কলাম

বাড়তি স্নেহেই বাবুনরা আজ এক একজন ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইন

  • রূপায়ণ ভট্টাচার্য

মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যথার্থ বলিয়াছেন। ‘লোভীদের আমি পছন্দ করি না। আমি পরিবারতন্ত্র করি না। মানুষতন্ত্র করি।’ তাঁহার কনিষ্ঠ ভ্রাতা স্বপন নামান্তরে বাবুন প্রসঙ্গে এই উপলব্ধি। মুখ্যমন্ত্রী যাহা বলেন নাই, তাহা অতীব গুরুত্বপূর্ণ। এই বাক্যটিও এখানে উদ্ধৃত করা উচিত। স্নেহ অতিশয় বিষম বস্তু।

স্নেহ যে অতীব ভয়ংকর, তাহা কলকাতা ময়দানের সঙ্গে জড়িত অধিকাংশ ব্যক্তি জ্ঞাত হইয়াছেন। নেতাজি ইন্ডোর স্টেডিয়াম হইতে যুবভারতী ক্রীড়াঙ্গন পর্যন্ত সর্বত্র মানুষ দর্শন করিয়াছে, স্নেহের ছায়ায় কীভাবে মুখ্যমন্ত্রীর দুই ভ্রাতা সর্বত্র প্রভাব বিস্তার করিয়া চলিয়াছেন বাংলার খেলায়।

আজ কমলাকান্ত জীবিত থাকিলে দর্শন করিতেন, মোহনবাগান মাঠে এক ভ্রাতার ছায়া। ইস্টবেঙ্গল মাঠে অপর ভ্রাতার। কোথায় তাঁহারা নাই? রণে অরণ্যে ঈশ্বরেরা রহিয়াছেন। আর মুখ্যমন্ত্রীর জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা ও কনিষ্ঠ ভ্রাতা রহিয়াছেন বাংলার অলিম্পিক সংস্থায়, ফুটবলে, হকিতে, টেবিল টেনিসে, কাবাডিতে, অঙ্গসৌষ্ঠবে, ভারোত্তোলনে। চলতি বাংলায় ইহাকেই বলা হইয়া থাকে, ঝালে-ঝোলে-অম্বলে। ইহা মানুষতন্ত্র নহে, বাবুনতন্ত্র।

মুখ্যমন্ত্রী বলিয়াছেন, ‘কিছু মানুষ আছে, যাদের সব ভোটে দাঁড়ানোর ইচ্ছা হয়! কাউন্সিলার, এমএলএ, এমপি- সব ভোটে দাঁড়াতে চায়।’ বাবুনের ক্ষেত্রে এই বাক্যটি প্রযোজ্য হইতে পারে। এঁদের দুই ভ্রাতার ক্ষমতালিপ্সা একেবারে অনন্য উচ্চতায় পৌঁছাইয়া গিয়াছে ময়দানে। বাবুনের মাত্রাতিরিক্ত। যাহা তাঁহাদের সহোদরাকে অতি অস্বস্তির মধ্যে ফেলিয়াছে। বারবার। প্রতিবার। অথচ মুখ্যমন্ত্রী তাঁহাদের রাশ টানিয়া ধরেননি। তাঁহারা ক্রমশ ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইন হইয়া উঠিয়াছেন ময়দানে।

১৮১৮ সালে সৃষ্টি ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইন এক অতি বিস্ময়কর উপন্যাস। সকলে মনে রাখিয়াছে সেই দৈত্যকে। তাহার সৃষ্টিকর্তা, গল্পের তরুণ বিজ্ঞানী ভিক্টর ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইনকে নহে। লেখক মেরি শেলিকে নহে। শুধু ময়দানের এই ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইনকে মনে না রাখিলেও চলিবে। বাবুন একদা তাঁহারই জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা অজিতের বিরুদ্ধে বঙ্গ অলিম্পিক সংস্থার প্রেসিডেন্ট পদে দাঁড়াইয়া পড়েন। মমতা কিছুই বলেননি সেই সময়। তাঁর নীরবতা সম্মতির লক্ষণ বুঝিয়া ময়দানি কর্তারা বাবুনের পায়ে আত্মসমর্পণ করিয়াছেন।

পনেরো বছর পূর্বে যাঁহারা ময়দানে বাবুনকে দেখিয়াছেন, তাঁহারা সবাই এই ভ্রাতার রকেটসদৃশ উত্থান দেখিয়া স্তম্ভিত। মাঠে সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ের সহিত তুলনীয় মাঠের বাইরে স্বপন উত্থান। টুটু বসু-অঞ্জন মিত্র যুগে মোহনবাগানে তাঁহাকে ক্লাব কর্মী হিসাবে দেখা যাইত তারকা ফুটবলারদের পাশাপাশি। একেবারে গা ঘেঁষিয়া দাঁড়াইতেন। যাহাতে তাঁহাকে সম্পূর্ণরূপে ছাঁটিয়া ছবি তোলা চিত্র সাংবাদিকদের পক্ষে অসম্ভব হইয়া দাঁড়াইত। দূর হইতে টুটুবাবু সহাস্য ফোড়ন কাটিতেন, ‘আবার ওভাবে ছিপকে ছবি তুলছিস রে বাবুন?’

মমতা সখেদে কহিয়াছেন, ‘বাকি সবাইকে মানুষ করেছি। হয়তো ওকেই মানুষ করতে পারিনি।’ ময়দানে প্রথমে উপহাসের পাত্র ছিলেন বাবুন। পরে দিদির বলে বলীয়ান হইয়াছেন। ময়দানের অধিকাংশ ক্রীড়া সংস্থাকে হাতের মুঠোয় লইয়া বাবুন কার্যত ছেলেখেলা করিয়াছেন। তাঁহার আমলে জাতীয় গেমসে পদক তালিকায় নিরন্তর নামিয়া চলিয়াছে বাংলা। তিনি ভ্রূক্ষেপহীন। অবিচল। রাজ্যের কোনও খেলাতেই বিন্দুমাত্র উন্নতি হয় নাই। বরং সর্বনাশ হইয়াছে।

অলিম্পিক সংস্থার প্রধান মোহনবাগানের ফুটবল সচিব, ইহা যে অতি অসম্মানের, তাহা উপলব্ধিতেই নাই বাবুনের। যেমন উপলব্ধি নাই দাদার বিরুদ্ধে সরাসরি ভোটে দাঁড়াইয়া পড়া পরিবারের পক্ষে কতটা মর্মান্তিক। ময়দানে কতটা উপহাসের পাত্র। এসব দেখিয়াও মমতার চোখ বন্ধ করিয়া থাকা যে অনুচিত ছিল, এতদিনে নিশ্চিত বুঝিবেন তিনি।

মুখ্যমন্ত্রীর দাদা যেমন অত্যন্ত অন্যায়ভাবে আইএফএ প্রেসিডেন্ট পদের পাশাপাশি ইস্টবেঙ্গল ক্লাবের কার্যকরী কমিটির সদস্য হইয়া থাকেন, মুখ্যমন্ত্রীর ভ্রাতা খেলার আইন ভাঙিয়াছেন অন্যায়ভাবে। যে কর্তাদের হাত ধরিয়া ময়দানে বাবুনের উত্থান, সেই অসিত বন্দ্যোপাধ্যায় বা অলিম্পিয়ান গুরবক্স সিং বা অঞ্জন মিত্র, সকলেরই পৃষ্ঠে কোনও না কোনও সময় ছুরি মারিয়াছেন। অনেককে সাহায্য করিয়াছেন, ইহা সত্যি। কিন্তু দিদির নাম ভাঙাইয়া কি না কী করিয়াছেন! মমতা ঠিকই কহিয়াছেন, প্রতিবার নির্বাচন আসিলেই কনিষ্ঠটির নাটক লাগিয়া থাকিত। কমলাকান্ত প্রশ্ন করিবেন, তাহা হইলে এতদিন মমতা নীরবতা ধারণ করিয়াছিলেন কেন? মোহনবাগান নির্বাচনের সময় কেন নিষেধাজ্ঞা জারি করেন নাই বাবুনের প্রতিদ্বন্দ্বিতার প্রসঙ্গে?

সম্ভবত মুখ্যমন্ত্রী ভাবিয়াছিলেন, তাঁহার এই কনিষ্ঠ ভ্রাতাটি ময়দানে পড়িয়া থাকিবেন। রাজনীতির দিকে যাইবেন না। যাইলেই বিপদ। অতীতে অপর ভাই কার্তিক অন্য দলের সহিত ঘনিষ্ঠতা বাড়াইয়া অস্বস্তির কারণ হইয়াছিলেন। কিন্তু প্রচারপ্রিয় বাবুন যে ময়দানি ভাষায় অপ্রতিরোধ্য! কৃশানু দে বা সুরজিৎ সেনগুপ্ত সুলভ থ্রু বা দৌড়ে ওস্তাদ। তিনি বিগত লোকসভা নির্বাচন হইতে দাঁড়াইবার অঙ্ক কষিয়াছেন। এবারেও সেই অঙ্ক না মিলিবার কারণে নয়াদিল্লি চলিয়া গিয়াছেন। কাহার পরিকল্পনা কে জানে। চিন্ময় নামক এক ছায়াসঙ্গী ছাড়া বাবুনকে বুদ্ধি দেওয়ার আছেটা কে?

অবিশ্বাস্য মনে হইতে পারে, তবু ইহাই সত্য। একদা বাবুনের অঙ্ক  ছিল, হাওড়ার মেয়র হইবেন। সেই কারণে তিনি কালীঘাট হইতে সরিয়া হাওড়ায় ভোটার তালিকায় নাম লিখাইয়াছিলেন। হাওড়ায় থাকিবার ব্যবস্থাও করেন। তাঁহার প্রধান লক্ষ্য প্রসূন বন্দ্যোপাধ্যায়কে টপকানো। কেননা বছর ছয়েক আগে মোহনবাগান মাঠে প্রসূনের সহিত ধাক্কাধাক্কি হইয়াছিল তাঁর। তিনি তখন অঞ্জন লবির, প্রসূন টুটুর। তখন স্বপনের পাশে ছিলেন কল্যাণ চৌবে, আজকের বিজেপি নেতা। অতঃপর স্বপন নামান্তরে বাবুন মোহনবাগান মাঠে ক্রমাগত দাদা বদল করিয়া ক্লাবটিকে তৃণমূল বাগান করিতে সাহায্য করেন। ইস্টবেঙ্গল মাঠে যাহা করেন বাবুনের জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা অজিত। ভদ্রলোক অজিত অবশ্য ভাইয়ের দাপটে সংকুচিত হইয়া যান অলিম্পিক সংস্থায়।

আপনারা কেহ যদি হেমন্তে কলিকাতা রুবি হাসপাতালের মোড় হইয়া যান, তাহা হইলে বুঝিবেন বাবুনের উদ্যোগে প্রতিবার বিশাল জগদ্ধাত্রীপুজো হইয়া থাকে। এত অর্থ আসে কী করিয়া, এই প্রশ্ন কেহই করে নাই এতদিন। কেহ জানিতে চাহে নাই, বাবুনের কালীঘাট স্পোর্টস লাভার্স অ্যাসোসিয়েশন এত বিশাল বিশাল অনুষ্ঠানের অর্থ কোথা হইতে পায়। কী করিয়া তাঁহার ফুটবল ক্লাব চলে। এবারই জানুয়ারিতে তাঁহার সংস্থার রক্তদানের অনুষ্ঠানে ছিলেন সুব্রত বক্সী, ববি হাকিম, শোভনদেব চট্টোপাধ্যায়, চন্দ্রিমা ভট্টাচার্য, অরূপ বিশ্বাস, ইন্দ্রনীল সেন প্রমুখ এক ঝাঁক নেতা-মন্ত্রী।

বাবুনের ফেসবুক পেজের পরিচয়ে লেখা রহিয়াছে, তৃণমূলের স্পোর্টস সেলের চেয়ারম্যান। কীসের স্পোর্টস সেল, হে মহাশয়? ময়দানের কিছু কর্তা তাঁহাকে আকাশে তুলিয়া নিজেদের স্বার্থসিদ্ধি করিয়াছেন। খেলাগুলো ডুবাইয়া। ইদানীং ক্রীড়ামন্ত্রী অরূপ বিশ্বাসের সহিতও টক্কর লইতে দ্বিধা করিতেন না। এমনিতে দিলখোলা হইলে কী হইবে, উচ্চাশা অসম্ভব। তাঁহার অপর স্বপ্ন ছিল, মোহনবাগানেও সচিব হইবেন। দেবাশিস দত্ত হইতে পারেন, তিনি হইবেন না কেন? স্বপ্ন পূরণের জন্য যত দূর সম্ভব, এই ভ্রাতা স্বপন যাইতে পারিতেন। তবে মানিতেই হইবে, তাঁহার জনসংযোগ অতীব চমৎকার।

কমলাকান্ত কহিতে পারেন, এবার কী হইবে? উত্তরে বলিতে পারা যায়, কিছুই হইবে না। কলকাতা ময়দান জানে, অদম্য বাবুন কী করিতে পারেন। তিনি কিছুদিন নিশ্চুপ হইয়া থাকিবেন। আবার প্রবল বিক্রমে প্রাচীন রূপে নামিয়া পড়িবেন ময়দানি রাজনীতিতে। তিনি জানেন, স্নেহশীলা দিদি বেশিদিন রাগ করিয়া থাকিতে পারেন না। মা ভৈ। মুকুল, অর্জুন, বাবুল, রাজীব সবাই পার্টি পালটাইয়াও পুনরায় স্নেহ পাইয়াছেন। বাবুন পাইবেন না, তাহা কী করিয়া হয়? স্নেহ অতীব বিষম বস্তু।

Uttarbanga Sambad

Uttarbanga Sambad was started on 19 May 1980 in a small letterpress in Siliguri. Due to its huge popularity, in 1981 web offset press was installed. Computerized typesetting was introduced in the year 1985.

Recent Posts

coal smuggling case | কয়লা পাচার মামলা: সিবিআই আদালতে আত্মসমর্পণ লালার, শর্তসাপেক্ষে পেলেন জামিন

রাজা বন্দ্যোপাধ্যায়, আসানসোল: আসানসোলের বিশেষ সিবিআই আদালত থেকে শর্ত সাপেক্ষে জামিন পেলেন কয়লা পাচার মামলার…

39 mins ago

স্বপ্নের নাম হতে পারে তেঁতুলিয়া করিডর

  অমিত দে উত্তরবঙ্গে প্রতিবার লোকসভা ভোটের মুখে যেসব নির্বাচনি ইস্যু ভেসে আসে তার অন্যতম…

50 mins ago

Gourd Farming | ৭ ফুট লম্বা লাউ চাষ করে তাক লাগালেন তুফানগঞ্জের রূপম

তুফানগঞ্জ: লম্বায় ৭-৮ ফুট। উত্তরপ্রদেশে এই লাউয়ের চাষ হয়ে থাকে বলেই জানা যায়। এবার উত্তরবঙ্গের…

57 mins ago

দেশের নির্বাচন আর একতরফা নয়

  উত্তম সেনগুপ্ত ভোটের মাঝপথে এসে দুটো ট্রেন্ড স্পষ্ট। প্রথমত, এটি আর একটা ঘোড়ার দৌড়…

1 hour ago

বেহাল সেতু সংস্কারের দাবিতে পথ অবরোধ গোসানিমারিতে

সিতাই: বেহাল সেতু সংস্কারের দাবিতে পথ অবরোধ করে বিক্ষোভ দেখালেন বাসিন্দারা। মঙ্গলবার ঘটনাটি ঘটেছে দিনহাটা…

2 hours ago

Accident | ভুটভুটির চাকা ফেটে দুর্ঘটনা, গুরুতর আহত তিন

কুমারগঞ্জ: ভুটভুটির চাকা ফেটে দুর্ঘটনা ঘটল। সোমবার রাত আটটা নাগাদ কুমারগঞ্জ থানার জাখিরপুর গ্রাম পঞ্চায়েতের…

2 hours ago

This website uses cookies.