মঙ্গলবার, ১৮ মার্চ, ২০২৫

সেই ঘনঘটার সঠিক চিত্র কি তুলে ধরা সম্ভব!

শেষ আপডেট:

  • প্রফুল্ল রায়

নিজের জীবন নিয়ে যে ধরনের পরীক্ষানিরীক্ষা করেছি আজীবন, আজ জীবনের শেষবেলায় দাঁড়িয়ে মনে হয়- সত্যিই অভিনব। আমার এক বিচিত্র খেয়াল ছিল। হুটহাট করে বেরিয়ে পড়তাম। হয়তো পকেটে শ-খানেক টাকা আছে, অমনি বেরিয়ে পড়লাম। দুম করে একটা স্টেশনে গিয়ে টিকিট কেটে ট্রেনে উঠে পড়লাম। কিন্তু ঠিক কোথায় যাব, কোথায় যেতে চাই, সেসব জানি না। হঠাৎ করে হয়তো নেমে পড়লাম নতুন স্টেশনে। হইহই করে মানুষ ঘুরে বেড়াচ্ছে। আমার কাছে সেসব নতুন মুখ, নতুন চরিত্র। কত রকমারি চরিত্র। কত ভালো মানুষ। ভালো লোকজন। খারাপ লোকজন। ওইসব অচেনা-অজানা মানুষজনের সঙ্গে আমার মিশে যেতে বেশ ভালো লাগত।

এককালে বিহারে বহুদিন কাটিয়েছি। কাজ করেছি। ওখানকার ল্যান্ড সিস্টেম, বেগারি প্রথা, বন্ডেড লেবার, ছুঁতমার্গ, আবহমান কালের শোষণ, প্রতিরোধ, প্রতিবাদ- সবমিলিয়ে ডজনখানেকের উপর উপন্যাস লিখেছি। গল্পও লিখেছি দু’ডজনের উপরে। সবই বিহারের প্রেক্ষাপটে। বিহার আমার গল্প-উপন্যাসের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কেন জানি না, ছোটবেলা থেকে পিছিয়েপড়া মানুষদের ওপর আমার অসীম আগ্রহ। বিহারে সাধারণ মানুষের বাড়িতে থেকেছি, কাছে থেকে তাদের জীবনযাপন ঘনিষ্ঠভাবে দেখার অভিজ্ঞতা হয়েছে আমার।

এই প্রসঙ্গে মহাশ্বেতা দেবীর কথা আসে। তিনি ভোজপুর-ছোটনাগপুর নিয়ে লেখালেখি করেছেন। আমি মূলত উত্তর বিহার নিয়ে লিখেছি। সতীনাথ ভাদুড়ীও এই প্রেক্ষাপটে কাজ করেছিলেন। সে অবশ্য আমার অনেক আগের কথা। তাঁর ‘ঢোঁড়াই চরিতমানস’ এবং উত্তর বিহারের পটভূমিতে অনেকগুলো গল্প বাংলা সাহিত্যে স্মরণীয় হয়ে থাকবে। তেমনি মহাশ্বেতাদির ‘চোট্টি মুন্ডা ও তার তীর’, ‘রুদালি’, ‘শ্রীশ্রী গণেশ মহিমা’, ‘অরণ্যের অধিকার’ প্রভৃতি উপন্যাস বাংলা সাহিত্যের গরিমা বৃদ্ধি করেছে। বিহারের পটভূমিতে আমার লেখা উপন্যাসগুলির কয়েকটি এই রকম-  ‘ভাতের গন্ধ’, ‘আকাশের নীচে মানুষ’, ‘রামচরিত্র’, ‘ধর্মান্তর’, ‘শান্তিপর্ব’, ‘রথযাত্রা’ ইত্যাদি।

বিহারে দেখা সেইসব মানুষের কথা উঠে এসেছে আমার কলমে। প্রতিবেশী রাজ্যে নানা ধরনের মানুষকে দেখেছি, মিশেছি। এভাবেই বোধহয় একজন লেখক মানুষ দেখেন। দেখতে চান। ‘অবজার্ভেশন পাওয়ার’ না থাকলে তো লেখক হওয়া যায় না! আমার সৃষ্ট চরিত্ররাও বেশিরভাগই আমার দেখাশোনার মধ্যে। বাস্তব জীবন থেকে চরিত্রগুলো উঠে এসেছে। তারপর আমি আমার মনের মাধুরী মিশিয়ে হয়তো লিখেছি।

আমার মাথায় সারাক্ষণ জট পাকিয়ে যেত সেইসব ছিন্নমূল মানুষগুলোর কথা। কোথা থেকে উঠে এসেছেন সেইসব মানুষেরা! যারা জীবনে কখনও রিফিউজি ক্যাম্প দেখেনি, তারা কল্পনাও করতে পারবে না সেসব কথা। দু’বেলা, দু’মুঠো জুটবে কি না সেই নিশ্চয়তাও ছিল না আমাদের। লেখক হওয়ার ইচ্ছে তো দূর দেশের কথা। দেশের কথা থেকে দেশভাগের কথায় আসি। সেও এক অকল্পনীয় স্মৃতি।

সাতষট্টি সাল। সাহিত্যিক, অধ্যাপক নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় চলে এলেন গোলপার্কের কাছে, পঞ্চাননতলায়। আমার লেখালেখি জীবনের শুরু থেকেই তাঁর প্রশ্রয় পেয়েছি। উনি আমায় খুব স্নেহ করতেন। একদিন এমনি এমনিই তাঁর বাড়িতে গিয়েছি।  কথায় কথায় দেশভাগের প্রসঙ্গ উঠল। যাঁরা নারায়ণদা সম্পর্কে ঈষৎ জানেন, তাঁরাও জানেন তাঁর আদিবাড়ি বরিশালের কথা। আমাদের বাড়ি ঢাকা জেলার বিক্রমপুরের আটপাড়ায়। আমি তখন দক্ষিণ কলকাতার বাসিন্দা। যাইহোক, দাঙ্গা-দেশভাগ ঘিরে বাঙালির জীবনে তখন মহা তমসা। এত বড় ট্র্যাজেডি বাঙালির জীবনে কখনও ঘটেনি। অথচ সাহিত্যিকদের লেখায় এই বিষয়টা খুব একটা ছাপ ফেলতে পারেনি। অনেকেই এড়িয়ে গিয়েছেন ইচ্ছে করে। বিষয়টা নিয়ে আমার খুব আক্ষেপ ছিল। প্রসঙ্গত বলি, নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় অবশ্য দাঙ্গা-দেশভাগ নিয়ে দু’চারটে গল্প-উপন্যাস লিখেছেন যেমন ‘ইজ্জৎ’, ‘মেহের খাঁ’, ‘বিদিশা’ ইত্যাদি। আমি কৌতূহল চাপতে না পেরে নারায়ণদাকে জিজ্ঞেস করেই ফেললাম, আপনাদের আদিবাড়ি তো বরিশালে ছিল। তা, আপনি দেশভাগ নিয়ে বড় কিছু লিখলেন না কেন? প্রশ্নটা শুনলেন। কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন। তারপর তিনি যা বলেছিলেন, তা বলি আপনাদের। বলেছিলেন, ‘আমি পূর্ব বাংলা থেকে বহুকাল আগে চলে এসেছি। পূর্ব বাংলা আমার স্মৃতিতে আছে, কিন্তু অনুভূতিতে নেই। বরং তুমি লেখো। দেশভাগের যন্ত্রণা যে কি ভয়াবহ, সেটা তুমি জানো। তোমার জানা আছে। সেই অনুভূতি, অভিজ্ঞতা লেখায় ফুটিয়ে তোলো। এটা কিন্তু বেশ একটা ভালো কাজ হবে।’

নারায়ণদা আমার মাথায় লেখার পোকাটাকে ছেড়ে দিলেন। সারাক্ষণ কথাটা মাথায় আসে, ‘তুমি লেখো’। এরপর শুরু হল নিজের সঙ্গে নিজের বোঝাপড়া। একইসঙ্গে নারায়ণদা অনুঘটকের কাজ করতে লাগলেন। দেখা হলেই জিজ্ঞেস করেন, দেশভাগ নিয়ে লেখার বিষয়ে। ‘কী হল, কতদূর?’ জুড়লেন আরেকজন, পবিত্রদা। তিনিও লেখার কথা বলতে লাগলেন। একের পর এক তাগাদা, অনুরোধ।

এটা তো সত্যি যে, আমরা দেশভাগের শিকার। গনগনে স্মৃতি। সর্বস্ব খুইয়েছিলেন দেশভাগের কবলে পড়া মানুষেরা। স্থাবর সম্পত্তি খুইয়ে সীমান্তের এপারে চলে আসতে হয়েছিল লক্ষ লক্ষ ছিন্নমূল মানুষকে। কিন্তু কেন আসতে হল এত মানুষকে? তা বিশদে জানা দরকার। ঔপনিবেশিক ভারতের সেই রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সাম্প্রদায়িক পটভূমি সম্পর্কে বিশদে জানা দরকার মানুষের। লাইব্রেরিতে গিয়ে পড়তে শুরু করলাম। দেশভাগ আমাদের জীবনে যে কতটা প্রভাব ফেলেছিল, বাঙালির জনস্মৃতিতে কতটা ক্ষত তৈরি করেছিল তার দীর্ঘ ইতিহাস পড়তে লাগলাম। বদলে যাওয়া ভূগোলটাও যে কত নির্মম এবং তার ভবিষ্যৎও কতটা ঘোর তমসাচ্ছন্ন, সে বিষয়ে ভাবতে লাগলাম। পড়ার ফাঁকে ফাঁকে লিখতেও শুরু করলাম। বেশ কিছু পাতা লেখা হল। সেদিন কোনও একটা কাজে বাগবাজারে গিয়েছি। পথে দেখা কবি মণীন্দ্র রায়ের সঙ্গে। শ্রী রায় তখন যুগান্তর-অমৃতবাজার গোষ্ঠীর ‘অমৃত’ পত্রিকার সম্পাদক। আমাকে দেখেই জিজ্ঞাসা করলেন, ‘তুমি নাকি দেশভাগের ওপর লিখছ?’

আমার হাতে তখন সেই দেশভাগের ওপর লিখে ফেলা ফাইলটাই রয়েছে। জানালাম সেই কথা। শোনামাত্র উনি ফাইলটা প্রায় কেড়েই নিলেন। ‘দেখি দেখি, কী লিখেছ?’

তারপর উনি পাণ্ডুলিপির শেষ পাঁচ-ছ’টা পাতা চোখ বুলিয়ে বললেন, ‘এটা আমি ধারাবাহিক ছাপাব।’

আমি তখনও দেশভাগের লেখার বিষয়ে ভীত, সংকুচিত। জিজ্ঞেস করলাম, ছাপবেন? কিন্তু লেখাটা কতটা কি দাঁড়িয়েছে জানি না!

আমার আপত্তি স্রেফ হাওয়ায় উড়িয়ে দিলেন মণীদা। এই সাক্ষাতের ঠিক পরের সপ্তাহেই কাগজে খুব বড় করে বিজ্ঞাপন দিলেন। তারও দু’সপ্তাহ বাদে উপন্যাসটা ‘অমৃত’ পত্রিকায় শুরু হল। অমৃত তখন সাপ্তাহিক পত্রিকা। সত্যি বলতে, প্রতি সপ্তাহে কিস্তি জোগান দেওয়াটা খুব সহজ ছিল না। তবুও লেগে পড়লাম পূর্ণোদ্যমে।

নারায়ণদার কথাটা মনে পড়ল, ‘স্মৃতিতে আছে যতটা, অনুভূতিতে ততটা নেই।’ ‘অনুভূতি’ যে কি জিনিস, তা বোধহয় একমাত্র ভুক্তভোগীরাই জানেন। আমাদের মতো সর্বস্ব খোয়ানো মানুষজন ছাড়া আর কেই-বা সেই ক্ষতের কথা জানবে, বুঝতে পারবে। নিজের কথাই যদি বলি, দেশভাগের কারণে জন্মভূমি থেকে আমাদেরও উৎখাত হয়ে চলে আসতে হয়েছিল। দেশভাগ ও দাঙ্গা, বাঙালি জীবনে এমন ভয়াবহ বিপর্যয় আর দুটি আসেনি। স্বদেশ হারানোর দুঃখ, নিজের শিকড় ছিঁড়ে আসার যন্ত্রণা, আমার মর্মে মর্মে, তীব্র অনুভূতিতে ভীষণভাবে ছিল। আজও তা টের পাই। এবং তাই নিয়েই আমার সুবৃহৎ উপন্যাস, ‘কেয়াপাতার নৌকো’। উপন্যাসটি প্রকাশ হয়েছিল সাপ্তাহিক পত্রিকায় দু’বছর জুড়ে। সেটা ১৯৬৮-’৬৯ সাল। এরপর শেষ পর্ব, তৃতীয় ও চতুর্থ একসঙ্গে বেরিয়েছিল এর বত্রিশ বছর পর একটি শারদীয়াতে। পরপর দু’বছর।

‘কেয়াপাতার নৌকো’ উপন্যাসটি যখন প্রথম বেরোতে শুরু করল, তখন সত্যিই আমি দুশ্চিন্তায় ছিলাম। পাঠক কীভাবে গ্রহণ করবেন, বুঝতে পারছিলাম না। চার সপ্তাহে চারটি কিস্তি ছাপার পর অভাবনীয় সাড়া পাওয়া গেল। প্রচুর চিঠি আসতে লাগল। আমি বেঁচে গেলাম, বর্তে গেলাম। বছরদুয়েক বাদে বেঙ্গল পাবলিশার্স উপন্যাসটি প্রকাশ করেছিল। এই উপন্যাসের সুবাদে একটি পুরস্কারও জুটে গিয়েছিল। ‘যুগান্তর’ পত্রিকা গোষ্ঠীর ‘মতিলাল পুরস্কার’। ‘কেয়াপাতার নৌকো’ বিষয়ে পাঠকের ধারণা, এটি লেখকের আত্মকথা। এক হিসাবে তাই। আবার অনেক পাঠক মনে করেন, এটা তাঁদের আত্মকথা।

তবে এটাই উপন্যাসের সম্পূর্ণতা নয়। কারণ, যে লক্ষ লক্ষ মানুষ সীমান্তের এপারে চলে এসেছিলেন, তাঁদের কথাও তো লিখতে হবে! স্থির করে ফেললাম, আরও কয়েকটা পর্ব লিখতে হবে। অনেক পরে বেরিয়েছিল ‘শতধারায় বয়ে যায়।’ যে লক্ষ লক্ষ ছিন্নমূল মানুষ এপারে চলে এলেন, তাঁদের অনেকেই ঠাঁই পেলেন রিলিফ ক্যাম্পে। অনেকে শিয়ালদা স্টেশনে আট ফুট বাই দশ ফুট জায়গায় বৌ-ছেলেমেয়ে নিয়ে বছরের পর বছর সরকারি-বেসরকারি লঙ্গরখানার খিচুড়ি খেয়েই প্রাণটুকু বাঁচিয়ে রেখেছিলেন। অনেকে কলকাতার চারপাশ তো বটেই, সারা পশ্চিমবঙ্গেই জবরদখল করে কলোনি গড়ে তুললেন। জমি মালিকদের গুন্ডাবাহিনীর সঙ্গে অবিরাম লড়াই করে বেঁচে থাকতে হল তাঁদের। উদ্বাস্তুদের নিয়ে চলল রাজনৈতিক দড়ি টানাটানি। সেই সময় কলকাতায় রোজ মিছিল, স্লোগান, পার্কে পার্কে জনসভা, পুলিশের সঙ্গে নিত্য খণ্ডযুদ্ধ। উদ্বাস্তুদের একটা বড় অংশকে পাঠানো হল আন্দামানে এবং অন্যত্র।

না, ‘কেয়াপাতার নৌকো’র এখানেই শেষ নয়। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে পড়া ছিন্নমূল জনগোষ্ঠীর অনন্ত জীবনযুদ্ধের কাহিনী আমি আমার পরের লেখাগুলোতে ফুটিয়ে তুলেছি, যতটা পেরেছি। দেশভাগের পরবর্তী এতগুলো বছরে বাঙালির যে আর্থসামাজিক-রাজনৈতিক জীবনে মহাসংকট ঘনিয়ে এসেছে বারবার, এপার বাংলা-ওপার বাংলায়, সেই ঘনঘটার সঠিক চিত্র কি তুলে ধরা সম্ভব!

Uttarbanga Sambad
Uttarbanga Sambadhttps://uttarbangasambad.com/
Uttarbanga Sambad was started on 19 May 1980 in a small letterpress in Siliguri. Due to its huge popularity, in 1981 web offset press was installed. Computerized typesetting was introduced in the year 1985.

Share post:

Popular

More like this
Related

পাহাড়ে হোমস্টে বিপ্লবে লাল সংকেত

প্রশান্ত মল্লিক কুড়ি-বাইশ বছর আগে, যখন হোমস্টে পর্যটনের ধারণা সবেমাত্র...

যোগেন মণ্ডল : এক ইতিহাসের নায়ক

অশোক ভট্টাচার্য ১৮৭২ সালের জনগণনা থেকে জানা যায়, অবিভক্ত বাংলার...

কত রাধিকা ফুরোল  

  সেবন্তী ঘোষ   কবি পুরুষের চোখে নারী চিরকাল ‘শুশ্রূষার ...

তোমার কথা হেথা কেহ তো বলে না

লীনা গঙ্গোপাধ্যায় ঝকঝকে নির্মেঘ আকাশ, বসন্তের মন প্রাণ উথাল...