কিছু ওয়েব সিরিজ ও সিনেমার চিত্রনাট্য, চরিত্রের সঙ্গে কত মিল আমাদের জীবনের। ‘কোটা ফ্যাক্টরি’, ‘অ্যাসপিরেন্ট’, ‘টুয়েলভথ ফেল’ রূপকথার গল্প নয়। সেখানে সফলতার সঙ্গে সঙ্গে পারিবারিক সমস্যা, ব্যর্থতা, বন্ধুত্ব, বাধাবিপত্তি, সেল্ফ ডাউট- সবই রয়েছে। যেখানে ফিকশনের সঙ্গে বাস্তবের মিল খোঁজে তরুণ প্রজন্ম।
চিরদীপা বিশ্বাস
‘ম্যায় হি র্যাহ গ্যায়া ভাইয়া, সবকা হো গ্যায়া’- কথাটা ঠিক যেন বুকের বাঁ দিকটায় এসে ধাক্কা দিল দু’বারের নিট ড্রপার কনকের। হৃদয়ের ডাক্তার হবে, ক্লাস নাইনের বায়োলজি প্রোজেক্টে হার্টের মডেল বানানোর সময়ই তা ঠিক করে নিয়েছিল সে। তাই মাধ্যমিকে ব্লকসেরা হয়ে স্ব-ইচ্ছাতেই বিজ্ঞানের দুনিয়ায় তার প্রবেশ। অতঃপর উচ্চমাধ্যমিকেও নজরকাড়া ফল। তবে আনন্দ-উচ্ছ্বাসের রেশ ঘুচিয়ে দিয়েছিল ডাক্তারি প্রবেশিকা পরীক্ষার ফলাফল।
প্রথমবার এত বড় একটা ধস এলোমেলো করে দিয়েছিল বরাবরের টপার কনকের জীবনটা। নিজেকে বুঝিয়ে, মন শক্ত করে দ্বিতীয়বারের জন্য প্রস্তুতি শুরু করেছিল। তবে সেবারেও ভাগ্য সহায় হল না তার। দ্বিতীয়বারের ধাক্কা সামলে জোরসে ‘রিস্টার্ট’ বোতামটা চেপেছিল। ‘টুয়েলভথ ফেল’-এর মনোজ কুমারের মতো মনপ্রাণ ঢেলে তৃতীয়বারের প্রস্তুতি শুরু করল সে। কিন্তু না, সাফল্য ধরা দিল না এবারেও। বরং মাথার ওপর এগজাম স্ক্যাম, পেপার লিকের মতো বড় বড় শব্দ ঘুরপাক খাওয়া শুরু হল। ক্লাসমেটদের অনেকেই প্রায় স্বাবলম্বী হওয়ার পথে, কিন্তু কনকের কী হবে… ফাইট ব্যাক আদৌ করতে পারবে তো কনক!
‘কোটা ফ্যাক্টরি’, ‘অ্যাসপিরেন্ট’ কনকের পুরোপুরি দেখা হয়ে ওঠেনি পড়ার চাপে। তবে হোয়াটসঅ্যাপ স্ট্যাটাস বা টুকটাক ফেসবুক ভিডিওর দৌলতে জিতু ভাইয়া বা সন্দীপ ভাইয়াদের সে চেনে। লাখো লাখো পড়ুয়াদের সফলতা-অসফলতার দোসর এই কাহিনীর চরিত্রগুলো। নবপ্রজন্ম মিনা, বৈভব, উদয়, ভার্তিকা, শিবাঙ্গিদের মধ্যে ‘আরে এটা তো আমি’-কে খুঁজে পায়।
তাদের বন্ধুত্ব, প্রেম, প্রতিকূলতায় নিজেদের ছায়া দেখে। তাই কোথাও গিয়ে এগুলো যেন হয়ে ওঠে ‘গল্প হলেও সত্যি’। ওদের ওঠাপড়ায় আমরা কেঁদে ফেলি, ওদের খুশি আমাদের আনন্দ দেয়, ওদের জয় অনুপ্রেরণা জোগায়, শেখায় ভালো থাকার মন্ত্র। ওরা প্রমাণ করে দেয়, রিললাইফ আদতে রিয়েল লাইফেরই প্রতিচ্ছবি।
তবে এতসব বাস্তবতার মাঝেও শূন্যতা কাজ করে, ‘আমাদের পাশে জিতু ভাইয়া, সন্দীপ ভাইয়া বা গৌরী ভাইয়া কই?’ জীবনের চরম দোলাচলে ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যাওয়া আমাদের বুকে জড়িয়ে ধরার জন্য বাস্তবতায় জিতু ভাইয়াদের পাশে পাওয়া যায় না। আমরা হাতড়ে বেড়াই এরকমই ভরসাযোগ্য একটা কাঁধ। একশোর মধ্যে দুজন এমন কাউকে পেয়ে গেলেও বাকি আটানব্বইজনই দিশেহারা হয়ে পড়ে। সদ্য কুড়ির কোঠায় পা দেওয়া এই ছাত্রছাত্রীদের পরিবারও কখনো-কখনো বুঝতে অপারগ হয় যে, পড়াশোনা বাদেও তাদের আরও অনেকরকমের ইচ্ছা-অনিচ্ছা থাকে।
‘দুনিয়া ভর কি ইনফ্যাচুয়েশন’, ফিলিংস তারা কারও সঙ্গে শেয়ার করতে পারে না। যা জিতু ভাইয়াদের মতো কেউ থাকলে হয়তো ঝট করে ধরে ফেলত।
তাই নিজেদের অভিলাষ, মনোজ বা বৈভবের সঙ্গে গুলিয়ে ফেললেও সন্দীপ, গৌরী বা জিতু ভাইয়াদের অনুপস্থিতি ‘রিয়েলিটি চেক’ দিয়ে দেয়। তবে এই ধরনের চরিত্র যে শুধু বলিউডি হিন্দি সিনেমা, সিরিজের জগতেই রয়েছে, এমনটা কিন্তু নয়।
মাদের একান্ত আপন ক্ষিদ্দার কথা এক্ষেত্রে ভুললে চলবে কীভাবে! তার অবর্তমানে কনকচাঁপা সকলের চোখে ‘কোনি’ হয়ে উঠতে পারত কি? তবে আজকালকার কনকদের পেছনে ক্ষিদ্দা হয়ে দঁাড়ানোর লোক খুব কম। তাই তাদের নিজেদের লড়াই নিজেকেই করতে হয় আর নিজের পিঠে চাবুক মেরে বলতে হয় ‘ফাইট, কোনি ফাইট’।
(প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী, কোচবিহারের বাসিন্দা)