মঙ্গলবার, ১৮ মার্চ, ২০২৫

বুদ্ধি, বুদ্ধিজীবী এবং ঘৃণার এক সাম্রাজ্য

শেষ আপডেট:

মৃড়নাথ চক্রবর্তী

আজ থেকে চল্লিশ-পঞ্চাশ বছর আগে দাঁড়িয়েও বাংলায় ‘বুদ্ধিজীবী’ কথাটা নেতিবাচক অর্থে ব্যবহৃত হত না, বরং কিছুটা সম্মানসূচক অর্থেই ব্যবহৃত হত। দিনে দিনে বাংলায় সাহিত্য, সিনেমা, রাজনীতি বা দর্শনের মতোই ভাষারও মান পড়েছে। এখন বুদ্ধিজীবী বা আঁতেলের স্থান গালাগালির সঙ্গে একই ব্র্যাকেটে থাকে। কিছু মানুষ শ্রম বেচে খান, কিছু মানুষ শরীর বেচে। তেমনই যাঁরা বুদ্ধি বেচে খান, তাঁদেরই বুদ্ধিজীবী বলা হত। কিন্তু বর্তমানে সাধারণ মানুষের কাছে বুদ্ধিজীবীদের অবস্থান এত ঘৃণার উদ্রেককারী কেন? আমার মনে হয়, বর্তমানের বুদ্ধিজীবীদের পরজীবী অবস্থানের ফলে যা সুবিধাজীবীর একটা সমার্থক শব্দও বটে!

এই পরজীবীত্ব বা সুবিধাজীবীত্ব বিশ্লেষণ করতে বসলে কিছু কিছু বিষয় উঠে আসে। যাদের মধ্যে প্রধান হল, সমাজের বাকি মানুষের এই গোষ্ঠীর সঙ্গে নিজেদের একাত্ম করতে পারার অক্ষমতা। সত্যজিৎ রায় ভারতীয় দর্শককে বলেছিলেন ‘ব্যাকওয়ার্ড অডিয়েন্স’। কলেজে পড়ার সময় আমরা অনেকটা এভাবেই ভাবতাম, কিন্তু এখন এই ভাবনা ভ্রান্ত মনে হয়।

যদি সামগ্রিকভাবে দেখি, আমাদের দর্শক, পাঠক কারা? বিশ্ব ক্ষুধা সূচকে ১২৭-এর মধ্যে ১০৫-এ থাকা ভারতের মানুষ। শিক্ষা-শিল্প-কর্মসংস্থানহীন বাংলার মানুষ। আমাদের সমাজটা, এই দেশটা একটা ক্লাসরুম নয়। এই দেশের সিংহভাগ মানুষের একটা দিন কাটে পরের দিনটা কীভাবে কাটবে তার চিন্তায়। সেখানে দাঁড়িয়ে, আমি কোনও শিল্প তৈরি করলাম, কী করলাম না তা কোনও প্রভাব ফেলে না। এমনকি কোনও শিল্পই যদি কোথাও না থাকে, কিচ্ছু যাবে আসবে না। একজন শিল্পী তাঁর শিল্প তৈরি করেন তাঁর দর্শনকে প্রতিষ্ঠা করার জন্য।

আমাদের পরিচিত বুদ্ধিজীবী সমাজের একাংশের সবচেয়ে বড় সমস্যা কী? তাঁরা মনে করেন, যাঁরা তাঁদের চিন্তা বা দর্শনের সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারেন না, তাঁদের জটিল-কুটিল ফ্যাক্টরগুলো মস্তিষ্কে ধরতে পারেন না, তাঁরা পিছিয়ে পড়া মানসিকতার। শিল্পীরা এই ব্যাকওয়ার্ড অডিয়েন্সের অনেক ওপরে বিরাজ করেন। কিন্তু কখনও এটা ভাবেন না, যাঁরা তাঁদের দর্শনকে বুঝতে পারলেন না, সেখানে বোঝাতে না পারার দায়টাও তাঁদের ওপর বর্তায়।

যদি আমি একটা যুদ্ধবিরোধী ছবি বানাই এবং তা এতই জটিল হয় যে, গুটিকয়েক উচ্চমেধার মানুষ ছাড়া সাধারণ মধ্যমেধা-নিম্নমেধার মানুষ দেখতেই না যায়, তাহলে তার যুদ্ধবিরোধী দর্শনের গুরুত্বটা থাকল কোথায়! যাঁরা সিনেমাটা দেখে এলেন, তাঁরা এমনিতেও জানেন যুদ্ধবিরোধিতা কেন প্রয়োজন। কিন্তু যাঁদের মধ্যে এই যুদ্ধবিরোধী দর্শন প্রচারিত হওয়ার প্রয়োজন ছিল, তাঁরা তা ‘আঁতেল ছবি’ বলে পাশ কাটিয়ে গেলেন। ‘ওরে হাল্লা রাজার সেনা, তোরা যুদ্ধ করে করবি কী তা বল?’-এর মতো সহজ করে যদি একটা কথা বলা যায়, তবে তাকে জেমস জয়েসের ভাষায় বলার কী প্রয়োজন!

শিল্পীর প্রধান দায় শিল্পের মধ্যে দিয়ে তাঁর দর্শনকে পৌঁছে দেওয়া। অন্যথায় তা শিল্পীর ব্যর্থতা। পাঠকদের বা দর্শকদের দুর্বল মেধার বলে দিলেই শিল্পীর ব্যর্থতা ঢাকা পড়ে না। দর্শক-পাঠক যে ভাষাটা বোঝেন, সেই ভাষায় যদি শিল্পচর্চা হত, যদি সাধারণ মানুষের মনন, চিন্তন ও মেধার সঙ্গে শিল্পকর্মের সামঞ্জস্য রেখে তা তৈরি করা হত ও যদি সব বয়সের অডিয়েন্স শিল্পকর্মের সঙ্গে নিজেদের একাত্ম করতে পারত, যদি কঠিন-জটিল তত্ত্ব সহজ করে বোঝানো যেত, তাহলে কোনওদিনই ‘বুদ্ধিজীবী’ কথাটা গালাগালে রূপান্তরিত হত না।

(লেখক সাহিত্যিক। খাগড়াবাড়ির বাসিন্দা)

Uttarbanga Sambad
Uttarbanga Sambadhttps://uttarbangasambad.com/
Uttarbanga Sambad was started on 19 May 1980 in a small letterpress in Siliguri. Due to its huge popularity, in 1981 web offset press was installed. Computerized typesetting was introduced in the year 1985.

Share post:

Popular

More like this
Related

পনেরোর নামতায় বুধরামদের দুঃস্বপ্ন

  সুকান্ত নাহা বুনোট ন্যাড়া হয়ে যাওয়া জমিটা এখন প্রায়...

মিল-অমিলের যুদ্ধে যাদবপুর-জেএনইউ

  জয়ন্ত ঘোষাল জেএনইউ এবং যাদবপুর যেন দু’ভাই। যদিও দুজনের...

পাহাড়ে হোমস্টে বিপ্লবে লাল সংকেত

প্রশান্ত মল্লিক কুড়ি-বাইশ বছর আগে, যখন হোমস্টে পর্যটনের ধারণা সবেমাত্র...

যোগেন মণ্ডল : এক ইতিহাসের নায়ক

অশোক ভট্টাচার্য ১৮৭২ সালের জনগণনা থেকে জানা যায়, অবিভক্ত বাংলার...