চোদ্দো
‘তপন দা, আপনি আমাকে জব্দ করার জন্য আপনার ভাইয়ের সঙ্গে আমার বিয়ে ফাইনাল করে এসেছেন। আমার কথা জানলে হয়তো প্রথমেই আপনারা বিয়ে ক্যানসেল করে দিতেন। আমার অসুবিধে আছে। প্লিজ, আমাকে মাফ করুন তপনদা। শাঁখাসিঁদুর, নতুন শাড়ি, বিয়ের সানাই– এসব আমার জন্য নয় দাদা। জেনেশুনে আপনাদের ঠকাতে পারব না। ভীষণ আন-এথিক্যাল ব্যাপার হয়ে যাবে। সিদ্ধার্থ, আপনার ভাই, তাঁর জীবন নষ্ট করার কোনও অধিকার আমার নেই। শুধু আপনার ভাই নয়, আপনাদের পরিবারও ঠকে যাবে।’
“দেখো মঞ্জু, সেটা আমাদের ব্যাপার। ঠকলে বুঝব আমাদের কপালে লেখা ছিল। আমরাই মা ভবানীকে চিনতে পারিনি। সেখানে তোমাকে দোষী করব না। তোমার নিজস্ব কোনও আপত্তি থাকতেই পারে। কিন্তু আপাতভাবে তোমাকে কারও অপছন্দ করার কোনও কারণ নেই। তুমি অসম্ভব স্মার্ট, সুন্দরী, লেখাপড়া জানা আধুনিক চিন্তার মেয়ে। তোমাকে বিয়ে করলে কেন আমরা ঠকে যাব– বুঝতে পারছি না।”
ওরা একটা ঝাঁকড়া বকুল গাছের নীচে বেঞ্চের ওপর বসে ছিল। সাদা শাড়িতে সোনালি ফুল, লাল পাড় শাড়িতে মঞ্জুলাকে দারুণ দেখাচ্ছে আজ। তার প্রতিমার মতো মুখে কপালের মাঝখানে কালো টিপ তৃতীয় চোখের তারা মনে হচ্ছিল। কথা শেষ করে মঞ্জুলা কিছুক্ষণ চুপ করে রইল।
“সেই প্রথম দিন থেকে তুমি শুধু তোমার আপত্তির কথা বলে যাচ্ছ। এখনও কিন্তু আসল কথা বলোনি। নাও, কেসটা ওপেন করো তো। তপোজ্যোতিদা কি কোনও ফাঁড়ার কথা বলেছেন? চল্লিশ বছরের আগে বিয়ে করলে স্বামী বেশিদিন বাঁচবে না, এই ধরনের কিছু।”
“না তপনদা, আমি ওসব মানি না। আমার কোনও সংস্কার নেই।”
“প্রত্যেকটা মানুষের সংস্কার থাকে। হিন্দু, মুসলমান, খ্রিস্টান, সবার। বলো যে তোমার কোনও কুসংস্কার নেই, তাই না? সংস্কারহীন মানুষ সংসারে পাওয়া মুশকিল।”
“আমাদের বাড়ি থেকে আমার সম্পর্কে সব কথা খুলে বলেনি আপনাদের। নিশ্চয় আমার শরীরের ত্রুটির কথা লুকিয়েই বিয়ের কথা হয়েছে। আমি সেটা চাই না।”
ভুরু কুঁচকে মঞ্জুলার দিকে তাকাল তপন। এরকম সম্ভাবনার কথা তার মাথায় আসেনি। বাইরে সর্বাঙ্গসুন্দর একটি মেয়ের শরীরের ভেতরের কথা বাইরে থেকে অনাত্মীয় একজন পুরুষের জানার কথা নয়। মঞ্জুলার মতো মেয়ে চিরকাল কুমারী থেকে যাবে – কী আশ্চর্য ব্যাপার!
“কীসের ত্রুটির কথা বলছ? নিশ্চয় সেটা খুলে বলবে বলেই আমাকে এখানে ডেকে পাঠিয়েছ। বলো।”
“হ্যাঁ, শুনুন, আপনার কাছে বলতে আমার সংকোচ নেই, ব্যাপারটা মেয়েলি অসুখ সংক্রান্ত। প্রথমে আমি কিছু বুঝতে পারিনি। হঠাৎ মেনেস্ট্রুয়াল ব্লিডিং অস্বাভাবিক হতে শুরু করল। তলপেটে অসম্ভব ব্যথা। খুব ঘনঘন ইউরিন হতে শুরু করল। তখনও বুঝিনি সিরিয়াস কিছু। শেষে তলপেটের ব্যথা কিছুতেই যখন আর কমছে না, গাইনি দেখালাম। আল্ট্রাসাউন্ড করে ছবি দেখে বললেন ইউটেরাসে টিউমার। বেশ বড় সাইজ হয়ে গেছে। ল্যাপারোস্কোপি চলবে না, ওপেন সার্জারি করতে হবে। তখনও আমি বুঝিনি, ভেবেছি সাধারণ কোনও ছোট্ট অপারেশনে সব ঠিক হয়ে যাবে। বাট, দ্যাট ওয়জ ইউটেরাইন ফাইব্রয়েডস। টু বি অপারেটেড। আমার শরীরের ভেতরে তিলে তিলে আমার নিয়তি বেড়ে উঠছিল।”
“হুঁ, এখন তো শুনেছি এসব কোনও সমস্যাই নয়। কোর্টের মোক্তার সাধন শিকদারের স্ত্রীর শুনেছি এরকম ছিল। অপারেশন করে এখন দিব্যি ভালো আছে। আর, নিশ্চয় ক্ষতিকারক কিছু নয়।”
“না, ক্ষতিকারক নয়, বিনাইন ছিল। আমার ফাইব্রোসিস একটু অন্যরকম ছিল। প্রায় টোটাল রিপ্রোডাক্টিভ সিস্টেমটাই বাদ দিতে হয়েছে। তার মানে বুঝতে পারছেন?”
“মানে, টোটাল কী বাদ?”
“উফ, আপনি একটা হাঁদা। পুরো হাঁদাগঙ্গারাম। আবার নাকি নামকরা মুহুরি। মুহুরি না আমার কচু। রিপ্রোডাক্টিভ সিস্টেম মানে বাংলায় জননতন্ত্র। সেটাও কি খুলে বলতে হবে? মরণ!”
হাসতে পারল না তপন। কে জানে কোন কথায় কার মরণ হয়। মঞ্জুলার শরীরে কোনও জননতন্ত্র নেই। এই মেয়েটা কোনও দিন গর্ভে সন্তানধারণ করতে পারবে না। মা হতে পারবে না কোনও দিন। তাই নিজের বিয়ের সম্বন্ধ নিজেই ভাংচি দিয়ে ভেঙে দেয়। এর আগেও নিশ্চয় অনেক সম্বন্ধ ভেঙে দিয়েছে। আর কতদিন, কতবার মঞ্জুলাকে মিথ্যে বলে সম্বন্ধ নষ্ট করে দিতে হবে।
কে জানত কখনো-কখনো ‘মরণ’ উচ্চারণে এত লীলা থাকে। সুধীন দত্ত পড়া থাকলে তপন বলতে পারত– ‘একটি নিমেষ দাঁড়াল সরণী জুড়ে, থামিল কালের চিরচঞ্চলগতি’।
“ মঞ্জু, সরি।”
তপনের বুকের ভেতরে অজস্র কথা কলকল করছিল। কথার বুদবুদ ঘাই মারছিল। সে সব কথা তপন মঞ্জুকে কোনও দিন বলতে পারবে না। ছোট ভাই সিধুর কথা কেন যে এখন বারে বারে মনে পড়ছে। না, সিধুর সঙ্গে মঞ্জুলার বিয়ে সে দিতে পারবে না। তাদের পরিবারে মঞ্জুলা কোনও সন্তান দিতে পারবে না।
“তুমি কেন সরি বলবে তপনদা। তোমার দুঃখিত হওয়ার তো কোনও কারণ নেই। আমার ত্রুটি আমি মেনে নিয়েছি। কিছু করার ছিল না। বুঝতেই পারছ, বাবা-মা ভাবছে আমার জীবন বুঝি ব্যর্থ হয়ে গেল। এই মেয়ে চিরকাল তাঁদের ঘাড়ে বোঝা হয়ে থাকবে। দোকানদার যেমন কাস্টমারকে নষ্ট জিনিস কায়দা করে গছিয়ে দেয়, ওরাও সেটাই করতে চেয়েছে। আমি তো বাজারের নষ্ট হয়ে যাওয়া, পচে যাওয়া আলুপেঁয়াজ নই, আমি কেন ওভাবে নিজের খুঁত লুকিয়ে বাজারে বিকোব। কোনওমতে কারও ঘাড়ে গছিয়ে দিতে পারলে তারা দায়মুক্ত হবে। আমি কেন এইভাবে লোক ঠকাব। আমি জানি আমার শরীরের ত্রুটির কথা। জেনেশুনে আমি কোনও পরিবারের ক্ষতি করতে পারব না।”
মঞ্জুলার কথাগুলো তপনের কানের ভেতর দিয়ে ঢুকছিল ঠিকই, কিন্তু মাথায় কোনও অর্থ তৈরি করছিল না। এমনকি চারপাশের গাছপালা, লতাকুঞ্জ, ফুটে থাকা ফুল– কিছুই সে দেখছিল না। মঞ্জুলার তাকে ‘তুমি’ সম্বোধন একটা ঘোর তৈরি করেছিল। এই ঘোর ক্রমশ একটা মোহমায়ায় তাকে বন্দি করে নিচ্ছিল। মায়া একটা গল্প তৈরি করছিল।
মঞ্জুলাকে তার মনে হয়েছিল খুব র্যাশনাল, ধর্মবিষয়ে উদাসীন, ভীষণ যুক্তিবাদী মেয়ে। অসম্ভব তুখোড় বাস্তববাদী। অথচ এখন মনে হচ্ছে এই তপোজ্যোতি রায় নামের গুরুদেব টাইপের লোকটার খপ্পরে পড়েছে। আসলে যখন দুর্ভাগ্যের বিরুদ্ধে লড়াই করার মতো আর কোনও পথ থাকে না, মানুষ তখন দৈবের ওপর বিশ্বাস করতে শুরু করে। শেষ আশ্রয় হয় ঈশ্বর। অনেক বড় বড় নাস্তিককে তপন দেখেছে, শেষে বিপদ থেকে উদ্ধার পাওয়ার আর কোনও পথ না পেয়ে দৈবের ওপর ভরসা করেছে।
আসলে বিশ্বাসের খুঁটি দিয়ে তৈরি একটা চারচালার নীচে মানুষের বেঁচে থাকা। কিন্তু সংসারে বন্যা খরা মহামারি মড়ক ভূমিকম্পে যখন সেই চারচালা নড়ে ওঠে, অস্তিত্ব বিপন্ন হয়ে ওঠে, মানুষ তখন বিপদ থেকে উদ্ধার পাওয়ার মরিয়া চেষ্টায় কখনও একটা পাথরের কাছে, কখনও কোনও বৃক্ষের কাছে, কখনও বিশ্বস্ত কোনও মানুষের কাছে প্রার্থনা জানায়। দৈবশক্তির কাছে পরিত্রাণ চায় বিপদ থেকে। নইলে মঞ্জুলার মতো তুখোড় স্মার্ট মেয়ে, তপনের হাতের পাথর বসানো আংটি নিয়ে যার বিদ্রুপ করতে বাধেনি, তপনকে অ্যাস্ট্রোলজি নিয়ে ঠাট্টা করেছে যথেচ্ছ, ইচ্ছে করেই আঘাত করেছে– সেই মেয়ের ভেতরের কান্না স্পষ্ট শুনতে পেল তপন। নিষ্ফল বৃক্ষের কান্না।
তপন সামন্তর বুকের ভেতরে দু’রকম ঘূর্ণি পাক খাচ্ছিল। একটা স্রোতের ভেতর থেকে কথা উঠে আসছিল– “খুব তো বড় বড় কথা বলেছিলে, গ্রহনক্ষত্রের গুষ্টির তুষ্টি করেছিলে, এখন? এখন নিয়তির কথা বলছ?” আবার অন্য একটা স্বর শুনতে পাচ্ছিল –“না মঞ্জু, কিছুই ফুরোয়নি। কিছুই ফুরোয় না। ঈশ্বরের এই দুনিয়ায় সব ঘুরেফিরে আসে। আমরা বুঝতে পারি না, মন্দ কখন ভালো হয়ে ফিরে এসেছে। সূর্যের আলোই চাঁদের আলো হয়ে ফিরে আসে। ফুল ঝরে যায়, কিন্তু তার পরাগ ঠিক সময়েই প্রজাপতির ডানায়, বাতাসে ভেসে কোথাও ঠিক পরাগমিলন ঘটায়। পৃথিবীতে সেই ফুলের বেঁচে থাকা, তার বংশের টিকে থাকা নিশ্চিত করে।”
কিন্তু কিছুতেই আর একটা গোপন কথা সে স্বীকার করছিল না। তৃতীয় একটি স্রোত আড়ালে বয়ে যায়। ভয় পেয়ো না মঞ্জু, আমি আছি তো। উপকূলবরাবর এই ভালোবাসার কথা চিরকাল বাতিঘরের আলো হয়ে জ্বলে। বারদরিয়ার নাবিক দেখতে পায় ভালোবাসার আলো। ঠিক চিনে নেয় সমুদ্রকিনারা। দিক হারিয়ে অকূলে হারিয়ে যাওয়ার ভয় কেটে যায়। কিন্তু কখনও সমস্তজীবন চলে গেলেও এই কথাটুকু বলা হয়ে ওঠে না। আলো একা জ্বলে, অথই সমুদ্রে দিক হারিয়ে নাবিক তার নৌকো বাইতে থাকে, বাইতে থাকে। কত কাল, কত যুগ ধরে। একবার, যদি একবার মাল্লা হেঁকে উঠত– দেখেছি, তোমার আলো আমি দেখতে পেয়েছি, দাঁড়াও, আমি আসছিইই– তবে কত না-পাওয়ার কষ্ট মুছে গিয়ে ভালোবাসার কাঙাল মানুষ প্রিয়মিলনের কামনা নিয়ে বাতিঘরের কাছে পৌঁছে যেত।
“না মঞ্জু, কিছুই ফুরোয় না। ওই দ্যাখো একটা পাখি বসে আছে আমাদের ডানদিকের গাছে। ওই যে, বেঁকে যাওয়া ডালের মাঝে। কালোমাথা বেনেবৌ পাখি। ওর শরীর হলুদ, আর মাথা কেন কালো, তোমাকে একদিন সে গল্প শোনাব। অবশ্য আবার যদি আমাদের কখনও দেখা হয়। তুমিও ফুরিয়ে যাওনি। তোমার দোষে তো কিছু ঘটেনি মঞ্জু। এরকম তো অনেক হয়। তুমি তো ইচ্ছে করলেই আমাদের বাড়ির বৌ হয়ে যেতে পারতে। তোমার সততা তোমাকে মিথ্যে সুখের দিকে যেতে দেয়নি। তুমি আসলে খুব লক্ষ্মী মেয়ে মঞ্জুলা। খুব ভালো মেয়ে তুমি।”
“না তপনদা, আমাকে মিথ্যে লোভ দেখিও না। সংসারের সুখ আমার জন্য নয়। আমি নিষ্ফলা বৃক্ষের দলে। আমার জীবন আমি আমার মতো করেই কাটিয়ে দেব। তুমি কেন ভাবছ আমার কথা। জানো, একরকম গাছ আছে, জঙ্গলে আগুন ধরে গেলে ওরা দ্রুত ওদের বীজ মাটিতে ঝরিয়ে দেয়। পুড়ে শেষ হয়ে গেলেও ওই বীজের ভেতরে সে-ই থেকে যায়। আবার কোনও দিন অনুকূল পরিবেশ পেলে বেঁচে ওঠে। আমি কিন্তু একাই পুড়ে যাব তপনদা।”
কে জানে কী হল তপনের। মুহূর্তে বেহিসেবি হয়ে গেল হিসেবি মুহুরি তপন সামন্ত। ষড়যন্ত্রকারীর মতো ঠিক তখন হলুদ পাখিটা ডেকে উঠল। টি ট্টু টি উ। পাশে বসা মঞ্জুলার বাঁহাতের ওপর তার হাত রাখল তপন। আবার ডাকল পাখিটা। ভারী অদ্ভুত চোখে তপনের চোখের দিকে তাকাল মঞ্জুলা। তপন দেখল শ্রাবণের কালো মেঘ ঘনিয়ে আছে মঞ্জুলার দুই চোখে। এখনই শ্রাবণধারায় ভেসে যাবে সব। তবু সেই মেঘতিমিরের আড়ালে থাকা সূর্য থেকে খুব লাজুক ভঙ্গিতে যেন উঁকি দিতে চাইছে একবিন্দু আলো। সামান্য কৌতুকচ্ছটা রয়েছে আলোকবিন্দুতে। সরাসরি নয়, আড়াল থেকে বিচ্ছুরণ ছড়িয়ে পড়ছে মেঘের প্রান্তজুড়ে।
আস্তে হাত সরিয়ে নিল মঞ্জুলা। তপন তাকাল তার সজল চোখের দিকে। টের পেল বুকের ভেতরে কিছু গলে পড়ছে তার।
পনেরো
“মঞ্জু, তোমাকে ছুঁয়েছি বলে রাগ করলে?”
“না তো, রাগ করব কেন। আমি তো এখনও অস্পৃশ্য হয়ে যাইনি যে, ছুঁলে তোমার জাত যাবে। বা, তুমি ছুঁলে আমার জাত যাবে।”
“মঞ্জু, আমাকে ‘তুমি’ করেই ডেকো।”
মৃদু হাসল মঞ্জুলা। তার চোখের গলুইয়ে এখন আর জলরেখা নেই। আবার আগের মতো স্বাভাবিক হয়ে উঠেছে, কিন্তু যেন একটু মায়া লেগে আছে।
“কী আসে যায় কী বলে ডাকলাম। আমাদের কি আবার কখনও দেখা হবে? দেখা হলেও মনে পড়বে না একদিন কী বলে ডেকেছিলাম। ‘আপনি’ না ‘তুমি’।’’
“কেন মঞ্জু, তোমাকে তো বেনেবৌ পাখির গল্প শোনানো বাকি রয়ে গেল আমার। শুনবে না?”
“তপনদা, সব কথা বলে ফেলো না। কিছু রেখে দাও তোমার কাছে। কত কথা ঠিক সময়ে বলা হয়ে ওঠে না, সেগুলো কোথায় যে হারিয়ে যায়। সামান্য অভিমানে দুটো মানুষ চিরদিনের জন্য দূরে সরে যায়। অথচ একবার যদি একজন সব অভিমান ভুলে বলত ‘রাগ কোরো না, সরি, আই লাভ ইউ’ – তবে আবার ভালোবাসা বেঁচে উঠত। কিছু মনে কোরো না, একটা কথা জিজ্ঞেস করব?”
“বলো, কী জানতে চাও।”
“ছোট ভাইয়ের বিয়ের জন্য মেয়ে দেখে বেড়াচ্ছ, আমার না হয় প্রবলেম আছে, তোমার কীসের সমস্যা? দিব্যি তো বিয়ের বয়স রয়েছে এখনও, বলো তো একটা ভালো মেয়ে খুঁজে দিচ্ছি। দু’ভাই একসঙ্গে সানাই বাজিয়ে, টোপর পরে ঘরে বৌ নিয়ে এসো।”
“তোমার মতো মেয়ে পাইনি বলে” – একথা বলার জন্য তার বুকের ভেতরে একটা হলুদ পাখি ডানা ছটফট করছিল। বলতে পারল না। বরং অন্য কথা বেরিয়ে এল।
“আসলে ওই, মানে, ভাইবোনদের বড় করতে করতে কোথা দিয়ে যে সময় চলে গেল …।”
“আশ্চর্য! তোমার কথা বাড়ির কেউ ভাবল না?”
চুপ করে রইল তপন। সত্যিই তার কথা সংসারের কেউ ভাবেনি। বাবার আয় কোনও কালেই তেমন কিছু ছিল না। মাঝেরডাঙার হাটে আনাজের দোকান। দুই মেয়ে, দুই ছেলে আর স্ত্রীকে নিয়ে টেনেটুনে সংসার চালিয়েছেন। তার ভেতরে কোনও রকমে তপন গ্র্যাজুয়েশন কমপ্লিট করেছিল। তারপর বাবা বলে দিলেন তিনি একা আর টানতে পারছেন না। এবার তপন যেন রোজগারের চেষ্টা করে। এই রেজাল্টে চাকরি হবে না, তপন ভালোই জানত। আর, সরকারি চাকরির যা রেট শুনতে পায়, তার পক্ষে অসম্ভব। তাদের সবজি দোকানের নিয়মিত খরিদ্দার কালোমোক্তারকে বাবা কোর্টে তার মুহুরিগিরির ব্যবস্থা করে দিয়েছিল। কিছুদিনের ভেতরেই কাজেকর্মে দড় হয়ে উঠেছিল তপন। টের পেয়েছিল হিসেব করে চললে আর কিছুদিনের ভেতরেই তার রোজগার সরকারি চাকরির মাইনের চেয়ে অনেক বেশি হবে। বড় বোন শিউলির বিয়েতে তেমন কিছু খরচ হয়নি। ওরা পালিয়ে বিয়ে করেছিল। কিন্তু এখন শিউলি আর ভুজঙ্গ মিলে শুষে নিচ্ছে। ছোট বোন লিলি আর সিধুর লেখাপড়া, বাবার চিকিৎসা– এসব দায় সামলাতে বেলা বয়ে গেছে। স্বার্থপর হতে পারেনি তপন। সব দায় নিজের ঘাড়ে নিয়েছে। বাবা-মা, ভাইবোন– কেউ কখনও উচ্চারণ করেনি তপনের নিজস্ব একটি সংসারের কথা। ছেলে কিংবা দাদা যদি আলাদা হয়ে যায়। যে যার নিজের অস্তিত্বের কথা ভেবেছে। তপন তাদের পারের কান্ডারি। আস্তে আস্তে তপন এক মহান উচ্চতায় পৌঁছে গেছে। দেবতার আসনে প্রায়। সেখান থেকে ধুলোমাটির পৃথিবীতে নেমে এসে বিয়ে, সংসার, সন্তান– এসব অবিশ্বাস্য হয়ে যায়। অবাস্তব কথা। বিগ্রহের আবার বিয়ে কীসের। ওসব সাধারণ মানুষদের জন্য।
“শুনলে তো আমার সব কথা। এখন বুঝতেই পারছ, আমার পক্ষে তোমার ভাইকে বিয়ে করা, কারও ভাইকেই বিয়ে আমি করতে পারব না। তোমার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করেছি। আমি তখন, বিশ্বাস করো, নিরুপায় হয়ে রাফ হয়ে কথা বলেছি। বুঝতে পেরেছিলাম, আমার ওপর শোধ নেবে বলেই বিয়ে ফাইনাল করেছিলে। তোমাদের তো সব শোধ নেবার জায়গা একটাই। শরীরে মনে মেয়েদের ধুলোয় মিশিয়ে দাও। তবে পুরুষের শান্তি।”
“আচ্ছা, আমার ওপর তোমার এত রাগ কেন, তুমি যদি প্রথমেই বলে দিতে কেন তোমার পক্ষে বিয়ে করা সম্ভব নয়, তবে কি আমি জবরদস্তি করতাম?”
“না, ঠিক তোমার ওপর রাগ করে আমি একথা বলছি না। হঠাৎই বেরিয়ে এল। তুমি কিছু মনে কোরো না। তপনদা, চলো উঠি। আর হয়তো আমাদের দেখা হবে না। হয়তো আমরা দুজনই একদিন দুজনকে ভুলে যাব। ভাইকে একটা সুন্দরী, নিখুঁত মেয়ের সঙ্গে বিয়ে দিও। চলো, একবার তপোদার সঙ্গে দেখা করে যাই।”
না মঞ্জু, তোমাকে ভুলব না। সব মনে থাকবে আমার। তোমার রেগে যাওয়া মুখ, তোমার ঠোঁট টিপে হাসা, তোমার ভেজা-ভেজা চোখ, আর ওই হলুদ পাখির ডাক। মঞ্জু, ওই ডাক মানুষ বোধহয় জীবনে একবারই শোনে। নানারকম সাংসারিক শব্দে অনেকে কোনও দিন সেই ডাক শুনতে পায় না। আর যে শোনে, তার বড় কষ্ট মঞ্জু। ওসব মেয়েরা বোঝে না। পৃথিবীর সবাই মেয়েদের অভিমানের কথা বলে, পুরুষের অভিমানের কথা কেউ বলে না। পুরুষদের বলতে নেই। বুকের গভীরে চিরকাল বলতে না পারা বিন্দু বিন্দু কথা নিয়ে নদী বয়ে যায়। (চলবে)