- বিপুল দাস
ষোলো
ময়দান এখন শূন্য। শালপাতা, ছেঁড়া কাগজ, প্লাস্টিক, শূন্য জলের বোতল গড়াগড়ি খাচ্ছে। পশ্চিম থেকে ভেজা বাতাস আসছে। বাতাসে ঘুরপাক খাচ্ছে শালপাতা, কাগজ, প্লাস্টিক। মানুষজন সবাই ফিরে গেছে একদিনের কলকাতা সফর সেরে। অনেকের কেনাকাটা ছিল, অনেকের অনেক কিছু দেখার ছিল, অনেকের নেতাদের কথা শোনার ইচ্ছে ছিল। সে সব সারা হয়ে গেছে। মাঠ এখন আবার আগের মতোই শূন্য। কিছু আলো এখনও জ্বলছে। এরপর সাজানো মঞ্চ খুলে নিলেই মাঠ আগের মতো খাঁখাঁ করবে। চোঙাগুলো সব আজ রাতেই খোলা হয়ে যাবে।
ফুটপাথে দাঁড়িয়ে মনোযোগ দিয়ে সিগারেট টানছে আনন্দ। আমার সঙ্গে কী একটা কথা আছে ওর। প্রাইভেটে বলতে চায়। এখানে দাঁড়িয়ে নিশ্চিন্তেই ওর গোপন কথা শোনা যেতে পারে। আমাদের কথা লুকিয়ে শোনার জন্য কেউ কান পাতবে না। হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে ভাঙা পায়ে জোর একটু কম পাচ্ছিলাম। শুধু শরীরে নয়, মানসিকভাবেও একটা জোর ধাক্কা লেগেছিল। সবাই বলত আমি নাকি মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে এসেছি। একা বসে ভাবলে শরীরটা শিরশির করে উঠত। আহা, এই শরীর মানুষের কত প্রিয়। হাড়মাংসপেশি দিয়ে তৈরি এই খাঁচার আড়ালে একটা কুবোপাখি থাকে। অহরহ লাবডুব লাবডুব ডাকতে থাকে। পাখির ডাক থেমে গেলে আদরের এই শরীর ‘বডি’ হয়ে যায়। আসলে তখন আর তার কোনও নাম থাকে না, নো-বডি হয়ে যায়, অথচ সবাই বলে বডি। পৃথিবীজোড়া বিশাল এক গ্রাফের অসংখ্য ছেদবিন্দুর একটিতে থাকে একজন মানুষের অবস্থান। তার কথা বলার ভঙ্গি, চুলের স্টাইল, অ্যাডমিট কার্ড, তার ছেলেমেয়েবৌ, তার ব্যাংক অ্যাকাউন্ট নম্বর, আধার কার্ড, প্যানকার্ড, ভোটার লিস্টে তার নাম– এসবের অক্ষসাপেক্ষে সংসারে তাকে চিনে নেয় সবাই। পাখির ডাক বন্ধ হলে এসব মিথ্যে হয়ে যায়। ক্লাস ফোরে যতীনস্যর যখন বলেছিলেন– তোর নাম তো খাতায় নেই রে তিমির– তখন যেমন আমার বুকের ভেতরে কেঁপে উঠেছিল, মনে হয়েছিল হারিয়ে গেছি আমি, মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে এসেছি শুনলে আমার তেমন বুক কেঁপে ওঠে। তারপর আমার পরিচয়ের চিহ্নগুলো দেখে জীবনকে বড় ভালো লাগে। দক্ষিণের জানলা দিয়ে এক টুকরো রোদ এসে পড়ে আমার পায়ের কাছে লেপের ওপর। আয়তকার সেই আলোর দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে দেখি। দেওয়ালে টাঙানো ক্যালেন্ডারে তাজমহল দেখি, বাইরে তাকিয়ে উলটোদিকের ফ্ল্যাটবাড়ি দেখি। আমার ভাঙা পায়ে হাত বুলিয়ে নিশ্চিন্ত হই। দিব্যি প্রাণ আছে। সব কিছু ঠিক আগের মতোই আছে। এখনই মরলে চলবে না আমার। কত কাজ বাকি রয়েছে।
টুসকি দিয়ে সিগারেটের লেজটুকু ড্রেনে ছুড়ে দিল আনন্দ। আমার দিকে তাকাল। ভেপার ল্যাম্পের আলোয় ওর মুখটা হলদেটে দেখাচ্ছে। ঠিক হলদে নয়, কালোর ওপর হলুদ আলো পড়ে কেমন একটা হলদেসবুজ আভা তৈরি হয়েছে। হঠাৎ ওকে খুব অচেনা মানুষ মনে হল। যেন কুমোরটুলির কোনও প্রতিমা, সদ্য গর্জন তেল মাখিয়ে কেউ ধর্মতলার মোড়ে দাঁড় করিয়ে রেখেছে। কেন যেন মনে হল ঘাটে দাঁড় করিয়ে রাখা বিসর্জনের ঠাকুর।
“বল, তোর প্রাইভেট কথা। কোথাও ফেঁসে গেছিস? দীপা জেনে গেছে, তাই তো?”
“দূর বাঁ, আমি আর বাঁচব না মাইরি। দীপার কী হবে জানি না। রোজ আয়নার সামনে হা করে গলার ভেতরে দেখার চেষ্টা করি। বেশি দূর দেখা যায় না। আলজিভ পর্যন্ত দেখেছি। ভেবেছিলাম কিছু না, কারওকে কিছু বলার দরকার নেই। আর পারছি না মাইরি। ভীষণ ভয় করছে এখন”।
“ব্যাপারটা খুলে বলবি? হয়েছেটা কী? গলায় হার্ট অ্যাটাক হয়নি নিশ্চয়”।
“ প্রথমে বেশ কিছুদিন কানে ব্যথা হত। গা করিনি। ভেবেছি কানে ঠান্ডা লেগেছে। ক’দিন মাফলার ইউজ করলাম। গলার আওয়াজ কেমন রাফ হয়ে যাচ্ছিল। খসখসে। তারপর দেখি ঢোক গিলতে অসুবিধে হচ্ছে। তখনও ভেবেছি গলায় ঠান্ডা লেগেছে। একটুতেই আমার গলায় ঠান্ডা বসে যায়। দীপা জানে। বাড়িতেই অ্যাজিথ্রাল থাকে। দিন তিনেক জ্বর-জ্বর ভাব। অ্যান্টিবায়োটিক পড়লেই সব নর্মাল হয়ে যায়। সেটা করেও কোনও লাভ হল না।
“ ডাক্তার দেখাসনি?”
“ দীপা একদিন বলল আমাকে নাকি বেশ রোগা দেখাচ্ছে। বাড়ির কাছে যুবভারতী ক্লাবে ওজনের মেশিন আছে। গিয়ে ওজন নিয়ে দেখি ছ’কিলো ওজন ঘেঁটে গেছে। কথা বলতে বেশ কষ্ট হচ্ছে তখন। দীপাকে দেখিয়ে দেখিয়ে রোজ গার্গল করছি তখন। বিশ্বাস কর, আমি না ভয়ে ডাক্তার দেখাচ্ছিলাম না। আমি আর পারছি না টনি। বল, কী করব। আমার মন বলছে খারাপ কিছু হয়েছে। তুই তো অনেক জানিস, কত জ্ঞানের কথা বলিস, আমি আর বেশিদিন বাঁচব না– তাই না ?”
“ মারব এক … বড় ডাক্তার হয়েছিস, না ? ইএনটি দেখিয়েছিস কোনও? দাঁড়া, দেখি দীপায়ন মুখার্জির অ্যাপয়েন্টমেন্ট পাওয়া যায় কিনা। চিন্তা করিস না, অনেক দিন বাঁচবি তুই। দেখবি, আমিই একদিন হুঁশ করে ফুস হয়ে যাব”।
“ টনি, আমার ভয় করছে”।
এখন মনে হল আনন্দর গলার আওয়াজ বেশ খসখসে, আমাদের মতো মসৃণ নয়। অনেকটা কাঠ চেরাইয়ের শব্দের মতো ওর গলা থেকে শব্দ বেরিয়ে এল– ভয় করছে। ঘ্যাস ঘ্যাস। মাংসের দোকানে যেমন একটু আড়ালে কাঠ চেরাইয়ের শব্দের মতো শোনা যায়– ব্যা অ্যা …।
“ তোর গলার এই অবস্থা, তার ভেতরে তুই নিশ্চিন্তে সিগারেট টানছিস ? আবার বলছিস ভয় করছে? দীপা জানে তোর এই অবস্থা?”
“ রোজই আমাকে ডাক্তার দেখানোর জন্য তাড়া দিচ্ছে। তোর সঙ্গে পরামর্শ করার কথা বলছে। মাইরি বলছি, ডাক্তারের কাছে যেতে আমার ভীষণ ভয় করছে। যদি যা ভাবছি, সেটাই সত্যি হয়। প্রত্যেকবার সিগারেট ধরিয়ে ভাবি- ধুস, সত্যি খারাপ কিছু হয়ে থাকলে একটা সিগারেট টানলে বেশি আর কী হবে। একটা কথা শুনেছিলাম- সমুদ্রে পেতেছি শয্যা, শিশিরে কী ভয়, তখন বুঝিনি, এখন মানে বুঝতে পারি”।
“ডায়ালগ ছাড়, দীপায়ন মুখার্জির অ্যাপয়েন্টমেন্ট পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার। আমার একটা লাইন আছে, দেখি কিছু করা যায় কিনা। আর শোন, মনে কর তোর লাস্ট সিগারেট টানা হয়ে গেছে। দীপা আমাকে বলেছে আজকাল রোজ ড্রিংক্স নিচ্ছিস। প্লিজ, বন্ধ কর”।
“ বুঝেছি, তুই ভাবছিস আমার মদ খাওয়ার জন্য দীপা তোকে দায়ী করবে। গিল্টি ফিলিং হচ্ছে তোর। কী করব, বল। রোজ ভাবি কাল থেকে একদম ছেড়ে দেব। কতবার প্রতিজ্ঞা করেছি, পয়লা বৈশাখের আগের রাতে, একত্রিশে ডিসেম্বরের রাতে– নতুন বছর থেকে আর এসব ছোঁব না। সন্ধে হলেই একটা নাছোড়বান্দা নীল ডুমোমাছি আমার চারপাশে ঘ্যান ঘ্যান করে ঘুরতে থাকে। কিছুতেই কন্ট্রোল করতে পারি না নিজেকে। বিরক্তিকর মাছিটার হাত থেকে রেহাই পেতেই গ্লাস নিয়ে বসি। টনি, আমাকে মনভোলানো কথা বলিস না। আমি জানি, আমার গলায় ক্যানসার হয়েছে। তোর দোষ নেই। এসব জিনের ব্যাপার। জানিসই তো মায়েরও ক্যানসার ছিল। মদ, সিগারেট না খেলেও আমার ক্যানসার হত”।
“বড় ডাক্তার হয়েছিস, না? রেডি থাকবি, আমার সঙ্গে গিয়ে ডাক্তার দেখাবি। তারপর ঠিকঠাক ওষুধ আর নিয়ম মেনে চললে একদম ভালো হয়ে যাবি। মরার আগেই মরে বসে আছিস। এসব আজকাল কোনও অসুখই নয়। কত নতুন নতুন ট্রিটমেন্ট বেরিয়েছে”।
হাসল আনন্দ। ওর সেই নিষ্পাপ শিশুর মতো পবিত্র হাসি। কিন্তু আমার মনে হল আজকের হাসির আড়ালে একটা মেঘের ছায়ার মতো বিষাদ রয়েছে। ভেপার ল্যাম্পের হলদে আলোয় ওর ঠোঁট বেয়ে হলুদ দুঃখ ধর্মতলার ফুটপাথে গড়িয়ে পড়ছিল।
“ চলি রে টনি। দেরি করব না, আজ বাস কম আছে। গুড নাইট।
আমিও ‘গুড নাইট’ বলেছিলাম। আনন্দ শুনতে পায়নি। আমিও শুনতে পাইনি। আমার ঠোঁট শুধু নড়েছিল। ফিসফিস করে বলেছিলাম – গুড নাইট আনন্দ, টা টা।
আনন্দ যে লক্ষণগুলো বলল– ওজন কমে যাওয়া, কথা বলতে কষ্ট, গলার স্বর নষ্ট হয়ে যাওয়া, কানে ব্যথা– সবই খারাপ লক্ষণ। ওর মাথার ওপরে একটা পাখি বড় ব্যাসার্ধ নিয়ে গোল হয়ে ঘুরতে শুরু করেছে। কালপক্ষী। আস্তে আস্তে ব্যাসার্ধ ছোট করে আনছে। টাইম হলেই খপ করে তীক্ষ্ণ ঠোঁটে তুলে নেবে আনন্দকে। শান্তিগোপাল ভ্যানিশ।
দু’পা এগিয়ে আবার আমার দিকে ফিরে এলো আনন্দ। আমি ওখানেই দাঁড়িয়ে ছিলাম। ভাবছিলাম একটা সিগারেট ধরাব কিনা। আনন্দর কথা শুনে একটু ভয়ও করছিল। আনন্দ ফিরে এসে আমার হাত ধরল।
“টনি, একটা কথা সিরিয়াসলি বলছি তোকে, কথাটা রাখবি”।
“কী কথা? টাকাপয়সার ব্যাপার? ওসব এখন ছাড়। ভাইয়ের জন্য খরচ করছি, তুই ভাবছিস কেন”।
“টনি, আমি মরে গেলে দীপাকে দেখে রাখিস। ও তোর ওপর ভীষণ ভরসা করে”।
আমার বুকের ভেতরে গুড়-গুড় করে মেঘ ডেকে উঠল। মুখটা স্বাভাবিক রেখে কথা বললাম।
“বাজে কথা বলিস না তো। মরার কথা কোত্থেকে আসছে। আর, সে কথা তোর বলার দরকার নেই। এমনিতেই আমি দীপার পাশে সবসময় আছি”।
“ জানি টনি। কিছু মনে করিস না, তোর সঙ্গে বোধহয় দীপার একটা কিছু ইয়ে আছে। জানিস, বেশি মদ খেলে আমার ঘুম আসে না। মাথা গরম হয়ে যায়। বিছানায় এপাশ-ওপাশ করি। উঠে ঘাড়ে মাথায় জল দিয়ে আসি। লজ্জার কিছু নেই রে। দীপাকে আমি জানি। আমাকে ছাড়া পৃথিবীর অন্য কোনও পুরুষকে ও ভালোবাসতে পারবে না। তুই শুধু দাদার মতো ওকে একটু আড়াল দিয়ে রাখিস”।
এতক্ষণ আমরা দুজন দুজনার হাত ধরে ছিলাম। এবার আমি হাত ছেড়ে দিলাম। তালুটা ঘেমে গেছে। কতটা জানে আনন্দ। কতটা দেখেছে। আনন্দ কি জেনেশুনেই দীপাকে আলাউ করেছে? দীপা কি সব কথা আনন্দকে বলে দিত? আনন্দ কি আমাকে খুশি করার জন্য দীপাকে আমার দিকে ইচ্ছে করেই এগিয়ে দিয়েছে? খুব দ্রুত প্রশ্নগুলো আমার মাথার ভেতরে ঘুরতে শুরু করল। তাহলে আমি হেরে গেছি। বোকার মতো হেরে ভূত হয়ে গেছি। আমাকে নিয়ে বোধহয় ওরা নিজেদের ভেতরে হাসাহাসিও করত।
আনন্দ চলে গেছে। আমি একা ‘নাসিম টেলার্স’ থেকে একটু দূরে ফুটপাথের ওপর দাঁড়িয়ে আছি। নিকোটিনের জন্য রক্ত ব্যস্ত হয়ে উঠেছে। থ্রোট ক্যানসারের নামে একটা কাঁচা খিস্তি দিলাম। পাশ দিয়ে যাওয়া লোকটা ভুরু কুঁচকে আমার দিকে তাকাল। আমি আবার ফাঁকা মাঠ, কালচে-ধূসর কলকাতার আকাশ, ব্যস্ত মানুষজনের দিকে তাকিয়ে বমির মতো খিস্তি উগরে দিলাম। বাসুদার দিকে, একদুইতিন স্বরবিতানের দিকে, আমাদের ফাঁকা হয়ে যাওয়া বাড়ির দিকে।
সতেরো
“দাদা, শান্তিদা এসেছে। তোকে খুঁজছে। বলল দরকারি কথা আছে”।
বেলা ন’টা সাড়ে ন’টা হবে। গতকাল প্রায় সারারাত তুমুল বৃষ্টি হয়েছে। অগাস্টের মাঝামাঝি। এ সময়ে হঠাৎ ঝুপঝুপে বৃষ্টি, একটু পরেই খরখরে রোদ ওঠে। বরাবরই তপনের ভোরে ওঠা অভ্যাস। স্নান সেরে গরম গরম ডালভাত খেয়ে টিফিনকৌটো নিয়ে টোটোতে বাসস্ট্যান্ড। সেখান থেকে সোজা কোর্ট। আজও উঠেছিল। আকাশের এখানে ওখানে এখনও ছেঁড়া ছেঁড়া কালো মেঘ রয়েছে। সেই ফাঁক দিয়ে অগাস্ট মাসের চড়া রোদ এসে পড়েছে মাঝেরডাঙ্গায়। রোদ উঠলেও ঘাসপালা, গাছের পাতা সামান্য ভেজা রয়েছে। একটু বাদেই সব শুকিয়ে যাবে। তপন দেখল গাছের ভেজা পাতাগুলো বেশি সবুজ দেখাচ্ছে। ভিজে গেলে বোধহয় সব রং-ই ঘন দেখায়। একঝাঁক ফড়িং উড়ে বেড়াচ্ছে ঘাসের ওপর দিয়ে।
একটু এগিয়ে গেটের সামনে গিয়ে দেখল সামনের নয়ানজুলি দিয়ে প্রচণ্ড স্রোতে জল বয়ে যাচ্ছে। কলকল শব্দ স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে। কোথাকার কোন ডোবা থেকে কচুরিপানা এসে নয়ানজুলি দিয়ে ভেসে যাচ্ছে। ছোটবেলায় এখানে জাল ধরে মাছধরার কথা মনে পড়ল। নতুন জলের স্রোত পেলেই মাছগুলো উজানে যেতে চায়। সেই সুযোগ নিয়ে চালাক মানুষ ফন্দিফিকির করে ওদের ধরে ফেলে।
পুচুত করে একমুখ পেস্টের ফেনা স্রোতের দিকে ছুড়ে দিল তপন। আজ পনেরোই অগাস্ট। কোর্ট বন্ধ। ফ্ল্যাগ তোলা হবে। অনেকেই যায়। সারা সপ্তাহ যে সব ভিখারি, বাজে লোক কোর্ট-চত্বরে এলোমেলো ঘুরে বেড়ায়, তাদের জিলিপি আর সিঙ্গাড়া খাওয়ানো হয়। ফলে, একটা জমায়েত থাকে। পতাকা থেকে ফুল ঝরে পড়লে বেশ জোর হাততালি পড়ে। বন্দেমাতরম আর জয়হিন্দ অনেক দূর থেকেও শোনা যায়।
দূরে কোথাও মাইকে ‘সারে জাহা সে আচ্ছা’ বাজছে। নবীন সঙ্ঘের মাঠেই হবে। তপনের ছোটবেলার ক্লাব। রঙিন কাগজ কেটে পতাকা বানানো, অমূল্যস্যরের বক্তৃতা, প্রবীণ স্বাধীনতা সংগ্রামী পরমেশ্বর ধাড়ার জবুথবু হয়ে চেয়ারে বসে থাকা, কিশোর বাহিনীর প্যারেড – এই দিনে সব মনে পড়ে। ছাব্বিশে জানুয়ারি আর পনেরোই অগাস্ট, এই দিনগুলোয় তপন একটু আবেগপ্রবণ হয়ে পড়ে। টিভিতে স্বদেশপ্রেমের কোনও ফিল্ম বা কোথাও ‘অ্যায় মেরে ওয়াতন কে লোগো’ শুনলে তার শরীর শিরশির করে ওঠে। স্বাধীনতা-সংগ্রামীদের নিয়ে কেউ বাজে কথা বললে তার মাথায় রক্ত চড়ে যায়। কোর্টে কে যেন একবার বলেছিল– এ আজাদি ঝুটা হায়, তপন অন্যমনস্ক ভাব দেখিয়ে তার পা জুতো দিয়ে মাড়িয়ে দিয়েছিল।
এসব ভাবতে ভাবতে তপন তার কুয়োপাড়ের লাগোয়া সারি সারি দোপাটি ফুলের দিকে তাকিয়ে রইল। মরশুমি ফুল। বর্ষায় ফোটে। কত রঙ্গের দোপাটি ফুটে আছে তার ছোট্ট বাগানে। দেশি ফুলই বেশি। টগর, বেলি, গন্ধরাজ। এরা সব রাতে-ফোটা ফুল। আশ্চর্য ব্যাপার, রাতে-ফোটা ফুল প্রায় সবই সাদা। আর, তীব্রগন্ধী। নিশ্চয় কোনও কারণ আছে। প্রকৃতির নিয়মে জীবজগতের সব ঘটনার পেছনে কারণ থাকে। ভাবলে বোঝা যায় আসলে সবই টিকে থাকার কৌশল। পৃথিবীতে নিজের অস্তিত্ব আর বংশধরদের অস্তিত্ব নিশ্চিত করার কায়দা। রাতে যে সব ফুল ফোটে, সেগুলো সাদা আর তীব্র গন্ধের না হলে রাতচরা মথ ওদের খুঁজেই পেত না। কী করে পরাগমিলন হত অন্য ফুলের সঙ্গে। কী করে বয়ে যেত প্রাণের ধারা। দুনিয়াজুড়ে কী আশ্চর্য প্রাণের খেলা চলছে অনন্তকাল ধরে।
মঞ্জুলা একরকম গাছের কথা বলেছিল। জঙ্গলে আগুন লাগলে ওরা মরে যাওয়ার আগে ওদের বীজ মাটিতে ঝরিয়ে দেয়। আমি রইলাম না, কিন্তু আমার বংশধরের ভেতরে আমিই রয়ে গেলাম। সমস্ত জীবের ভেতরে এই প্রবৃত্তি কাজ করে। সব প্রাণী তীব্র আসঙ্গলিপ্সায়, প্রিয়মিলনের জন্য সমুদ্র, অরণ্য, পাহাড় পেরিয়ে ছুটতে থাকে বিপরীত লিঙ্গবিহারের জন্য। শুধু আনন্দময় সহবাস নয়, বীজ বপন করার অভ্যন্তরীণ প্রবৃত্তি তাকে ছুটিয়ে মারে। কারও কারও অপেক্ষা নিষ্ফল থেকে যায়। অনন্তকাল বয়েচলা প্রাণপ্রবাহের তাতে কিছু আসে-যায় না।
একটু একটু করে বেলা বাড়ছিল। ছেঁড়া ছেঁড়া কালো মেঘের দল উধাও হয়ে গেছে। খুব বৃষ্টি হওয়ায় আকাশ থেকে ধুলো সরে গেছে। আকাশ এখন উজ্জ্বল নীল দেখাচ্ছে। রোদে ভরে গেছে সব। ভেজা ঘাস, ভেজা গাছপালা– সব শুকিয়ে গেছে। এখন আর রোদে দাঁড়ানো যাচ্ছে না। কুয়োতলার ঝাঁকড়া লিচুগাছের নীচে এসে দাঁড়াল তপন। এবার লিলিকে এককাপ চা দিতে বলতে হবে। তারপর বারান্দায় গিয়ে বেতের মোড়ায় বসবে। রোজ সকালের চা ওখানে বসেই খায়। তখনই লিলি এসে বলল বাইরে শান্তিদা ডাকছে। বিরক্ত হল তপন। সকালের চা এখনও খাওয়া হয়নি। শান্তিদা কতক্ষণ কথা বলবে, কে জানে। আবার, শান্তিদাকে অপেক্ষা করতে বলাও ঠিক নয়। মাঝেরডাঙ্গা কর্পোরেশনে অ্যাডেড এরিয়া, এই ওয়ার্ডের কাউন্সিলার শান্তি চক্রবর্তী। আজকালকার মাথামোটা বকাউদ্দিন নেতাদের মতো নয়, তাঁর পেটে খোঁচা দিলে দু’একটা ইংরেজি ইডিয়ম, এমনকি শেক্সপিয়রের লাইনও বেরোতে পারে। রাশভারী টাইপের মানুষ। তপনকে বেশ পছন্দ করে শান্তি চক্রবর্তী। তপনকে উঠতেই হল। (চলবে)