কলাম

আমার আমিষ, আমার অধিকার

  • রূপায়ণ ভট্টাচার্য

আপনি বাড়িতে বসে খাচ্ছেন আড় মাছের সর্ষের পদ, ইলিশ ভাপা, কচু চিংড়ি। হঠাৎ শুনলেন, বাড়ির বাইরে স্লোগান হচ্ছে। চলবে না, চলবে না। আপনি হয়তো ভাবলেন, পাশের পথ দিয়ে কোনও মিছিল যাচ্ছে।জানলা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে দেখলেন, আপনার বাড়ির নীচেই সবাই দাঁড়িয়ে। আপনার দিকে তাকিয়েই লোকে চ্যাঁচাচ্ছে, আপনি আজ আমিষ খাচ্ছেন কেন?

ইয়ার্কি নয়। সেদিন হয়তো আর দূরে নেই।

প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ক’দিন আগে জম্মুর উধমপুরে নবরাত্রিতে আমিষ খাওয়া নিয়ে এমন সুতীব্র ব্যঙ্গ করেছেন, দেশের অধিকাংশ আমিষাশীর মধ্যে আতঙ্ক  ছড়ালে দোষ দেওয়া যাবে না। এতদিন শুধু গোমাংস ভক্ষণের বিরুদ্ধে মোদি ভক্তরা সোচ্চার ছিলেন। এবার আমিষ খাবারেই হাত পড়ল?

মোদির কথা বলার স্টাইল আছে একটা। উনি এসব বিতর্কিত কথা বলে যোগ করে দেন, ‘এটা মানতে হবে, তা নয়।’ তারপরে এমনভাবে ‘কিন্তু’ শব্দ যোগ করে পরবর্তী বাক্য বলেন, সেখানেই সব অব্যক্ত কথা বলা হয়ে যায়। ওইভাবেই তিনি কার্যত নবরাত্রিতে আমিষ খাওয়ার বিরুদ্ধে রায় দিয়ে দিয়েছেন। আমিষের সঙ্গে মিশিয়েছেন মোগল সংস্কৃতি। এবং সঙ্গে সঙ্গে সরব তাঁর লক্ষাধিক ভক্ত।

এই কথাগুলো কোনও শঙ্করাচার্য বললে তবু মানে ছিল। বা পুরোনো আমলের পাড়ার কোনও দিদিমা। দেশজুড়ে পাহাড়প্রমাণ সমস্যা, তার মাঝে আমিষ-নিরামিষ নিয়ে ভাবার সময় কী করে হয় অসীম ক্ষমতাধর দশ বছরের প্রধানমন্ত্রীর?

আমিষ এইভাবে ভোটের অস্ত্র হলে এই ভারতকে বিশ্বসেরা হতে ঠেকায় কে? তবে আমিষাশীদের বিরুদ্ধে সরবদের জানা উচিত, অসংখ্য গ্রাম ও শহরে নানা পুজোয় এখনও বলি হয়। এবং সেই মাংস মহাপ্রসাদের স্বীকৃতি পেয়ে থাকে। নিরামিষ খেলেই শুধু স্বর্গবাস ন‌িশ্চিত নয় তা হলে। কালীঘাটের মতো বাঙালির অনেক বাড়িতেও আজও ‘নিরামিষ মাংস’ হয়। পেঁয়াজ-রসুন ছাড়া মাংস। সরস্বতীপুজোয় জোড়া ইলিশ মাস্ট বহু জায়গায়। অথচ প্রধানমন্ত্রী ব্যঙ্গ করছেন, মাটন বানানে কে মৌজ লে রহা হ্যায়। ইয়ে… মানে এভাবে চললে একদিন দেখব, কোনও নেতা ফতোয়া দিচ্ছেন, বিধবাদের মাছ-মাংস-ডিম খাওয়া চলবে না। প্রোটিন দরকার নেই।

আমিষাশীদের বিরুদ্ধে কামান দেগে মোদি বিরোধীদের হাতে এভাবে অজান্তে অস্ত্র তুলে দিলেন, ভাবাটা ভুল। এর পিছনে আছে সুনির্দিষ্ট অঙ্ক। যে অঙ্কে দেশে একের পর এক শহর হয়ে উঠছে নিরামিষাশী।

বলিউডে যাঁরা কাজ করেন, তাঁদের সঙ্গে কথা বললে আরও অত্যাশ্চর্য তথ্য উঠে আসে। চমকে যাবেন শুনলে। যে কোনও হিন্দি সিরিয়ালে আজ খাবারের দৃশ্য দেখালে সেখানে কোনও আমিষ খাবার দেখানো নৈব নৈব চ। চ্যানেল ছাড়পত্রই দেবে না। খাবারের দৃশ্যে নিরামিষ খাবার দেখাতে হবে। বাড়ি বা রেস্তোরাঁয় যত চিকেন বিরিয়ানি, বাটার চিকেন, মাটন শামি কাবাব খান না, কোনও সিরিয়ালে এসব খাওয়া চলবে না। যুক্তি, হিন্দি বলয়ে, গুজরাট বা রাজস্থানে টিআরপি আর উঠবে না। দর্শক বর্জন করবে। সোশ্যাল মিডিয়ায় ছিছিক্কার হবে। বাংলা টিভি সিরিয়ালে কিন্তু এই সমস্যা নেই। একই চ্যানেল। তবু আমিষে সেখানে আপত্তি নেই।

দিনকয়েক আগে আমাদের এক বন্ধু দিল্লিতে বাংলা নববর্ষের দিন নেমন্তন্ন করেছেন অফিসের বন্ধুদের। বাংলার খাবার খাওয়াবেন, পরিকল্পনা। মাছ, মাংস। তো পাঁঠার মাংস খুঁজতে গিয়েই পাগল অবস্থা। সব মাংসের দোকান বন্ধ। বহুদূরের গোল মার্কেটে গিয়ে বন্ধু দেখলেন, সেখানে চেনা দোকানগুলোর সামনের গেট বন্ধ। পিছনের গেট দিয়ে কোনওমতে পাঁঠার মাংস আনা হল। রাজধানীই এই ছবি দেখালে গ্রামের অবস্থা কী হবে, ভেবে আতঙ্ক  বাড়ে।

এইভাবে আমরা চলেছি কোন অনির্দেশ্য যাত্রায়? সাম্প্রতিক এক সমীক্ষা বলছে, দেশে ৬৭ লক্ষ বাচ্চা খাবার পায় না। আর আমরা ২০২৪ সালে লড়ে যাচ্ছি আমিষ বনাম নিরামিষ নিয়ে। আপনি আমিষের পক্ষে মানে আপনি বিজেপি বিরোধী। আপনি আমিষের বিপক্ষে মানে আপনি বিজেপি সমর্থক। হিন্দি বলয়ে এই টানাপোড়েন দাঁড়িয়ে বিপজ্জনক মোড়ে।

২০২১ সালের সরকারি সমীক্ষায় দেখছি, দেশে দশজনের মধ্যে ৭ জনই আমিষপ্রেমী। বাংলাই সবার আগে। আমিষ ভক্তিতে বাংলার (৯৮.৭ শতাংশ) গায়ে গায়ে অন্ধ্র (৯৮.৪), তামিলনাডু (৯৭.৮), কেরল (৯৭.৪), কর্ণাটক (৭৯.১), অসম (৭৮.৬)। মাঝারি জায়গায়  নয়াদিল্লি (৬৩.২), মহারাষ্ট্র (৫৯),  উত্তরপ্রদেশ (৫৫), মধ্যপ্রদেশ (৫১.১)। মোদির নিজের রাজ্য গুজরাটে আহমেদাবাদ সহ অনেক শহরে আমিষ বন্ধ। তবু আমিষাশীর সংখ্যা কম নয় ৩৯.৯ শতাংশ। রাজস্থান যেখানে ২৬.৮।

লেখাটা আমিষ বনাম নিরামিষের নয়। সেই পথে হাঁটতেও চাই না। যে রাজ্যে সবচেয়ে বেশি আমিষের চল, সেই বাংলাতেই বাঙালি নিরামিষ পদ এত অজস্র, চমকে দেবে অনেককে। শুধু স্বাদে নয়, বৈচিত্র্যে লা-জবাব। এমনিতে নিরামিষ পদের দাম পর্যন্ত আমিষের থেকে দামি বহু ক্ষেত্রে। এখানে আসল প্রশ্ন থাকছে খাবার বাছার অধিকারের। নেতারা, পার্টিগুলো কি এবার থেকে আমাদের খাবারের পদও ঠিক করে দেবে? তাহলে আর গ্রামে সালিশি সভা বসলে আমরা বিদ্রুপ করি কেন?

মানুষ যে ভাগ হতে পারে, তা জানা ছিল না আমাদের শৈশবে। এখন দেখি, মানুষও ভাগ হয়ে গিয়েছে নিজেদের অজান্তে। হতে হতে হতে কত ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ভাগ। শুধু হিন্দুদের মধ্যেই কত বিভাজন আজ।

ভালোবাসা ভাগ হয়ে গিয়েছে। আজও হিন্দু-মুসলিম প্রেমিক প্রেমিকা দেখলে আমরা ভ্রূ কুঁচকে তাকাই। পোশাক কী পরব, রায় দিচ্ছেন নেতারা। প্রেমেও তাঁরা ফতোয়া দিচ্ছেন।

এবার দেখছি, খাবার ভাগ। নেতারাই ঠিক করে দেবেন, আমরা কোন খাবারটা খাব, কোনটা খাব না। গোমাংস, শুয়োরের মাংসের বহুপ্রাচীন তর্ক ছাড়িয়ে আমরা চলে যাচ্ছি আরও অনেক দূরে। আমরা নিজেরাই নিজেদের হাত বেঁধে নেতাদের বলছি, স্যর এভাবে আপনার সঙ্গে পিছন পিছন যেতে চাই। হৃষীকেশ, বারাণসী, হরিদ্বার, মাদুরাই, অযোধ্যা, বৃন্দাবনে আমিষ বন্ধের কারণ তবু বোঝা যায়।  গুরুগ্রামের মতো কসমোপলিটান শহরে যদি মঙ্গলবার সব মাংসের দোকান বন্ধের নির্দেশ দেওয়া হয়, তা কীভাবে ব্যাখ্যা করবেন?  এই নেতাদের যত আপত্তি আমিষে, মদ বিক্রিতে নেই। রামনবমীর মিছিলের পাশে মদের বোতল হাতে বসে থাকলে প্রশ্ন উঠবে না, চিকেন কাবাব খেলে দাঙ্গা হওয়ার উপক্রম হবে।

দেশে সরকারি হিসেবে নিরামিষাশীর সংখ্যা দেখানো হয়েছিল ২৩ শতাংশ থেকে ৩৭ শতাংশ। কিন্তু আমেরিকাপ্রবাসী বালমুরলী নটরাজন ও সুরজ জ্যাকব সাম্প্রতিক সমীক্ষায় প্রমাণ দিয়ে বলেছেন, সংখ্যাটা আসলে বেশি দেখানো। অনেকেই সাংস্কৃতিক বা রাজনৈতিক কারণে বলতে চান না আমিষ খাই। বাড়ির বাইরে গিয়ে আমিষ খান। আসলে ভারতে নিরামিষাশীর সংখ্যা হবে ২০ শতাংশ।

প্রশ্নটা আরও অনেক গভীরে যাওয়ার। রাজনীতি আরও কত সর্বগ্রাসী ক্ষুধায় গ্রাস করে নেবে আমাদের শান্তি, আমাদের সর্বস্ব? চাঁদ সর্বত্রই ঝলসানো রুটির মতো। আমরা মানুষ ভাগ করে দিয়েছি। ভালোবাসা ভাগ করে দিয়েছি। খাবারও এবার ভাগ করে দেব তাহলে?

Uttarbanga Sambad

Uttarbanga Sambad was started on 19 May 1980 in a small letterpress in Siliguri. Due to its huge popularity, in 1981 web offset press was installed. Computerized typesetting was introduced in the year 1985.

Recent Posts

আছড়ে পড়ল ৬০টি রকেট! ইজ়রায়েলের বিমানঘাঁটিতে হামলা ইরানের সমর্থনপুষ্ট হিজ়বুল্লা বাহিনীরইজ়রায়েলের সেনাঘাঁটি লক্ষ্য করে হামলা…

5 mins ago

Aishwarya Rai Bachchan | ভাঙা হাতেই কানের রেড কার্পেটে দ্যুতি ছড়ালেন ঐশ্বর্য

উত্তরবঙ্গ সংবাদ ডিজিটাল ডেস্ক: ৭৭তম কান চলচ্চিত্র উৎসবের দ্বিতীয় দিনে রেড কার্পেটে নজর কাড়লেন বলিউড…

1 hour ago

Weather Report | তীব্র তাপপ্রবাহে বাড়ছে অস্বস্তি, সোমেই হাওয়া বদল বঙ্গে

উত্তরবঙ্গ সংবাদ ডিজিটাল ডেস্ক: ফের তীব্র গরমে পুড়ছে রাজ্যবাসী। শনি ও রবিবার উত্তর ও দক্ষিণ…

2 hours ago

Sex Worker | ঘরের বৌকে যৌনকর্মী হতে চাপ! কাঠগড়ায় স্বামী-শাশুড়ি

শিলিগুড়ি: সন্তান জন্মের পর থেকেই বাড়ির বৌকে যৌন ব্যবসায় নামানোর জন্য চাপ দিচ্ছেন খোদ স্বামী…

12 hours ago

Siliguri | গৃহবধূকে দুই মেয়ে সহ বাড়ি থেকে বের করে দেওয়ার অভিযোগ শাশুড়ির বিরুদ্ধে

শিলিগুড়ি: স্বামীর মৃত্যুর পর থেকেই গৃহবধূকে অত্যাচারের অভিযোগ শাশুড়ি ও ননদের বিরুদ্ধে। দুই কন্যা সন্তান…

13 hours ago

Manikchak | তৃণমূল অঞ্চল সভাপতিকে প্রাণে মারার চেষ্টার অভিযোগ, কাঠগড়ায় কংগ্রেস

মানিকচক: তৃণমূল (TMC) অঞ্চল সভাপতিকে প্রাণে মারার চেষ্টার অভিযোগ উঠল কংগ্রেসের (Congress) বিরুদ্ধে। মালদার মানিকচকের…

14 hours ago

This website uses cookies.