- পরাগ মিত্র
বাইক দাপিয়েও হিরো পাঁচু। এই ব্লারড ভিউ তন্বী স্ট্যাটাসে কীভাবে পোস্টাবে? মুখঝামটায় চাকা ঘুরিয়ে ফের উৎসবে। মঞ্চে নাচ ‘বাজায় বেণু…।’ যাঁদের পরে অনুষ্ঠান, তাঁদের কপালে ভ্রূকুটি, ধৈর্যে দাঁতকপাটি উৎকণ্ঠা- ‘আগের পারফরমেন্স সব আলো কি শুষে নেবে?’ ‘একটু দেখুন না…।’ ‘প্লিজ, আগে ওদিকটা দেখে আসি…’ ডজ কর্মকর্তার।
সকাল হতে না হতেই ফাগুন হাওয়ায় ‘ওরে গৃহবাসী…।’ গালে আবিরের ডিজাইনড টান। ম্যাচিং ড্রেসে কচিকাঁচা, ছেলেবুড়ো, কেষ্টবিষ্টুর শোভাযাত্রা হাসিমুখে হাত নাড়ে।
উচ্ছৃঙ্খল দোলকে সাংস্কৃতিক রাবীন্দ্রিক প্রয়াস শান্তিনিকেতনের লক্ষ্মণরেখা টপকে আজ দুয়ারে ‘বসন্ত উৎসব।’ ব্যানারে, সোশ্যাল মিডিয়ায় শহর-গঞ্জে একে অন্যকে ছাপিয়ে যাওয়ার লড়াই। ড্রিল শুরু পলাশ না ফুটতেই। নামজাদা উৎসবে সুযোগ নিয়ে দেখনদারি উমেদারি, দুই-ই সমানতালে।
আগের সন্ধ্যায় ‘বুড়ির বাড়ি’ জ্বালিয়ে উত্তরবঙ্গে পরদিন আবিরের দোল। রং মেখে বদন হারানো তারও পরদিন। সেদিন হোলি। কোথাও রেশ রয়ে যায় কাদা খেলাতে। পুরোনো জামা, বয়স্কদের প্রণাম, কপাল রাঙানোর অজুহাতে চুলেও রং। হেঁটে, সাইকেলে, রিকশায় এ বাড়ি ও পাড়া।
টিউশনে গার্লস-বয়েজ রি-এনফোর্সড দেওয়ালের যুগে বান্ধবীর বাড়ি গেলে গার্ডিয়ান হুঁকোমুখো। মেয়েদের রং খেলায় কড়া চাউনির স্ক্যানার। এত নজরের কাঁটাতার ড্রিবল করে প্রিয়ার গালে আবির যে ছোঁয়াত, তার স্পর্ধাকে কুর্নিশের অভাব হত না।
বিকেলে কচি মুখের রাধাকৃষ্ণের গানে নিধুর বাগানে হোলি খেলার ডাক। ছেলেবেলার সেই কানে শোনার বিভোরতা আজও টাটকা শিক্ষিকা সুদীপ্তা চক্রবর্তীর- ‘পাড়ার নিধুবাবুর সেই বড় বাগান কোথায়, যেখানে সবাই হোলি খেলে?’ কৃষ্ণ নয়, রাধিকা জোটানোটাই সমস্যা। মেয়ে কোথায়? স্নো- পাউডার শাড়িতে রাধিকারূপী বালকের আর্তি ‘মিনতি করি, ওহে কালাচাঁদ আর মেরো না পিচকিরি…।’ নিমন্ত্রণ কীসের? সটান রাধামাধবের পুজোতে ভরপেটে ঢেঁকুর দস্তুর। মাধুকরী প্লাস বাড়ির অনুদানে রাতে পিকনিক।
খুনি, কালি, বাঁদর রং, ড্রেনের জল, গোবর জল, পোড়া মোবিলে হোলি ছ্যা-রা-রা। দম ছিল বটে গতরে। সুগার, কোলেস্টেরল, জিমের তাড়না আকীর্ণতাহীন সেই নরদেহের চাহিদায় রেড মিটের দোকানে লম্বা লাইন। তৃপ্তি-অতৃপ্তির সীমান্তে সিদ্ধির শরবত, ভাং-এর বড়া, লুকিয়ে হাতেখড়ি। টালমাটাল পা রাস্তার পাশে চিতপটাং অচেতন। অট্টহাসিতে এ-ও’কে দেখায়, ও তাকে। গোটা সাবান ক্ষয়েও তনুতে রঙের ছাপ বহুদিন।
চিলতে টিপ দিয়ে ফ্ল্যাটবাড়িতে ‘হোলি হ্যায়’। জামা ছিঁড়ে ইলেক্ট্রিক তারে ছুড়ে রংবাজি ভ্যানিশ। রঙের ভয়হীন বিকেল ছিমছাম। ক্লাবে, ওয়াটার পার্কে ইভেন্ট ম্যানেজমেন্টেড হোলি এখন এটিকেটেড টিপটপ।
ফ্ল্যাশব্যাক দীর্ঘশ্বাস বয়ে আনলেও পরিবর্তন স্বাভাবিক সত্য। বাবার ট্যালকম পাউডারের কৌটো ঝাঁকিয়ে হোলির মৌতাতে পঁচাত্তর পেরোনো শিখা দে’ মজলেও, তাঁর নাতনি আগে সানস্ক্রিন মাখবে, তারপর বলবে ‘ইফ ভেষজ রং, দেন ওকে।’
জাতধর্ম, বর্ণের সংকীর্ণতাহীন ঐতিহ্যের উৎসবে আজ রঙেও রাজনীতি। তূণীরে ধর্মের নাগপাশ নিয়ে কেউ ওঁত পেতে। স্কাইক্র্যাপারে আঁধার পাড়াতে হঠাৎ খিটখিটে বুড়ো দিলখুশ ভেজে পিচকারির উচ্ছলে। স্কাই-ফাই যুগেও অপরাজেয় সিগনেচার টিউন ‘রং বরসে…’ জানিয়ে দেয় তরুণ হাসির অরুণ রাগে হ্যাপ্পি হোলির রং মর্মেই লেগে।
(লেখক শিক্ষক। শিলিগুড়ির বাসিন্দা)