গিজগিজ ভিড়। ভিড় ঠেলে সরু দোকানটার ভিতরে কোনওরকমে ঢুকলাম। পাশে দাঁড়ানো ভদ্রমহিলা পয়লা বৈশাখের বাজার করছেন। তাঁর কেনা নতুন শাড়ির দিকে নজর পড়ল। তখনই আমার পরে একটু দূরে দাঁড়ানো ভদ্রমহিলা বলে উঠলেন, সাদা পাঞ্জাবি দেখান। দোকানদার জিজ্ঞেস করলেন, আপনার আব্বার জন্য? ইদের নমাজের তো? জিজ্ঞেস করেই দোকানের মালিক, কর্মচারীকে হাঁক পাড়লেন, যা তো উপর সে সাদাওয়ালা বান্ডিল লে আ!
এবার ইদ ও পয়লা বৈশাখ কাছাকাছি সময়ে। তাই জমে উঠেছে বাজার। জলপাইগুড়ি জেলার কেন্দ্র মাড়োয়ারিপট্টির সব দোকানে তাই থিকথিক ভিড়। পাশাপাশি দাঁড়িয়ে কাপড় কিনছেন দুটো ভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষ।
অর্থনৈতিক উদারীকরণের হাত ধরে আসা কনজিউমারিজমের প্রভাব পড়েছে জাতিধর্মনির্বিশেষে সবার মধ্যেই। তাতে মুনাফা লুটছেন অবাঙালি ব্যবসায়ী। আর এই কনজিউমারিজমের ফলে ঝাঁ চকচকে হয়েছে আমাদের পরবগুলো। ইদও তার ব্যতিক্রম নয়।
নয়ের দশকে ছোটবেলায় দেখেছি পুরোনো সাদা পাঞ্জাবিতে রবিন ব্লু দিয়ে ইদের আগে রোদে শুকোতে দিচ্ছেন বাড়ির মেয়ে-বৌ’রা। পুরোনোটাকেই একটু নতুন করার চেষ্টা। সামর্থ্য অনুযায়ী বাড়ির সবথেকে ছোটজনকে দেওয়া হত নতুন জামা সবার আগে, তারপর টাকা জুটলে বাড়ির যাঁরা নমাজ পড়তে ইদগাহ যাবেন তাঁদের জামা। মা, নানি, মাসি এঁদের ইদগাহ যাওয়া নেই, তাই এঁদের পোশাক ছিল সবথেকে কম গুরুত্বের। ধান কিংবা আনাজপাতি বেচে হাট ফেরত বাবার জন্য উদ্গ্রীব অপেক্ষা ছিল বাড়ির ছোটদের। যদি আব্বা ইদের জামা আনে!
কিন্তু এখন…?
হাতে মোবাইল নিয়ে শপিং অ্যাপে জামা দেখছে বাড়ির মেয়ে। জামা বাড়ি পৌঁছে দিচ্ছে ডেলিভারি বয়। জামায় হাত দিয়ে সুতি কি না পরখ করে নেওয়ার রেওয়াজ গিয়েছে, এখন মোবাইল স্ক্রিনে সাজে হরেকরকম পসরা। সেটা থেকেই একটা স্বাচ্ছন্দ্যে বেছে নেয় খরিদ্দার। দরাদরি নেই, নতুন কাপড়ের গন্ধ নেই। সঙ্গে সঙ্গে হাতে টাকা গুনে দেওয়ার বিষয়ও নেই।
গত এক দশক ও বামফ্রন্ট জমানার শেষের দিকে কিছু সার্ভিস কমিশনের মাধ্যমে নিয়োগের ফলে মুসলিমদের মধ্যে এক মধ্যবিত্ত শ্রেণি তৈরি হয়েছে পশ্চিমবঙ্গে। যাঁরা সারা বছর শহরের ঘেটোতে কাটিয়ে ইদের ছুটিতে বাড়ি ফেরেন। এদের ক্রয় ক্ষমতা ঝলকে পড়ে পোশাক থেকে খাবারে। এই শ্রেণির মহিলারা এখন অনেকেই শাড়িকে পাশ কাটিয়ে লেহেঙ্গা কিংবা সারারা পরছেন।
যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নত হওয়ার ফলে গত এক দশক ও তারও বেশি সময় ধরে মুসলিম সমাজের এক বিশাল অংশ পরিযায়ী শ্রমিক হিসেবে বাইরে কর্মরত। এই অংশ বাড়িতে যে টাকা পাঠায় তা দিয়ে একটু সচ্ছলতার মুখ দেখে গ্রামের মুসলিম সমাজ। সারা বছরের সংসারের ঘানি টেনে আসা মহিলারা সবকিছু সামলেও স্বামীর পাঠানো টাকায় নতুন পোশাক কিনতে পারছেন।
পপুলিস্ট রাজনীতির রমরমা বাজারে ক্ষমতায় টিকে থাকতে দক্ষিণপন্থী দলগুলোর জনমোহিনী চমকে দীর্ঘমেয়াদি লাভ না হলেও সমস্ত মহিলাদের সঙ্গে সঙ্গে মুসলিম মহিলাদের হাতেও কিছুটা হলেও কিছু টাকা আসছে। সারাজীবন স্বামী কিংবা বাবার কাছে হাত পেতে টাকা নেওয়া ছাড়া যাঁদের গতি ছিল না, তাঁদের হাতে লক্ষ্মীর ভাণ্ডারের ১০০০/১২০০ টাকা কিন্তু অনেকটাই। তাই ব্যাংকে টাকা তুলতে গিয়ে শুনতে পাই, ম্যাডাম লক্ষ্মীর ভাণ্ডারের টাকা ঢুকেছে? টাকা ঢুকেছে শুনে স্বস্তির নিঃশ্বাস যে, ‘যাক মাইয়াটার ইদের জামা হবে’। সারাদিন পাঁচ বাড়ির কাজ সামলে বাজার ফেরত হাজরা বুবুর মুখেও তাই হাসি ফোটে, ‘লক্ষ্মীর ভাণ্ডারের টাকা তুলি সবার তানে জামা কিনিনু দিদিমণি!’ ডোল পলিটিক্সকে যতই গালাগাল দিই না কেন, ইদের বাজারে কিন্তু হাজরা কিংবা আমার গ্রামের অসংখ্য মহিলার কাছে ডাইরেক্ট ক্যাশ স্কিমগুলোর ভূমিকা অপরিসীম।
তাদেরও ইদের নতুন পোশাকে আসে আতরের খুশবু। ভোগবাদের ইদের বাজার তাই চাঙ্গা। মাড়োয়ারি ব্যবসায়ী তাই ক্যালেন্ডারে দাগিয়ে রাখে ইদের মাস। আমার ছোটবেলায় যা ছিল বিরল। তাই ছোট ইদে নিতাম সুতির জামা, বাড়িতে সবসময় পরার মতো জামা। মা বলত, পুজোয় ভালো ভ্যারাইটি আসবে, তখন উঠিয়ে রাখা জামা কিনিস। উঠিয়ে রাখা জামা বলতে যে জামা ট্রাংকে তুলে রাখা হত আর সারাবছর ধরে যতরকম সামাজিক অনুষ্ঠান কিংবা বিয়েবাড়ির সবেতেই সেই একটা জামা ছিল ভরসা। গত দশ বছরে পালটে গিয়েছে ইদের বাজার, অর্থনৈতিক উদারীকরণ, কনজিউমারিজম আর ডোল পলিটিক্সের হাত ধরে। ডোল পলিটিক্সের প্রভাব এতটাই গভীর যে, নরেন্দ্র মোদি একসময় এটাকে রেউড়ি রাজনীতি হিসেবে ব্যঙ্গ করলেও তাঁর দল বিজেপি এখন এই রাজনীতি নিয়েই কিছু রাজ্যে এগোতে চাইছে।
ইদের বাজারের এই পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে কি পালটেছে সামাজিক বা ধর্মীয় অনুষ্ঠানে শ্রমের বাজারের খোলস ও সেই বাজারে নারীদের শ্রমের শোষণ? সারা মাস জুড়ে রোজা (উপবাস) করার পর আসে খুশির ইদ যাকে আমরা আগে বলতাম ছোট ইদ (ইদুলফিতর)।
সকাল থেকে সন্ধে উপবাস রাখে সুমারি। তারপর সে মাঠে খাটতে যায়। বাড়ির সকল কাজও সে করে। সেহরিও (ভোর রাতে সূর্য ওঠার আগের খাওয়া) সে বানায়। সে শিখেছে পুরুষতন্ত্রের কাছে যে রোজা রেখে সব কাজ করা সওয়াব (পুণ্যের)। সে প্রশ্ন করে না, আমাদের শিরায় উপশিরায় বাস করা পিতৃতন্ত্র তাকে প্রশ্ন করতে শেখায়নি যে কেন তার স্বামীর বা পরিবারের জন্য নিখুঁত ইফতার তৈরিতে সমস্ত শ্রম তাকে একাই দিতে হবে? ভোগবাদের বাজারে তাই আজকের মুসলিম নারী তাঁর পছন্দ মতো পোশাক কিনতে পারলেও, শ্রমের বাজারে কিন্তু সে এখনও আগের মতোই শোষিত। আর দুর্ভাগ্যজনক যে, এই শোষণের রূপ সম্পর্কে নারীরা নিজেরাও অজ্ঞ।
যেমন নারীরা আজও অনেকে বঞ্চিত দলবদ্ধ হয়ে মসজিদে ইদের নমাজ পড়ার অধিকার বা পছন্দের স্বাধীনতা থেকে। কিছু জায়গায় এটা চালু হলেও বেশিরভাগ জায়গায় নারীদের দলবদ্ধ নমাজ নিয়ে নানা বিতর্ক আছে। স্বর্গ, নরক, পাপ, পুণ্য এসবের কচকচানি বাদ দিলে, একসঙ্গে সংঘবদ্ধ হওয়ার সুযোগ হলে পরস্পর ভাব বিনিময়ের সুযোগ আসে। আসে পরস্পরের সঙ্গে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে শেখার, জানার সুযোগ।
এই সময়ে যখন ঘৃণার বাজার ফুলেফেঁপে উঠেছে। যে ঘৃণার বাজারে প্রতিদিন মুসলিম নারীদের নানা রকম ঘৃণার শিকার হতে হচ্ছে, ইদ হয়ে উঠুক সমতার। শ্রমের বাজারে আসুক সমতা। উৎসব, পরব মানেই একা রান্নার ঘানি টানা থেকে মুক্ত হোক এবারের ইদ। ইদগাহ ভরে উঠুক সবার আগমনে। পুরুষ, নারী ও রামধনু- সবার দোয়ার কলরবে ধ্বনিত হোক বাতাস যেমন এক কবি কল্পনা করেন এক সমতার ইদের :
আম্মির ঘামের সুবাস/ছড়িয়ে পড়ুক/আব্বার পোশাকে/আম্মি এবং আব্বু/দুজনেই প্রার্থনা করুন/পাশাপাশি বসে।/আমার ছেলে খুঁজে ফিরুক/
ইদগাহ ময়দানে আমার মেয়ের/হারিয়ে যাওয়া চপ্পল।/খুতবা শুনে/আমার রামধনু বন্ধুর/ চোখ জুড়ে বৃষ্টি নামুক।
কবি এই কবিতায় কল্পনা করেছিলেন এক অন্যরকম ইদের, এক অলীক কল্পনার দেশে। বেঁচে থাক কবির স্বপ্ন। স্বপ্নেই তো লুকিয়ে থাকে একদিন সব পালটে ফেলার আলোর হদিস। ইদ হোক সমতার, ইদ হোক খুশির, ইদ হোক ভালোবাসার।
(লেখক ময়নাগুড়ির বাসিন্দা। সাহিত্যিক ও শিক্ষক)
রূপায়ণ ভট্টাচার্য মন্দিরের মতো দেখতে রাজকীয় অযোধ্যা রেলস্টেশনের এক নম্বর প্ল্যাটফর্মে ঢোকার মুখে একটি কাঠবেড়ালির…
উত্তরবঙ্গ সংবাদ ডিজিটাল ডেস্কঃ উপাচার্য নিয়োগ নিয়ে রাজনীতি বরদাস্ত নয়। স্পষ্ট জানিয়ে দিল সুপ্রিম কোর্ট।…
উত্তরবঙ্গ সংবাদ ডিজিটাল ডেস্ক: চলন্ত ট্রেনে নেশার জিনিস খাইয়ে এক মডেলকে গণধর্ষণের (Gang rape case)…
উত্তরবঙ্গ সংবাদ ডিজিটাল ডেস্ক: একে তো ঘরের মাঠে লখনউ সুপার জায়ান্টসের (Lucknow Super Giants) কাছে…
কানকি: মর্মান্তিক বাস দুর্ঘটনায় (Bus Accident) মৃত্যু হল ২ জনের। আহত চার বাংলাদেশি সহ ১৩…
উত্তরবঙ্গ সংবাদ ডিজিটাল ডেস্ক: যাত্রীবোঝাই চলন্ত বাসে আগুন (Bus catches fire) লেগে মৃত্যু হল ৮…
This website uses cookies.