রূপায়ণ ভট্টাচার্য
ওপার বাংলার অদিতি মহসিন রবীন্দ্রসংগীতে এক বিশিষ্ট নাম। গঙ্গা ও তিস্তার পারেও তাঁর ভক্ত প্রচুর। খুব সম্প্রতি তিনি ফেসবুকে লিখেছেন, ‘১৭ দিন বয়সের সরকারের কাছে এত দাবি, এত বায়না কেন! এত বছর দাবি-দাওয়া কোথায় ছিল? বন্যাবিধ্বস্ত দেশে মানুষের পাশে দাঁড়ান। সরকারকে কাজ করতে দিন। অস্থিরতা সৃষ্টি করবেন না।’
দ্বিধাবিভক্ত বাংলাদেশে স্পষ্টতই নতুন সরকারের দিকে তিনি। হাসিনার পতন ও পলায়নের পর লিখেছিলেন, ‘গতকাল ৫ অগাস্ট এক অভূতপূর্ব বিজয় অর্জিত হয়েছে শিক্ষার্থীদের হাত ধরে। কুর্নিশ ও লাল সালাম এই প্রজন্মের সন্তানদের। আমরা ভয়ে যা করতে পারিনি, তারা করে দেখিয়েছে।’ আবার এটাও সত্যি, এই অরাজকতা-দ্বেষের দেশে সাহস করে তিনি নিয়মিত প্রশ্ন তুলেছেন। ইউনূসের নতুন ‘বাংলাদ্বেষে’ যখন মুজিব পরিত্যক্ত, তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে ভয় পাচ্ছে লোকজন, তখনও অদিতি লিখেছেন, ‘রেহাই পেল না বঙ্গবন্ধুর ম্যুরাল, ভাস্কর্যও। ছয়-সাতটি বেসরকারি টেলিভিশনেও ভাঙচুর হল। এসব দেখে খুবই মর্মাহত হলাম। বঙ্গবন্ধুর অবদান আমাদেরকে সশ্রদ্ধ চিত্তে স্মরণ করতে হবে।’
হাসিনা-পরবর্তী বাংলাদেশে আমজনতার অধিকাংশের কাছে রবীন্দ্রনাথ আচমকা খলনায়ক। সেখানে ২২শে শ্রাবণ রবীন্দ্রনাথের ছবি দিয়ে অদিিত লিখলেন, ‘ভয় হতে তব অভয়মাঝে নূতন জনম দাও হে।/দীনতা হতে অক্ষয় ধনে, সংশয় হতে সত্যসদনে,/জড়তা হতে নবীন জীবনে নূতন জনম দাও হে।’ এক অর্বাচীন সেই পোস্টে গিয়ে লিখলেন, ‘কী যে বলেন নূতন জন্ম দাও। জিনকে অস্বীকার করা যায়। ইসলামি গান শিখুন, রুটিরুজি এখন ওখানে।’ পালটা লিখলেন অদিতি, ‘That’s none of your business!!!! What we will learn, we do, we earn, we say! That is really shouldn’t be your concern.’
বাংলাদেশে যখন সংখ্যালঘুরা অনেকেই ভয়ে কাঁপছেন, তখন অদিতি লিখেছেন, ‘আমরা কেউ যেন বিশৃঙ্খল না হই। আমাদের হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান ভাইবোনদের আমরা পাহারা দেব।’
আজকের জমানায় রাজনীতির প্রভাব মারাত্মক পড়ে শিল্পীদের ওপর। অদিতি যেমন সোজাসুজি কথা বলতে পারছেন, আরও দুই বিখ্যাত রবীন্দ্রসংগীত গায়িকা রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা, শামা রহমান সেভাবে কথা বলতে পারছেন না। তাঁরা ফেসবুকে অত সক্রিয়ও নন। বন্যা নিজে হাসিনার বোন রেহানার ঘনিষ্ঠ বান্ধবী। বন্যার নামে অভিযোগ উঠেছে, হাসিনার প্রভাব খাটিয়ে দখল করা জমিতে নিজের গানের স্কুল সুরের ধারা গড়ে তুলেছেন। শামা আবার আওয়ামি লিগের প্রয়াত মন্ত্রী সাজেদা চৌধুরীর ছেলের বৌ।
বাংলাদেশের সর্বকালের দুই জনপ্রিয় শিল্পী রুনা লায়লা এবং সাবিনা ইয়াসমিনেরও একই পরিস্থিতি। কোথাও কিছু বলতে পারছেন না। চুপচাপ। শাকিব খান থেকে অপু বিশ্বাস, চঞ্চল চৌধুরী থেকে মোশারফ করিমরা কেমন আছেন, তা স্পষ্ট নয়। একমাত্র পরিমণি এবং বাঁধনই প্রকাশ্যে হাসিনার বিরুদ্ধে সরব হয়েছেন। বাঁধন রাস্তায় নেমে বাঁধন হারা হয়েছেন। হাসিনা যেদিন পালালেন, সেদিন পরিমণি তাঁর গ্রেপ্তারের স্মৃতি রোমন্থন করে লিখেছিলেন, ‘তিন বছর আগে এই ৫ অগাস্ট যে ভাবে আমার স্বাধীনতা কেড়ে নিয়েছিল। প্রকৃতি হিসেব রাখে মা।’
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছাকাছি যেমন প্রচুর শিল্পী ঘোরাঘুরি করেন সুযোগ নেওয়ার জন্য, হাসিনার ক্ষেত্রেও এক ব্যাপার ছিল। সেই শিল্পীদের অনেককেই এখন খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। অনেকে জনতার রোষের মুখে। স্বেচ্ছায় গৃহবন্দি। অনেকে আবার পালটি (বাংলাদেশি ছাত্রদের ভাষায় ‘পলটি’) খেয়েছেন। ঢাকায় হিড়িক পড়ে গিয়েছে হাসিনা জমানার বহু কুখ্যাত আয়নাঘর নিয়ে সিনেমা বানানোর। ঢাকা চলচ্চিত্র পরিচালক সমিতিতে গত ১০ দিনে ৬টির মতো ছবির নাম নথিবদ্ধ হয়েছে। ঘুরেফিরে ‘আয়নাঘর’ নামটি ভবিষ্যতের অনেক সিনেমায় থাকবে। ‘ভয়ংকর আয়নাঘর’, ‘আয়নাঘর’, ‘অন্ধকারের আয়নাঘর’।
হাসিনার দেশ ভুলে মমতার রাজ্যে আসুন। এখানেও অনেক পলটি খাওয়ার পালা দেখবেন। আওয়ামি লিগের অনেক সমর্থকের বক্তব্য, হাসিনার কাছে প্রচুর সুবিধে নিয়ে অনেক শিল্পী এখন হািসনার বিরোধিতা দেখাচ্ছেন। তৃণমূলের অনেক নেতাও এক কথা বলছেন সক্ষোভে। মমতার হাত থেকে অনেক পুরস্কার নেওয়া অভিনেতা, অভিনেত্রী, গায়ক, গায়িকাদেরও দেখা যাচ্ছে প্রতিবাদী মিছিলে।
আরজি কর কাণ্ডে প্রতিবাদ অবশ্যই দরকার। স্বাস্থ্যমন্ত্রী এবং পুলিশমন্ত্রী হিসেবে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কড়া সমালোচনা প্রাপ্য। কিন্তু যেভাবে এই প্রতিবাদকে কেন্দ্র করে বহু অভিনেত্রী, অভিনেতা ব্যক্তিগত প্রচারের কাজে লাগাচ্ছেন, সেটাও নিন্দনীয়। মুখ্যমন্ত্রীর পদত্যাগ চাইতেই পারেন। তবে আগে রাজ্য সরকারের কাছে নেওয়া পুরস্কারগুলো ফেরত দিয়ে দিন। ঘোষণা করুন, সরকারের েকানও অনুষ্ঠানে আমি আর যাব না। উত্তরবঙ্গের অনেক সাহিত্যিক যেমন বলেছেন, কোনও সরকারের পুরস্কার নেব না। না কেন্দ্রের, না রাজ্যের। আশা করা যাক, সরকারের কোনও কবিতা উৎসবে কবিতা পড়তেও যাবেন না নিশ্চয়ই।
সবচেয়ে দুঃখের ব্যাপার, আরজি কর কাণ্ডে বেরিয়ে আসছে অনেক বিশিষ্টজনের দ্বিচারিতা। অনেকের হাবভাবে আন্দোলনে নেতা হওয়ার শখ।
কলকাতার অনেক অভিনেত্রী এখন এমন বিপ্লবীর সুরে বলছেন, যেন কলকাতা জঙ্গলের রাজত্ব। অথচ তাঁদের অনেককে অনেক প্রেমিকের সঙ্গে রাতবিরেতে দিব্যি ঘুরে বেড়াতে দেখা গিয়েছে। একটা সময় উত্তরবঙ্গের পাহাড়েও ঘুরে বেরিয়েছেন দিনের পর দিন। কোনও সমস্যায় পড়েননি কিন্তু। বরং তিনিই নানা বিতর্কে জড়িয়েছেন।
অনেক অভিনেত্রী নতুন করে মি টু’র অভিযোগ তুলেছেন। অথচ তাঁদের অনেককে পরিচালকের বাড়িতে দিনের পর দিন কাটাতে দেখা গিয়েছে। এক কিংবদন্তি অভিনেত্রী তাঁর ঘরের জানলা বন্ধ করে রাখতেন পাশের বাড়ির বারান্দায় অশ্লীল দৃশ্য দেখতে হবে বলে। আজ সেই তরুণী অভিনেত্রীর দাবি, পরিচালকদের হাতে হেনস্তা হতে হয়েছে। এক অভিনেত্রী অনাবশ্যক বহু পুরোনো ছবি দিয়ে আক্রমণ করেছেন এক মহিলা সাংসদকে। যে সুরে বিশ্রী কথা বলছেন, যা আসলে এক সম্ভাব্য ধর্ষকের মন্তব্য। অভিনেত্রী আবার ঘটনার ১৫ বছর পরে কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছেন মালয়ালি পরিচালককে।
পালটে যাওয়ার কথা আরও চান? এক বিধায়কের অভিনেত্রী স্ত্রী কবিতা লিখে ফেললেন। বাড়িতে লিখলে ঠিক ছিল, লিখতেই পারেন। সবাইকে জানিয়ে কবিতা লেখা। একজন শাঁখ বাজালেন। এঁদের প্রশ্ন করলে শুনবেন, ‘আমরা তো সরকারের বিরুদ্ধে নই। শুধু নির্যাতিতার বিচার চাই।’ অথচ ওই মিছিলেই মুখ্যমন্ত্রীর পদত্যাগের স্লোগান তুলেছেন অনেকে। তৃণমূলের এক সাংসদ বিজেপির প্রাক্তন সাংসদ অভিনেত্রীর পাশে বসে গল্প করলেন। ভক্তরা বলবেন, কী সৌজন্য, কী সৌজন্য! অথচ এই অভিনেত্রী মুখ্যমন্ত্রীর বিরুদ্ধে নানা কথা বলে বেড়ান। এক বিধায়ক নেমে পড়লেন মিছিলে। তাঁরও দাবি, বিচার চাই।
বাংলাদেশের মতোই এই বাংলায় এখন অনেকে দুটো রাজপথ খুলে রাখার চেষ্টায়। স্ববিরোধিতার রাজপথ। এঁরা দেখছেন, কিছু না বললে নেটিজেনরা গালাগাল দেবেন। এঁরা কথা বলতে নামছেন এবং গুলিয়ে ফেলছেন। এক অভিনেত্রীর দুটো ভিডিও ভাইরাল দেখলাম। একবার শাসকের পক্ষে বলছেন। একবার বিপক্ষে। এক অভিনেতা তৃণমূলের প্রচুর ক্ষীর খেয়ে, অনেক পদে বসে সরকারি সুবিধে নিয়ে এখন বিজেপিতে। মাঝে মাঝেই ছড়ায় প্রতিবাদ করেন। তখন ভুলে যান, তৃণমূলে কী কী সুবিধে নিয়েছেন।
রাতারাতি পালটে যাওয়ার পাশাপাশি এঁদের প্রাথমিক লক্ষ্য, নিজেদের প্রচার। মৃতপ্রায় বাংলা সিনেমা ইন্ডাস্ট্রিতে বাজার গড়তে হয় নিজেকেই। এবং সবচেয়ে মজার, এই অভিনেত্রীরা মিডিয়ার প্রতিদ্বন্দ্বিতাকে সুচতুরভাবে ব্যবহার করেন। জানেন, প্রতিদিন চটকদার কিছু না কিছু বলতে হবে। জানেন, এখন আরজি কর নিয়ে কিছু না বললে গালাগাল খেতে হবে। নির্ভয়া কাণ্ডের সময়ও এমন একটা হয়েছিল। েমামবাতি মিছিলে সন্ধ্যায় শোকের বাতাবরণে অংশ নিয়ে এক অভিনেত্রী রাতের পার্টির এক ছবি পোস্ট করেছিলেন। যা দেখে সহকর্মীরাও স্তম্ভিত।
এখনকার দিনে সোশ্যাল মিডিয়ার জনতাও সব জানে! বিজ্ঞান, সাহিত্য, ডাক্তারি, কম্পিউটার, গোয়েন্দাগিরি, সাংবাদিকতা, শিক্ষকতা। সবচেয়ে ভালো জানেন নিজস্ব প্রচার।
বাংলাদেশও এই একরকম ঘটনার সাক্ষী। একদিকে উত্তাল বাংলাদেশের একটা দিক একেবারে নিস্তব্ধ। সীমান্তের ওপারে বাংলা কাগজগুলোতে চোখ রাখলে বোঝা যায়, বিনোদন জগতের অধিকাংশ মানুষ এখন চুপ। জল মাপছেন। কাগজের বিনোদন বিভাগে টালিগঞ্জ বা মুম্বইয়ের অভিনেতা-অভিনেত্রীদের খবর। বা ঢালিউডের পুরোনো সিনেমার গল্পগাথা। যাঁর ডেট পাওয়া যেত না, সেই মাহিয়া মাহির মতো ব্যস্ত অভিনেত্রী গত একমাসে ঘরবন্দি। দু’দিনের জন্য বিদেশ গিয়েছিলেন চিকিৎসার জন্য। িবমানবন্দরে প্রশ্নের সামনে পড়তে হয়েছে ইমিগ্রেশনে।
অবশ্যই একটা ব্যাপারে সেলেবদের অনেক সুবিধে। আওয়ামি লিগের এক নেতার মৃতদেহ আবিষ্কার হয়েছে মেঘালয়ের জঙ্গলে। আওয়ামি লিগের অধিকাংশ নেতা জেলে বা বিদেশে পলাতক। তুলনায় সেলেবদের নিয়ে টানাটানি কম। তার মধ্যেই ক্রিকেটার মাশরাফি মোর্তাজার নারাইলের বাড়ি আগুন লাগিয়ে দেওয়া হয়েছে। অপরাধ, তিনি হাসিনার পার্টির সাংসদ ছিলেন। আরেক সাংসদ ক্রিকেটার সাকিব এবং অভিনেতা ফিরদৌসের নামে হয়েছে খুনের মামলা। অনেক সাংবাদিককে ফাঁসিয়ে দেওয়া হয়েছে মিথ্যে অপরাধে। মারধর করা, বাড়ি ভাঙচুর তো মাঝে কয়েকদিন জলভাত ছিল।
জনতাও যে ক্ষমতা পেলে স্বৈরাচারী নেতাদের মতো মারাত্মক ভয়ংকর হয়ে ওঠে, তা দেখছে বাংলাদেশ। জনতা প্রথমে বলবে, আপনারা চুপ কেন? আবার নিজের পছন্দমতো বক্তব্য না শুনলে সেলেবের মুণ্ডপাত করবে। এই প্রেক্ষাপটে দুই বাংলার বিনোদনের মানুষেরা যদি বলেন, দু’নৌকোয় পা দিয়ে চলাই আদর্শ, তাঁদের কি খুব দোষী বলা যায়?