অভিজিৎ ঘোষ, আলিপুরদুয়ার : আরজি কর কাণ্ডের পরই রাজ্যজুড়ে হাসপাতালগুলিতে থ্রেট কালচার নিয়ে চর্চা শুরু হয়েছিল। ডাক্তারি পড়ুয়া থেকে চিকিৎসকদের বিভিন্নভাবে ভয় দেখানো থেকে শুরু করে তাঁদের ওপর প্রভাব খাটানোর অভিযোগ উঠে বিভিন্ন হাসপাতাল ও মেডিকেল কলেজের সিনিয়ার চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে। তারপর প্রায় ৮ মাস কেটে গিয়েছে। এখন আলিপুরদুয়ার জেলা হাসপাতালে থ্রেট কালচার নিয়ে অভিযোগ উঠল। তাও সেখানকার প্রাক্তন ওয়ার্ড মাস্টার অভিজিৎ দাস সিবিআইয়ের হাতে গ্রেপ্তার হওয়ার পর।
এমনিতেই অভিজিতের বিরুদ্ধে চাকরি দেওয়ার নাম করে টাকা তোলার অভিযোগ রয়েছে। তার ওপর তাঁকে নাকি ভয় পেতেন চিকিৎসকরাও। অভিজিৎকে তুষ্ট রাখতে তাঁকে দামি দামি মদের বোতল ভেট দিতেন চিকিৎসকরা। কিন্তু কেন? কারণ, হাসপাতালে চিকিৎসকদের হাজিরা নিয়ে কর্তৃপক্ষের কাছে রিপোর্ট দেওয়ার জুজু দেখাতেন অভিজিৎ। যে চিকিৎসকরা ডিউটিতে অনিয়মিত, ভয় পেতেন তাঁরাই। ভেটও দিতেন তাঁরাই।
তবে কেবল অভিজিৎ নয়, থ্রেট কালচারে নাম জড়িয়েছে এক সিনিয়ার চিকিৎসকেরও। তাঁকেও নৈবেদ্য দিতে হত কারণ চিকিৎসকদের ডিউটি রোস্টার ঠিক করার ক্ষেত্রে উত্তরবঙ্গ লবির ঘনিষ্ঠ সেই চিকিৎসকের প্রভাব ছিল। সেই চিকিৎসক নাকি এখনও জেলা হাসপাতালে কর্মরত। তবে রাজ্যের স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় উত্তরবঙ্গ লবির প্রভাব কমায় তাঁরও দাপট কমেছে।
২০২৩ সালে আলিপুরদুয়ার জেলা হাসপাতাল থেকে ছুটি নেওয়ার আগেও অভিজিৎ নিয়মিত একাধিক চিকিৎসকের কাছ থেকে মদের বোতল উপহার হিসেবে নিতেন বলে অভিযোগ। তবে পুরোনো এই ঘটনার বিষয়ে তাঁর কাছে খুব বেশি তথ্য নেই বলে জানিয়েছেন আলিপুরদুয়ার জেলা হাসপাতালের বর্তমান সুপার পরিতোষ মণ্ডল।
আউটডোর হোক না ইন্ডোর সব ক্ষেত্রেই কাজে ঢোকার আগে হাজিরার খাতায় সই করার নিয়ম রয়েছে চিকিৎসকদের জন্য। সেই খাতা থাকে হাসপাতাল সুপারের অফিসে। তবে ওই খাতায় প্রতিদিন সই করার প্রবণতা নেই চিকিৎসকদের। বাড়ি বা কোয়ার্টার থেকে সোজা হাসপাতালে এসে কাজে যোগ দেন বেশিরভাগ চিকিৎসক। পরে কোনও একদিন সেই হাজিরার খাতায় সই করে দেন। কোন চিকিৎসক নিয়মিত আসছেন না, সেদিকে নাকি নজর রাখতেন অভিজিৎ। হাসপাতালের ওয়ার্ড মাস্টার হওয়ার সুবাদে এই কাজ তাঁর কাছে ছিল জলভাত। যে চিকিৎসক নিয়মিত আসতেন না তাঁকে ভয় দেখানো হত এই বলে যে বিষয়টি নিয়ে সুপার বা জেলার স্বাস্থ্যকর্তাদের কাছে অভিযোগ করা হবে। বাধ্য হয়ে নিয়মিত ডিউটি না করা চিকিৎসকরা মুখ বন্ধ রাখতে উপহার দিতেন অভিজিৎকে।
অভিজিৎ শুধু যে চিকিৎসকের কাছ থেকে এরকমভাবে উপহার নিতেন এমনটা নয়, পুলিশের কাছ থেকেও একইরকমভাবে মদের বোতল বা অন্য উপহার নিতেন বলেও অভিযোগ উঠছে। জেলা হাসপাতালেই জেলার সব থানা এলাকার মৃতদেহের ময়নাতদন্ত হয়। সেই ময়নাতদন্ত দ্রুত করাতে হলে অভিজিৎকে বললেই কাজ হত। খালি সেজন্য তাকে ‘খুশি’ করতে হত।
অন্যদিকে, হাসপাতালে উত্তরবঙ্গ লবির ঘনিষ্ঠ ওই চিকিৎসকও প্রভাব খাটাতেন চিকিৎসকদের ওপর। সেটাকেও থ্রেট কালচারের অঙ্গ হিসেবে দেখছেন অনেক চিকিৎসক। নিজের পছন্দের চিকিৎসকের কম ডিউটি দেওয়ার ক্ষেত্রে ওই চিকিৎসক বরাবর ‘তৎপর’ ছিলেন বলে অভিযোগ। তাঁর বিরুদ্ধে মুখ খুললে বা প্রতিবাদ করলে অন্য জায়গায় বদলি করে দেওয়ার হুঁশিয়ারিও দেওয়া হত। জেলা হাসপাতালেরই এক চিকিৎসক বলেন, ‘ওই চিকিৎসক উত্তরবঙ্গ লবির অন্যতম প্রিয় পাত্র। রাজ্য স্বাস্থ্য দপ্তরে ভালো জানাশোনা রয়েছে তাঁর। মুখ খুললে বিপদে পড়ার ভয়ে কেউ কিছু বলতে চান না। তবে এখন আর তাঁর ততটা দাপট নেই।’