গদিখানা: পৃথিবীতে নদীমাতৃক সভ্যতার নজিরের অভাব নেই। প্রাচীনকাল থেকে নদীকে কেন্দ্র করে মানুষের জীবনধারণ, কৃষিকাজ, পশুপালন ও ব্যবসা-বাণিজ্য আবর্তিত হয়েছে। তবে ইতিহাসের সেসব কাহিনী চ্যাংমারিটারির বাসিন্দা নুরজামাল মিয়াঁ জানেন কি? তা বলা যায় না। জীবদ্দশায় নদীই তাঁর সবকিছু কেড়ে নিয়েছে। কলি নদীর জলে তলিয়ে গিয়েছে তাঁর সাত বিঘার তিনফসলি জমি। সেইসঙ্গে বসতভিটেটুকুও। বাস্তুহারা নুরজামাল এখন এথেলবাড়ির বাসিন্দা। বর্তমানে তিনি বেকার। বান্ধানা ওরাওঁ নামে আরেক কৃষকও তাঁর জমি নদীগর্ভে হারিয়েছেন। তাই রোজগারের জন্য তিনি বর্তমানে কেরলে পরিযায়ী শ্রমিকের কাজ করতে বাধ্য হচ্ছেন। উদ্বেগের বিষয় এই যে, বান্ধানাদের সংখ্যা ক্রমশ বাড়ছে। ধনীরামপুর-২ গ্রাম পঞ্চায়েতের কৃষক নুরজামাল একসময় ওই নদীর জলেই সোনার ফসল ফলাতেন। ধান, পাট, গম, ডাল থেকে শুরু করে নানা ধরনের শাকসবজি কিছুই বাদ ছিল না। তাই সংসারে অভাবও ছিল না। খাবারের অভাব অনুভব করেননি কোনওদিন। কিন্তু নদীবাঁধ না থাকায় তাঁর সব যে এভাবে চোখের নিমেষে তলিয়ে যাবে তা তিনি স্বপ্নেও ভাবেননি।
নদীর জন্য পেশা বদল যেন এলাকায় একটি সাধারণ ঘটনা হয়ে উঠছে। অভিযোগ, গত পাঁচ বছরে ১০০ বিঘা চাষের জমি কলি নদীর ভাঙনের কবলে চলে গিয়েছে। ফলে কৃষকদের চাষাবাদ ছেড়ে ভিনরাজ্যে অন্য পেশার টানে চলে যাওয়ার হার উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে। ইতিমধ্যেই এলাকার প্রায় ২৫ জনেরও বেশি কৃষক পেশা বদলে নিয়েছেন। নুরজামালের মতোই চ্যাংমারিটারি এলাকার আরেক কৃষক আবেদ আলিরও মুখের হাসি কেড়ে নিয়েছে খরস্রোতা কলি। চার বিঘা জমিতে চাষ করেই তিনি সারা বছরের মুখের ভাত জোটাতেন। সংসারে অন্যান্য অনটন থাকলেও খাদ্যাভাব ছিল না। নদীর ভাঙনে জমিটুকুও হারিয়ে এখন তিনি বরফ বিক্রি করে কোনওরকমে সংসার চালান। স্থানীয়দের অভিযোগ, কৃষিজমি রক্ষার জন্য প্রশাসনের সাহায্য কিংবা ক্ষতিপূরণ কিছুই মেলেনি। আবেদ বললেন, ‘যখন আমার চাষের জমি ছিল, সেসময় ভাতের অভাব হত না। এখন কাজ না করলে ভাত জোটে না। নদীবাঁধ থাকলে আজ আমার এমন অবস্থা হত না।’
ভিটেমাটিহারা নুরজামালের গলাতেও একই সুর। তাঁর কথায়, ‘নদীভাঙনে আমার সব জমি, গাছ, তলিয়ে গিয়েছে। চোখের সামনে সব দেখেও নীরব থাকতে হয়েছে। সব হারিয়ে এখন আমি নিঃস্ব।’ সম্প্রতি টানা কয়েকদিনের বৃষ্টিতে কলি নদী প্রায় ভরাট ছিল। তারপর জল কমতেই ফের পাড়ভাঙন শুরু হয়েছে। তার জেরে ধনীরামপুর-২ গ্রাম পঞ্চায়েতের চ্যাংমারিটারি এলাকায় বর্ষায় চাষ নিয়ে কৃষকদের মাথায় হাত পড়েছে। স্থানীয়দের দাবি, জনপ্রতিনিধি ও প্রশাসনকে এবিষয়ে জানিয়ে কোনও কাজ হয়নি। যদিও ফের এনিয়ে সমাধানসূত্র বের করতে জেলা প্রশাসনের দ্বারস্থ হয়েছেন এলাকাবাসী। স্থানীয়রা জানান, গত পাঁচ বছরে স্থানীয় প্লেট ওরাওঁয়ের চার বিঘা, নারুয়া ওরাওঁয়ের ছয় বিঘা, ইয়াসিন আলির তিন বিঘা, বক্কর আলির দুই বিঘা জমি নদীগর্ভে তলিয়ে গিয়েছে। তার সঙ্গে জহিরউদ্দিন আহমেদের ছয় বিঘা, নারায়ণ ভৌমিকের মোট দশ বিঘা সহ খলিলউদ্দিন, জলিলউদ্দিন, অলিলউদ্দিন ও আয়নাল মিয়াঁর মোট ১৫ বিঘা জমিও ছিল।
এবিষয়ে সেচ ও জলপথ বিভাগের আলিপুরদুয়ার ডিভিশনের নির্বাহী বাস্তুকার অমরেশ সিং-কে ফোন করা হলে তিনি ফোন ধরেননি। ক্ষতিগ্রস্ত স্থানীয় বাসিন্দা রাকিব আহমেদ বলেন, ‘বর্ষাকাল তো বটেই শীতকালেও চাষের জমি ভেঙে নদীতে তলিয়ে যায়। বিষয়টি প্রশাসন খতিয়ে দেখলে সব কৃষকই উপকৃত হবেন।’ ভাঙন ঠেকাতে দ্রুত পাড়বাঁধ দেওয়ার কাজ হোক বলে দাবি মুসাব্বর আহমেদের।