জঙ্গিদের কি কোনও ধর্ম হয়? উত্তর- হয় না। জঙ্গিরা কি ধর্ম জেনে গুলি ছোড়ে, বোমা ফাটায়? এই প্রশ্নের উত্তরও না। প্রতিটি ধর্মই যে শান্তির কথা বলে। অথচ পহলগামে ধর্মীয় পরিচয় জেনে পর্যটকদের ওপর বর্বরোচিত হামলা করেছে জঙ্গিরা। অতীতে ভারতে যত সন্ত্রাসবাদী হামলা হয়েছে, তাতে ‘টার্গেট কিলিং’ বা বাছাই করে হত্যার নজির তেমন নেই।
কিন্তু পহলগামে জঙ্গিদের ওই ঘৃণ্য কার্যকলাপের জেরে নাগরিক সমাজের একটা বড় অংশ পাকিস্তানকে উচিত শিক্ষা দেওয়ার পাশাপাশি একটি ধর্মীয় সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে লাগাতার বিষোদ্গার করে চলেছে। অথচ জঙ্গি ও তাদের মদতদাতাদের বিরুদ্ধে ভারত সরকার বরাবর জিরো টলারেন্স নীতি নেয়। এবারও তাই নিচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি পহলগামের দোষীদের কল্পনাতীত শাস্তি দেওয়ার হুংকার দিয়েছেন।
প্রতিটি বিরোধী দল সর্বদলীয় বৈঠকে স্পষ্ট ভাষায় জানিয়ে দিয়েছে, পহলগামের ঘটনায় কেন্দ্রীয় সরকারের সমস্ত পদক্ষেপে তাদের পূর্ণ সমর্থন থাকবে। দেশবাসীর সঙ্গে শাসক-বিরোধী ঐক্যবদ্ধভাবে পহলগামের নারকীয় সন্ত্রাসের জবাব দিতে প্রস্তুত হলেও হিন্দুত্ববাদী কিছু নেতা ও সংগঠন খোলাখুলিভাবে ধর্মীয় বিদ্বেষের প্রচার চালাচ্ছেন। তাতে শামিল বিজেপিরও কিছু নেতা।
বিজেপি সাংসদ নিশিকান্ত দুবে পহলগামের ঘটনার পর সামাজিক মাধ্যমে সংবিধানের ২৬ থেকে ২৯ নম্বর অনুচ্ছেদ বাতিলের সওয়াল করেছেন। দেশের ধর্মনিরপেক্ষ নেতাদের নিন্দা করেছেন তিনি। নিশিকান্ত একা নন, আরও অনেক বিজেপি নেতার একই সুর। পশ্চিমবঙ্গেও তার অনুরণন শোনা যাচ্ছে। মুসলিম বিদ্বেষের পাশাপাশি কাশ্মীরিদের বাঁকা চোখে দেখা শুরু হয়েছে বিভিন্ন রাজ্যে।
ভিনরাজ্যে যে কাশ্মীরি মুসলিমরা পড়াশোনা করছেন কিংবা পরিযায়ী শ্রমিক হিসাবে কর্মরত, তাঁদের ওপরও হামলা হচ্ছে। ফতোয়া জারি করে কাশ্মীরিদের বাড়ি ফিরে যেতে বলা হচ্ছে। পাকিস্তান বা সেদেশের সেনাপ্রধান আসীম মুনির যে দাবিই করুন, জম্মু ও কাশ্মীর যে ভারতের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ, তাতে কোনও সংশয় নেই। অথচ পহলগামের ঘটনার পর নাগরিক সমাজের একাংশ সাধারণ কাশ্মীরি মুসলিমদের সন্দেহের চোখে দেখতে শুরু করেছেন।
এতে মানুষে মানুষে অবিশ্বাসের দুর্ভেদ্য পাঁচিল উঠতে বাধ্য। যা কখনও কাম্য নয়। জঙ্গিদের গুলিতে নিহতদের মধ্যে স্থানীয় কাশ্মীরি সৈয়দ আদিল হুসেন শা-ও ছিলেন। আবার উধমপুরে সেনা-জঙ্গি গুলির লড়াইয়ে ধর্মে মুসলিম, বাঙালি জওয়ান ঝন্টু আলি শেখ শহিদ হয়েছেন। কাজেই পহলগামের ঘটনাকে সামনে রেখে হিন্দু-মুসলিম বিভাজনের এই চেষ্টা ঘৃণ্য ও অবাঞ্ছিত।
মনে রাখা প্রয়োজন, পহলগামে পর্যটকদের ওপর হামলার নিন্দায় সাধারণ কাশ্মীরিরা রাস্তায় নেমে প্রতিবাদ করছেন। দীর্ঘ ৩৫ বছর পর গোটা কাশ্মীর উপত্যকায় বনধ পালন করেছেন স্থানীয় মানুষ। যে পর্যটকরা প্রাণভয়ে কাশ্মীর ছাড়ছেন, তাঁদের সাহায্য করছেন কাশ্মীরিরা। বিভাজনের রাজনীতিতে শান দিয়ে মেরুকরণের পথ প্রশস্ত করার এই চেষ্টায় রাশ টেনে ধরা উচিত সরকারের।
দেশের নাগরিকরা দেশেরই অপর অংশের নাগরিকদের সন্দেহের চোখে দেখলে, জঙ্গিদের দোসর বলে ভাবলে, সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে সাফল্য অধরা হয়ে যাবে। পহলগামের হত্যালীলায় ভারতের নিরাপত্তা বাহিনী এবং গোয়েন্দাদের ব্যর্থতা নিশ্চয়ই আছে। সর্বদলীয় বৈঠকে সেই গাফিলতি একপ্রকার মেনেও নিয়েছে কেন্দ্রীয় সরকার। এখন যাবতীয় ত্রুটি-বিচ্যুতি সংশোধন করে সরকারের পুরোদমে সন্ত্রাসবাদ বিরোধী অভিযানে নামা উচিত।
পাশাপাশি যাঁরা সংবিধানের ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শকে ধুলোয় মিশিয়ে বাঁটোয়ারার রাজনীতিতে ইন্ধন দিচ্ছেন, তাঁদের সংযত করাও সরকারের দায়িত্ব। স্বাধীনতার এতবছর পরও সন্ত্রাসবাদ ও তাদের মন্ত্রণাদাতাদের কেন সমূলে উপড়ে ফেলা গেল না, সেটা ভেবে দেখার সময় এসে গিয়েছে। দিনের পর দিন রক্ত ঝরতে দেখে দেশের আমজনতা ক্লান্ত। ঘৃণা, হিংসা, বিদ্বেষের মরুভূমিতে বাস্তবিকই শান্তির মরূদ্যান জরুরি হয়ে পড়েছে।