আয়ুষ্মান চক্রবর্তী, আলিপুরদুয়ার: মাস্টারমশাইদের বয়স ১৩ কিংবা ১৪। ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে কারও বয়স ৮২, কারও কারও আবার ৬৫, ৫২। আলিপুরদুয়ারের (Alipurduar) বক্সা ব্যাঘ্র-প্রকল্পের পানিঝোরা গ্রামে গেলে এমনই দৃশ্য দেখা যাচ্ছে গত কয়েকদিন ধরে। পানিঝোরার বাসিন্দা কুলবাহাদুর ছেত্রীর পড়াশোনাটা আর হয়ে ওঠেনি সংসারের হাল ধরতে গিয়ে। তবে শেখার কোনও বয়স হয় না। তাই তো ৮২ বছর বয়সে গ্রামের খুদে ‘স্যর-ম্যাডামদের’ হাত ধরে নিজের নাম লেখা শিখছেন। স্লেটে নিজের নামটুকু লেখার পর মুখে হাসি শিক্ষক-ছাত্রের। বৃদ্ধ বললেন, ‘যখন দরকার ছিল, সেই সময়ে পড়াশোনাটা করা হয়ে ওঠেনি। এখন আমাদের নাতি, নাতনিদের বয়সিদের থেকে শিখছি। বেশ ভালো লাগছে।’
শুধু কুলবাহাদুর নন, রাজাভাতখাওয়া লাগোয়া পানিঝোরা বনবস্তির অন্য কুলবাহাদুররাও সাক্ষরতার দিকে এগোচ্ছেন। ছোটবেলায় পড়াশোনার ইচ্ছে থাকলেও কেউ আর্থিক বাধায়, কেউ কাজের চাপে ইচ্ছে থাকলেও পড়াশোনা করতে পারেননি। তাঁদের নিজের নাম, ঠিকানা লেখা শেখানোর দায়িত্ব নিয়েছে গ্রামেরই স্কুল পড়ুয়ারা। তারাই এখন শিক্ষকের ভূমিকায়। সামনেই শিক্ষক দিবস। তার আগে শিক্ষার এমন ছবি চারদিকে আলোড়ন ফেলেছে।
আপনকথা এবং জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে বইগ্রামের উদ্বোধনের দিন গ্রামের ৪৮ জন নিরক্ষরের মধ্যে তিনজনের হাত দিয়ে এই সাক্ষর অভিযানের সূচনা হয়েছিল। অষ্টম শ্রেণির দীপিকা ওরাওঁ বলল, ‘আমরা যদি ওঁদের পড়াশোনা শেখাতে পারি, সেটা তাহলে আমাদের কাছে বড় পাওনা। আমরা নিজেদের মতো করে চেষ্টা চালাচ্ছি। সবে নাম লেখানো শুরু হয়েছে।’ আরেক ‘শিক্ষক’ কলেজ পড়ুয়া সুধা টোপ্পো জানান, বাচ্চাদের অনেকেই পড়ায়। বড়দের পড়াতে কখনও দেখেননি। পড়াতে পেরে খুশি কৃতা কেরকেট্টা, রিয়া মারাক, অমৃতা মারাক, রোহন ওরাওঁরাও।
কয়েকটা বাড়ি পরে ফুলমতি নার্জিনারিও বাড়িতে গাছের ছায়ায় বসে বাংলায় নাম লিখছিলেন। তিনিও খুব খুশি। কখনও ফাঁকা সময় পেলে মাস্টারমশাইরা পড়াতে চলে যাচ্ছে পড়ুয়াদের বাড়িতে। পড়ুয়ারাও আগ্রহ নিয়ে স্লেট-চক নিয়ে বসে পড়ছেন। গত ২-৩ সপ্তাহ ধরে চেষ্টা করে পড়ুয়ারা নিজেদের ভাষায় নাম লিখতে পারছেন।
আপনকথার সম্পাদক পার্থ সাহা বললেন, ‘একজন মানুষ এবং শিক্ষক হিসাবে মনে করি, কেবল ক্লাসরুমের পঠনপাঠনই শিক্ষা নয়। আসল শিক্ষা হল জীবনে চলার পাঠ, জীবনসংগ্রামের মানসিকতা তৈরি। সেই শিক্ষাই আজ ছাত্রছাত্রীরা সঞ্চারিত করছে বইগ্রামের কমিউনিটির মধ্যে।’ কারণ আজকের যুগে দাঁড়িয়ে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন কাজে স্বাক্ষরের প্রয়োজন হয়। কিন্তু বইগ্রামের ৪৮ জন নিরক্ষর মানুষ হয়তো আর্থসামাজিক কারণে কোনওদিন প্রথাগত শিক্ষার অন্দরমহলে যেতে পারেননি। তাঁরা এখনকার প্রজন্মের হাত ধরে নাম স্বাক্ষর, ঠিকানা লেখা শিখছেন। এটা সত্যিই একটা মহৎ কাজ বলে মনে করেন পার্থ।
শুধু লেখাপড়া শেখানোই নয়, রোগব্যাধি থেকে বাঁচতে গ্রাম পরিষ্কার রাখা, বক্সার অরণ্য, নদীকে প্লাস্টিক দূষণ মুক্ত রেখে সুরক্ষিত রাখার বার্তাও প্রচার করা হচ্ছে। আপনকথার সম্পাদকের কথায়, ‘আমার বিশ্বাস, এই ১৪ জন স্বেচ্ছাসেবক ভবিষ্যতে আরও পড়াশোনা শিখে গ্রাম বদলের আলোকবর্তিকা হয়ে উঠবে।’