয়েটার সঙ্গে সিধুর বিয়ে যদিও বা হয়, সিধুকে নাকেকানে দড়ি পরিয়ে ঘোরাবে। মঞ্জুলার কথার কোনও উত্তর না দিয়ে সোজা গিরিজা বিশ্বাসের বাড়ির দিকে রওনা হল। একবারও পেছনে তাকাল না।

                মঞ্জুলাদের বাড়িতে গিয়ে সে মাত্র দুটি বাক্য বলেছিল। বাড়ির সবাই দেখে যখন পছন্দ করেছে, তার মেয়ে না দেখলেও চলবে। পাকা কথাই হয়ে গেল, তারা আশীর্বাদের দিন ঠিক করতে পারে। ফেরার পথে কোথাও মঞ্জুলাকে দেখতে পেল না। মনে মনে হাসল মুহুরি তপন সামন্ত।

ল’ ক্লার্কস অ্যাসোসিয়েশনের নতুন বিল্ডিংয়ে তার জায়গায় বসে আজকের জরুরি কাগজপত্র সাজিয়ে রাখছিল তপন। উকিলবাবুর আজ দুটো হিয়ারিং আছে। সেগুলোর দরকারি নথি সাজিয়ে অ্যাসিস্ট্যান্ট মকবুলকে বুঝিয়ে দিচ্ছিল। দুজন ক্লায়েন্টকে ফোন করতে হবে। ইদানীং সে জমিজমা রেজিস্ট্রেশনের কাজ ছেড়ে দিয়েছে। এদিকেই কাজের চাপ ভীষণ বেড়ে গেছে। সব উকিলবাবুই পোক্ত মুহুরি চায়। হিয়ারিং বাদে বাকি কাজ তো মুহুরিকেই সামলাতে হয়। সদরের এই কোর্টে উকিল আর মুহুরির কমতি নেই। কত উকিলের কালো কোটের বোতাম ছিঁড়ে গেছে। কোটের রং ধূলিধূসর হয়ে গেছে। বারে একটা চেয়ারে বসে খবরের কাগজ মুখস্থ করে। কেউ দেশলাই কাঠি দিয়ে দাঁত খুঁচিয়ে দুরূহ কোণ থেকে সুপুরির কুচি বের করতেই থু থু করে ছেটায়। চেয়ারের চারপাশে মোজাইকের দানার মতো ছড়িয়ে থাকে। দৈবাৎ ব্রিফ পায়। কোর্ট চত্বরের রসিক লোকজন এদের নানারকম নাম দেয়। ঘিয়েভাজা উকিল বললে নন্দভূষণ দাস। কোকিল মানে বিধু উকিল। আষাঢ়ের মেঘের মতো তার বর্ণ। এদিকে গলার আওয়াজ যেন পঞ্চমে খেলে যায়।

                রেজিস্টার্ড ল’ ক্লার্ক হিসেবে তপন বেশ ওজনদার মুহুরি। তপন জানে তার হাতের আংটি নয়, বাস্তববুদ্ধি, ঠিকঠাক কথা বলতে পারা, মানুষ চিনতে পারা, এমনকি উকিলদের মনের কথা বুঝতে পারা হল আসল গ্রহরত্ন। মাসমাইনেয় নয়, তার রোজগার দৈনিকের উপার্জনের হিসেবে গুনতে হয়। কাজের ওপর তার নিষ্ঠা, তার বুদ্ধি, তার পরিশ্রম তাকে এখানে পৌঁছে দিয়েছে। নইলে সদর কোর্টে রেজিস্টার্ড, নন-রেজিস্টার্ড ক্লার্ক কম নেই। কোনও কোনও মুহুরির চারজন পর্যন্ত অ্যাসিস্ট্যান্ট রাখতে হয়। তপন এখন মকবুলকে দিয়ে কাজ চালিয়ে নিচ্ছে, কিন্তু খুব তাড়াতাড়ি তাকে আরও একজন লোক রাখতে হবে।

                মকবুলের এগিয়ে দেওয়া একটা কাগজে সই করার আগে চোখ বুলিয়ে নিচ্ছিল তপন, চোখের কোণ দিয়ে বুঝল কেউ তার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। পড়া থামিয়ে সেদিকে ঘাড় ঘুরিয়ে চমকে উঠল। মঞ্জুলা দাঁড়িয়ে আছে। সাদা সালোয়ারের ওপরে নীল কামিজ। কালো একটা চাদর গায়ে রয়েছে। কানের দু’পাশের চুলগুলো বাদামি। হাতে সানগ্লাস ধরা রয়েছে।

‘এখানে ভালো মিষ্টির দোকান নেই। বসুন, চা বলছি।’

                মাথা ঠান্ডা রেখে বলল তপন। ইশারায় তার সামনের টেবিলটা দেখাল। হাসল মঞ্জুলা। আজ হঠাৎ তপন খেয়াল করল মঞ্জুলার ওপরের পাটির ডানদিকে একটা গজদাঁত আছে। হাসলে দেখা যায়। আগে দেখেছে বলে মনে পড়ল না তপনের।

‘আপনার সঙ্গে একটা ভীষণ জরুরি কথা ছিল। প্রাইভেট। একটু সময় হবে আপনার?’

‘তাই? ভীইইষণ জরুরি? আমি অবশ্য জানতাম আপনি আসবেন। বোঝেনই তো, বিপদে পড়লে মানুষ কোর্টকাছারিতেই আসে। আপনার কি একজন ভালো ল’ইয়ার দরকার? করে দেব, ফিজ বেশি নয়।’

 ‘আমি আপনার সঙ্গে বাজে কথা বলতে আসিনি। অবশ্য প্রতিশোধ নেবার ইচ্ছে থাকলে আপনি আমাকে অপমান করতেই পারেন।’

‘ঠিক আছে, পাঁচ মিনিট। আমারও ভীইইষণ জরুরি কাজ রয়েছে হাতে। বসুন না, জাস্ট পাঁচ মিনিট। মকবুল, নগেনকে বল খুব তাড়াতাড়ি এখানে ম্যাডামকে একটা স্পেশাল চা দিতে।’

‘আপনার জন্য বলব?’

‘উঁহু, এখন চা খেলে অ্যাসিড হয়ে যাবে। তোরা খেলে, খা।’

                ফর্মটা ঠিকঠাক ফিলআপ হয়েছে কি না, দ্রুত চোখ বুলিয়ে দেখে নিচ্ছিল তপন। তারিখের জায়গাটা খালি রয়েছে দেখে মকবুলকে দেখিয়ে দিল। ফর্মটা দেখতে দেখতেই তপন মনে মনে হাসছিল। মঞ্জুলা তার সঙ্গে দেখা করতে চাইবে, এটা অপ্রত্যাশিত নয়। যেদিন ওদের বাড়িতে গিয়ে বিয়ের ব্যাপারে ফাইনাল কথা বলে এসেছে, তারপর থেকেই সে জানত মঞ্জুলা যে কোনও দিন তার সঙ্গে দেখা করার চেষ্টা করবে। ছেলেপক্ষ যাতে বিয়েতে মত না দেয়, সেটার ওপর জোর দেবে। কিছু একটা কারণ বানিয়ে বলতে এ মেয়ের সময় লাগবে না। কিংবা হয়তো গল্প বানিয়েই এসেছে।

‘হ্যাঁ বলুন আপনার প্রাইভেট কথা।’

‘এখানে? এইসব মামলাবাজ মানুষজনের মাঝে? এক মিনিটের জন্য আপনি বাইরে গেলে কি কারও ফাঁসির হুকুম হয়ে যাবে? দুটো কথা বলার ছিল।’

‘বাইরেই কিন্তু মামলাবাজ মানুষ অনেক বেশি। শুধু মামলাবাজ নয়, জমিখোর, দাঙ্গাবাজ, ডিভোর্স চায়, মেয়ে-ফুসলানো, সরি … সব গিজগিজ করছে। চলুন, শুনি আপনার গল্প। বেশিক্ষণ কিন্তু বাইরে থাকতে পারব না। এই টেবিলে প্রতিটি মিনিট আমার কাছে মূল্যবান। তাছাড়া, আমি ভীঈষণ নিয়ম মেনে চলি।’

                ওরা ঘর থেকে বেরিয়ে পুরোনো বিল্ডিং-এর পাশে বড় পাকুড়তলায় এসে দাঁড়িয়ে ছিল। এখানে গাছের নীচে একটা টেবিল, সামনে একটা চেয়ার, টেবিলের ওপর টাইপরাইটার নিয়ে প্রচুর লোক বসে আছে। পাশে স্ট্যাম্পপেপারের ভেন্ডারদের ঘর। খটখট খটরখট, অবিরাম শব্দ, যেন চত্বরজুড়ে কোনও কারখানা চলছে। কতগুলো চড়াই পাখি উড়ে এসে গাছের ডালে বসছে, কিছুক্ষণ কিচিরমিচির করে আবার উড়ে যাচ্ছে। অবাঙালি একটা কালো মতো বৌ, কোলে বাচ্চা, সিঁথিতে কমলা সিঁদুর– পরম ঔদাসীন্যে ব্লাউজ খুলে বাচ্চাটাকে খাওয়াচ্ছে। পাশেই একজন পাশের একজনের সিগারেট থেকে তার বিড়ি ধরিয়ে নিচ্ছে। বাচ্চাটার হাতে একটা হলদে হ্যান্ডবিল। ঠ্যালাগাড়ির চা-দোকানের উলটোদিকে মাটিতে বিছানো লাল কাপড়ের ওপর মরা গোসাপ, সাপের মতো গাছের শেকড়, অদ্ভুত আকারের অনেকগুলো শঙ্খ, রুদ্রাক্ষের মালা, ধনেশ পাখির ঠোঁট সাজানো। তার সামনে অনেক তেলের শিশি। ওরা বলে যে, ওগুলো বাঘের তেল। আরও জানা যায় যে, হর ইনসানের ভেতরেই একটা শের থাকে। কিন্তু সাধারণত ঘুমিয়ে থাকে। এই তেল ব্যবহার করলে সেই নিন্দ টুটে যাবে। তারপর খেল জমে যাবে। শরীরজুড়ে বাঘ ডেকে উঠবে হালুম করে। সেখানে কিছু কিছু মধ্যবয়সি মানুষের ভিড়। নীলবাতি লাগানো একটা গাড়ি ঢুকল। সামনের সিটে পুলিশ বসে আছে। কোথা থেকে যেন অ্যামোনিয়ার তীব্র ঝাঁঝালো গন্ধ আসছে। খয়েরি সাফারি-স্যুট পরা একটা লোক তপনকে বলল– গুড মর্নিং দাদা। তপনও বলল– গুড মর্নিং। ডেট আছে নাকি?

                পাকুড়তলাতেই একটু ফাঁকায় এসে মঞ্জুলা দাঁড়াল। ওরা এতক্ষণ পাশাপাশি হাঁটছিল। এখন মঞ্জুলার মুখোমুখি হয়ে তপনও দাঁড়াল। চোখ থেকে সানগ্লাস খুলে তপনের দিকে তাকাল মঞ্জুলা। তপনের মনে হল আয়ত চোখ দুটোয় একটু ক্লান্তির ভাব রয়েছে। রাতে ঘুম না হলে পরদিন এরকম দেখায়। মনে হয় যেন হালকা কাজলরেখা রয়েছে চোখের পাতায়।

‘বলুন, কীসের জরুরি কথা আপনার। ইয়ে, কিছু মনে করবেন না, আপনাকে খুব টায়ার্ড দেখাচ্ছে।’

 ‘আপনি কেন এই বিয়ে ফাইনাল করে এসেছেন? আপনি তো এত বোকা নন যে, বিয়েতে আমার অমত আছে– সেটা বুঝতে পারেননি। প্লিজ, আপনাকে হাত জোড় করে বলছি, এটা ক্যানসেল করুন।’

                চমকে মঞ্জুলার মুখের দিকে তাকাল তপন। সে ভেবেছিল আবার কোনও নতুন কৌশলে তার ওপরে নিষ্ঠুর আঘাত করবে মেয়েটা। হাতজোড় করার কথা শুনে অবাক হল। এটাও নতুন কোনও কায়দা কি না, কে জানে।

 ‘হাত জোড় করে বলার দরকার নেই। ব্যাপারটা একটু ক্লিয়ার করবেন। আপনাকে তো দশমহাবিদ্যা মনে হচ্ছে। এই ছিন্নমস্তা তো, এই কমলা।’

‘এই বিয়ে সম্ভব নয়। আপনি বুঝতে পারছেন না, কী করে আপনাকে বোঝাব … আচ্ছা, ঠিক আছে, আমি আপনার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করেছি, তার জন্য আমি দুঃখিত। প্লিজ, আপনাদের দিক থেকে অপছন্দের কথা জানিয়ে দিন।’

                সামান্য বাতাস উঠল। নোটারি ক্লার্ক লেখা একটা টেবিলের সামনে একটা শুকনো খয়েরি পাতা একটু নাচল। মঞ্জুলার কানের পাশের বাদামি চুল উড়ল একটু। তপন সরাসরি মঞ্জুলার চোখের দিকে তাকাল। কৌতুক বা ঔদ্ধত্য নয়, মিনতি রয়েছে ওর চোখে।

‘দেখুন, এখানে আমার কী করার আছে। কথায় আছে– জন্ম মৃত্যু বিয়ে, তিন বিধাতা নিয়ে। বিধাতা যার সঙ্গে যার গিঁট দিয়ে রেখেছেন, আমি আপনি কি আর সেটা ভাঙতে পারব।’

‘শুনুন, আরও অনেক কিছুই বিধাতা মানুষের কপালে লিখে দেন। আমার কপালেও কিছু লেখা আছে। আপনি বাইরের লোক, কী করে জানবেন। শুধু শুনে রাখুন এ বিয়ে আমি করব না। সম্ভব নয়।’

‘আপনার কি আমার ভাইকে পছন্দ হয়নি? ইয়ে, মানে আমি বাইরের লোক, জানতে চাওয়া উচিত নয়, আপনার কি নিজস্ব পছন্দের কোনও মানুষ রয়েছে?’

                মাথা নীচু করল মঞ্জুলা। তপন বুঝল সে ঠিকই আন্দাজ করেছিল। মঞ্জুলার কোনও গোপন প্রেমিক আছে। মুখ তুললে তপন অবাক হয়ে দেখল মঞ্জুলার দুটি চোখের কোণে দু’ফোঁটা জল জমে আছে। কী আশ্চর্য সুন্দর দেখাচ্ছে মঞ্জুলাকে। ধূমাবতী মঞ্জুলাকে সে দেখেছে, কিন্তু এই অশ্রুমতীকে সে প্রথম দেখল। রুমাল দিয়ে সাবধানে চোখ মুছল মঞ্জুলা। আশপাশে দেখল তপন। কেউ যদি লক্ষ করে তপন সামন্তর সামনে একজন সুন্দরী মহিলা কাঁদছে, তবে কোর্ট চত্বরে গল্প ছড়াতে সময় লাগবে না।

‘সরি মঞ্জুলা, আমি বোধহয় কোথাও আঘাত দিয়ে ফেলেছি। কিছু মনে কোরো না। সরি, তুমি বলে ফেললাম।’

‘ঠিক আছে। আপনি তো আমার ভাশুরঠাকুর হতেই পারতেন। আমি বোধহয় আপনার দেরি করিয়ে দিচ্ছি। এখানে তো সময় মানেই পয়সা। আপনার বোধহয় অনেক লস করিয়ে দিলাম।’

‘ঠিকই বলেছ। এখানে কথা বললেই পয়সার আনাগোনা। তুমি কারও কাছে জানতে চাও টয়লেট কোনদিকে, প্রথমেই তোমার কাছে হাত পাতবে। দুটো টাকা ছুড়ে দাও, তারপর দেখিয়ে দেবে।’

                হেসে ফেলেছে মঞ্জুলা। তপনের বুকের ভেতরে ধুকপুক করে উঠল। মঞ্জুলার নিখুঁত দাঁতের সারির মাঝে ছন্দ ভেঙে দেওয়া একটা গজদাঁত উঁকি দিল। কে জানে কেন, সুষম বিন্যাসের মাঝে এই ছন্দপতনে ভয় করে ওঠে। মনে হয় কেউ কোথাও সর্বনাশ করবে বলে অপেক্ষা করে আছে। এখনও তার চোখ অল্প ভেজা রয়েছে, অথচ কৌতুকে তার চোখমুখ উজ্জ্বল। তপনের মনে হল ঘন মেঘের আড়াল ভেঙে এক টুকরো চাঁদ বেরিয়ে এসেছে।

‘না দাদা, আপনার ভাইকে পছন্দ-অপছন্দের কোনও প্রশ্ন নেই। আমার কোনও লাভারও নেই।’

‘তবে?’

‘আজ আর আপনাকে দেরি করাব না। সেকথা শোনার জন্য আপনি কি আর একদিন আমাকে সময় দিতে পারবেন। এ রকম পাবলিকের মাঝে নয়, একটু নিরিবিলি জায়গা হলে ভালো হয়। আপত্তি না থাকলে আপনার ফোন নাম্বারটা আমায় দেবেন? পরে আপনার সঙ্গে কথা বলে নেব। কোথাও একটু বসে কিছু বলব আপনাকে। সব শুনলেই আপনি বুঝতে পারবেন। আপনাকে বোঝাতে না পারলে আপনার একটা মিথ্যে ধারণা থেকে যাবে। আপনার সঙ্গে খারাপ বিহেভ করার জন্য আমি আবার মাফ চাইছি। সব অপমান আপনি আমাকে আরও কঠিন করে ফিরিয়ে দিন। আমার আর কোনও উপায় ছিল না। আপনি বিয়ে ফাইনাল করে ফেললেন কেন? কেন করলেন? সংসারের কেউ কি আমার প্রবলেমটা বুঝতে পারবে না।’

                তপন স্পষ্ট বুঝতে পারল, মঞ্জুলার ‘কেন করলেন’ প্রশ্নে কোনও চ্যালেঞ্জ নেই। ভেঙে যাওয়ার শব্দ রয়েছে, গোপন কান্না রয়েছে।

দশ

                সাবিরভাই বলেছিল সাহায্য করবে। জায়গা খুঁজে দিয়েছিল কামাল। নইলে আমার একার ক্ষমতা ছিল ওই এরিয়ায় দোকান ভাড়া নেওয়ার। মার্বেল পাথরের ব্যবসার খুঁটিনাটি সব শিখে নিয়েছিলাম। সাবিরের দোকানে কম দিন তো হল না। অত বড় ব্যবসা সামলানোর ব্যাপারে আমাকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিতে শুরু করেছিল সাবির। পুরোনো স্টাফদের ভেতরে মুর্শেদের ব্যাপারটা পছন্দ হচ্ছিল না। তার পছন্দ না হওয়া আমি বুঝতে পারতাম। মুর্শেদের দু’নম্বরি স্বভাব ছিল। টাকাপয়সার ব্যাপারে সাবির আমাকেই বেশি দায়িত্ব দিতে শুরু করেছিল। তখন থেকেই গুরুপদ আমার নামে সাবিরের কাছে ফালতু কমপ্লেন করতে শুরু করে।  মালের ঘোরে একদিন কামালকে বলেও ফেলেছিলাম। তারপর একদিন সাবিরকে কাজ ছেড়ে দেবার কথা বললে সাবিরই আমাকে নিজের দোকান খোলার কথা বলেছিল। এমনকি, ধারে মাল দেবে বলেছিল। পরে শোধ দিলেও হবে। আমাদের বসিরহাটের জমির একটা অংশ বিক্রি করে দিয়েছিলাম। নইলে ইনভেস্টমেন্টের অত টাকা কোথায় পাব।

‘দোকানের নাম কী রাখবি, ভেবেছিস কিছু?’ আনন্দ একদিন জিজ্ঞেস করল।

‘সে যা হয় একটা দিলেই হবে। দারুণ একটা নাম দিলেই কি দারুণ সেল হবে। নামে কিস্যু আসে যায় না। ধর, নাম দিলাম মর্মরবাণী। মর্মর মানে জানিস তো, মার্বেল। শ্বেতপাথর, কালোপাথর, গ্র্যানাইট, বেলেপাথর। তো নাম মর্মরবাণী দিলে বিক্রি কি হুহু করে হবে? বরং অনেকে মনে করবে বাণীকে মরতে বলা হচ্ছে।  বরং তুই একটা নাম বল না।’

‘তোর বৌ থাকলে বলতাম, বৌয়ের নামে নাম রাখতে। বেশির ভাগই তো তাই করে। মালতী ট্রেডার্স, স্বপ্নাকুটির, মালা ভ্যারাইটি স্টোর্স। বৌও খুশি হয়, কাজও চলে।’

‘যাদের বৌ নেই, তারা কী করে বলত। বন্ধুর বৌয়ের নাম কি চলবে?’

‘হুঁ, দীপা মার্বেল হাউস। মন্দ হয় না। এক কাজ কর না, তোর বিজনেসে দীপাকেও পার্টনার করে নে। তোরা মিলেমিশে ব্যবসা করবি, আমি মাঝের থেকে ক্ষীর খাব।’

                আনন্দর সঙ্গে যোগাযোগ হওয়ার পর অনেকবার ওর বাড়িতে আসা-যাওয়া হয়েছে আমার। বাইরেও বেশ ক’বার বসেছি। নিজের ব্যবসার দিকে আনন্দ খুব মনোযোগী। সেখানে কোনও রকম ফাঁকি দিত না। আস্তে আস্তে ব্যবসা বাড়ছিল ওর। আমিও কিছু বড় পার্টি দিতাম ওকে। পার্টিরা পছন্দ করত ওকে। তাদের সোর্সে আবার নতুন কাজ পেত। আমার থ্রু দিয়ে কোনও বড় কাজ পেলেই ওর বাড়িতে আমার নেমন্তন্ন ছিল বাঁধা। সেদিনগুলোতে আনন্দর অতিরিক্ত ড্রিংক্স নেওয়া দীপা অ্যালাউ করত। তারপর আনন্দ নাক ডাকতে শুরু করলেই ক্রমশ মোহিনী হয়ে উঠত দীপা। আমরা গল্প করতাম। আগ্নেয় শিলা, পাললিক শিলার গল্প। বহু যুগ ধরে মাটির নীচে তাপ আর চাপে পালটে যেতে থাকে। কখনও কালো স্লেট পাথর, কখনও সাদা মার্বেল পাথর। বলতাম কীভাবে বিভিন্ন খনিজ মিশে গিয়ে নীল, ধূসর, গোলাপি, হলুদ, সবুজ মার্বেল তৈরি হয়। ওকে ইতালিয়ান মার্বেলের তৈরি প্রাচীন মূর্তিগুলো দেখাতাম। ওর ঘন নিঃশ্বাসের গরম আমার মুখে পড়ত। আমি শুধু ওর গভীর দিঘির মতো দুটো চোখের পাতার ওপর আলতো করে চুমু দিতাম। ব্যাস, আর কিছু নয়। সত্যি বলতে কী, দীপার শরীরের জন্য আমি কখনও কাতর হয়ে পড়িনি। দীপা আমার পাশে বসে আছে, হয়তো কখনও ছোঁয়াছুঁয়ি হচ্ছে, দীপার একরকম নীরব প্রশ্রয় রয়েছে এবং আমরা এটা আনন্দর ঘুমের সুযোগ নিয়ে লুকিয়ে করছি- এই ব্যাপারটাতেই আমার উত্তেজনা হত। আমি জানি, আমার ভেতরে একটা তীব্র ছোটলোক আনন্দকে আরও ছোট করে দেবার আনন্দ উপভোগ করত।

                আমি বুঝতে পারছিলাম না, আমার বুকের গভীরে কোথাও কোনও পাথরের ক্রমশ মেটামরফোসিস হচ্ছে কি না। অনেক তাপে ও চাপে কোনও শিলা রূপান্তরিত হচ্ছে কি না। কিন্তু দীপা আমার কাছে ক্রমশ আরও রহস্যময়ী হয়ে উঠছিল। কখনও মনে হত দীপা নিতান্তই এক সাধারণ মেয়ে। আমার দিকে তাকাতে হলে ওকে অনেকটাই মাথা ওপরে তুলতে হবে। অনেক উঁচু থেকে আমি ওর দিকে তাকালেই দীপা ধন্য হয়ে যাবে। হতে পারে দীপা ভালোই গান জানে। হতে পারে দীপার সুন্দর মুখ আর শরীরে বাড়তি স্বাস্থ্যের আয়োজন ভগবান অকৃপণভাবেই দিয়েছেন। যে কোনও পুরুষ তার দিকে মুগ্ধ চোখে তাকাবে। তাতে আমার কী আসে যায়। ও তো আসলে আনন্দর বৌ। আমাদের আশ্রিত ছিল আনন্দ বিশ্বাস। মিথ্যে শান্তিগোপাল হয়ে আমাদের কাছে হিরো হতে চেয়েছিল। সবাই জানত আনন্দ আমার পিসতুতো ভাই। ধুস, বাবার মিথ্যে মিথ্যে বোনের ছেলে। আমার মিথ্যে ভাই। কী দরকার ছিল আনন্দর দীপার মতো মেয়েকে বিয়ে করার।

                আবার কখনও দীপাকে মনে হত থার্মোমিটারের পারার মতো। চকচকে, টেম্পারেচারের সঙ্গে ওঠে, নামে, কিন্তু স্পর্শ করা যায় না। কিংবা কাচপোকার মতো। ময়ূরের পেখমের মতো রংটা চোখ ধাঁধিয়ে দেয়। অবশ আরশোলার মতো আমি দীপার গান শুনি, চা খাই, দীপা উঠে ভেতরের ঘরে গেলে আমার চোখ দুটো নাচার আরশোলার মতো দীপাকে অনুসরণ করে।

                ফাইনালি আমার দোকানের নাম দিলাম ‘রাজমহল মার্বেল হাউস’। হঠাৎ করে অচেনা জায়গায় বাইরের লোকের পক্ষে ব্যবসা খুলে বসা সহজ নয়। নতুন দোকান খুলতে যা যা করার দরকার, যেখানে যাই, শুধু পয়সার খাঁই। সরকারি ট্যাক্স ছাড়াও এত বেসরকারি ট্যাক্স দিতে হবে– ভাবতে পারিনি। পেছনে সাবিরভাই আর কামালের সাপোর্ট ছিল, তবু বেশ রক্তশূন্য হয়ে পড়েছিলাম। লোকাল নেতা থেকে মেল, এক্সপ্রেস, ডেমু, ভিস্টাডোম– সবাইকে ট্যাক্স দিয়ে দোকান চালু করতে হয়েছিল। সাবিরভাইয়ের চেনা একজনকে দোকানে নিতে হয়েছিল, আর কামাল বলেছিল মাল ডেলিভারির জন্য ওর থেকে ‘ছোটা হাতি’ নিতে। বেশ কিছুদিন হল ট্রান্সপোর্টের ব্যবসা শুরু করেছে কামাল। এক বছরের ভেতর একটা থেকে দুটো গাড়ি রাস্তায় নামিয়ে দিয়েছে।

                ভেতরে ভেতরে কীসের যে একটা অস্থিরতা আমাকে সব সময় তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ায়, ঠিক বুঝতে পারি না। আরও স্বাধীনতা পেতে ইচ্ছে করে। বাইপাসের ধারে যত ফাঁকা জমি পড়ে আছে, মনে হয় সব যদি দখল করতে পারতাম। বিশাল বড় বড় হোর্ডিং দিতাম– তিমির মার্বেলস, টনি স্টোনস, তাজমহল মার্বেল হাউস। ভেড়ির জলে ছায়া পড়েছে। একদিন শালা উদয়পুরের রাজনগরের সব পাহাড় আমার হবে। এসব ভাবার সময় আমার শরীরেও একটা উত্তেজনা হয়। দীপার শরীরের কাছে এলে যেমন ফিল করি, তার চেয়েও অনেক বেশি এই উত্তেজনা।

                মাস ছয়েক আগে কামাল এসেছিল। মা ব্রিজের নীচে চার নম্বর পুলের কাছে একটা হার্ডওয়্যারের দোকান পেয়েছে। আমি রাজি থাকলে আমার সঙ্গে পার্টনারশিপে দোকান নেবে। আমি জানতাম আস্তে আস্তে কলকাতার এদিকটায়, তোপসিয়া হয়ে পার্ক সার্কাস পর্যন্ত আমাকে ছড়িয়ে পড়তে হবে। জানি না, কবে তৃপ্তি আসবে আমার।

                অ্যাকসিডেন্টটা হল সেক্টর ফাইভের একদম টেকনোপলিস বিল্ডিং-এর সামনে। নিউ টাউনে ঢোকার আগে যে ফ্লাইওভার রয়েছে, তার আগে বাঁ দিকে সামান্য বাঁক আছে। সেটাও কারণ নয়। আমার নতুন ভারী বাইক নিয়ে এদিকটায় বেশ ক’বার এসেছি আমি। শুধু এদিকেই নয়, নতুন বাইক নিয়ে আমি একদিন টাকি পর্যন্ত গিয়েছি। বহু দিনের শখ ছিল এই বাইকের। দাম যা পড়েছে, একটা শস্তা দামের চারচাকা নিতেই পারতাম। কিন্তু কলকাতার রাস্তায় প্রাণের সুখে চারচাকার অ্যাক্সিলারেটার দাবানো সম্ভব নয়। আর, জোরে চালাতে না পারলে আমার গাড়ি চালিয়ে সুখ হয় না। আসলে ডিভাইডারের গাছগুলো বেশ বড় এখানে। আমার ঠিক সামনে মালঞ্চ লেখা একটা বাস যাচ্ছিল। ভাঙড়ের লাইনের বাস। বাঁ দিকে সামান্য টার্ন নেবার পরই মুহূর্তের জন্য আমার দৃষ্টির আড়ালে ছিল বাসটা। আমি বুঝতেই পারিনি আচমকা ব্রেক মেরে দাঁড়িয়ে গেছে। কিছু বুঝে ওঠার আগেই বাসের পেছনের বাম্পারে প্রচণ্ড জোরে গিয়ে বাইকসুদ্ধ আছড়ে পড়েছি আমি। ভাগ্যিস মাথায় হেলমেট ছিল। বাইক থেকে ছিটকে ডিভাইডারের ওপর পড়েছি। তুবড়ে যাওয়া বাইকের সামনের চাকা তখনও ঘুরছে– এটুকু আমার মনে আছে।  (চলবে)

Sabyasachi Bhattacharya
Sabyasachi Bhattacharyahttps://uttarbangasambad.com/
Sabbyasachi Bhattacharjee Reporter based in Darjeeling district of West bengal. He Worked in Various media houses for the last 23 years, presently working in Uttarbanga Sambad as Sr Sub Editor.
RELATED ARTICLES
- Advertisment -
- Advertisment -spot_img
[td_block_21 custom_title="LATEST POSTS"]

Most Popular