কলাম

তিনটি ডট এবং সবার জয়ধ্বনিতে অর্ধসত্য

  • রূপায়ণ ভট্টাচার্য

…। তিনটি ডট। ইংরেজিতে বলে ইলিপসিস। কথাটা এসেছে গ্রিক শব্দ থেকে, লাতিন ভাষার মাধ্যমে। মানে হল ‘ছেড়ে দেওয়া’। টাইপোগ্রাফির ভাষায় একে অনেকে বলেন থ্রি ডট লিডার।

এর আসল মানে এবং মাহাত্ম্য যে কী, তা ভোটের আগে সব পার্টির নেতাদের কথাবার্তায় সুস্পষ্ট। মোদিপন্থী ও মমতাপন্থী মিডিয়ার প্রচারেও বারবার প্রকাশ্যে সেটা। এবং তা ছড়িয়ে পড়ছে সাধারণের মধ্যে। গ্রিক শব্দটির আলাদা এক ভারতীয় ঘরানাই তৈরি হয়ে উঠছে যেন।

বাংলার এক নামী সাহিত্যিক একবার লিখেছিলেন, একটি সিনেমা রিভিউ করার পর জীবনে তিনি আর হাঁটেননি ওই পথে। স্তম্ভিত হয়ে। তাঁর করুণ গল্পের পিছনেও ছিল ওই … তিনটি ডট। বাংলার সব পার্টির নেতাদের ‘অশ্বত্থামা হত ইতি গজ’ মার্কা অর্ধসত্য বলা অভ্যাসে পরিণত দেখে সেই গল্পটা মাথায় ঘুরছে।

সেদিন সেই সাহিত্যিক সিনেমার কড়া সমালোচনা করে ঠিক কী লিখেছিলেন মনে করতে পারছি না। তবে সম্ভবত এই জাতীয় কিছু লিখেছিলেন, ‘এই সিনেমা অবশ্যই দেখা উচিত নয়। আদৌ কোনও প্রশংসা প্রাপ্য কি না, প্রশ্ন উঠবে।’ দু’দিন বাদে কাগজে ভদ্রলোকের নাম করে সিনেমা নির্মাতাদের বিজ্ঞাপন ছাপানো হল। সিনেমা দেখে অভিভূত তিনি নাকি লিখেছেন, ‘এই সিনেমা অবশ্যই দেখা উচিত…। …প্রশংসা প্রাপ্য…।’

নিজেদের পছন্দমতো শব্দ বেছে, শব্দ মুছে বাক্যের মানেটাই সম্পূর্ণ উলটো করে দেওয়া হল। প্রচারের জন্য।

ঠিক সেভাবেই কোনও বাক্য ভেঙে, সম্পূর্ণ বাক্য থেকে খামচে খামচে শব্দ ব্যবহার করে নিজেদের প্রচারের কাজে লাগানো এখন এ দেশে নিয়ম। হামেশাই হচ্ছে এসব। সন্দেশখালি থেকে চোপড়া, মণিপুর থেকে পঞ্জাব– সব জায়গায় এই এক দৃশ্যমালা। পুরো ছবিটা কী আসলে, তার স্পষ্ট ধারণা পাওয়া কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে প্রতিদিন। সন্দেশখালিতে যে তৃণমূলের নেতা এবং পুলিশ অতি কদর্য কাজ করছে, সেটা স্পষ্ট। চোপড়ায় যে বিএসএফের কাজ একেবারে যুক্তিহীন, তাতেও কোনও সন্দেহ নেই। তবে দুটো ঘটনাকে কেন্দ্র করে সব পক্ষের নেতারা যে পথে নিজেদের দিকে ঝোল টানতে শুরু করেছেন, তা দিন-দিন অসহ্য হয়ে উঠছে। লোকসভা নির্বাচন যত এগোবে, তত প্রবল হবে এই বদঅভ্যেস।

এসবের পাশাপাশি আর একটা কথা ভুললে মারাত্মক ভুল হবে। কিছু আমলা এবং পুলিশকর্তাদের ভূমিকা বাংলার শাসকদলকে ডুবজলে ফেলে দিচ্ছে ক্রমাগত। শুধু সন্দেশখালি নয়, সব জায়গায়। সন্দেশখালিতে যে ঘাসফুলের দাদারা এভাবে দিনের পর দিন সন্ত্রাস চালিয়েছে, রাতে মহিলাদের পার্টি অফিসে নিয়মিত ডেকেছে, সেটা জেলা শাসক বা এসপি জানতে পারলেন না কেন? কেনই বা নবান্ন, কালীঘাট বা ক্যামাক স্ট্রিটকে সতর্ক করা হল না ? এখন যখন এঁদের অকর্মণ্যতা স্পষ্ট, তাহলে তাঁদের শাস্তি দেওয়া হবে না কেন?

গুরুত্বপূর্ণ আরও একটা প্রশ্ন। দিনের পর দিন বেপাত্তা শাহজাহানকে ধরতেই হবে, এমন অন্যায় সহ্য করা যাবে না, প্রকাশ্যে এই বার্তা কেন দিলেন না মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়? তিনি বা তাঁর নারীকল্যাণমন্ত্রী শশী পাঁজা নিজেই কেন দ্রুত সন্দেশখালি ঘুরে এলেন না? প্রথমেই কড়া থাকার বার্তা দিলে শুধু সন্দেশখালি নয়, শিলিগুড়ি, সিউড়ি, শীতলকুচিতে পার্টির অনেক শাহজাহানকেই বার্তা দেওয়া যেত। যারা ক্লাবের হয়ে দাদাগিরি করে, বালি-পাথর-কয়লার সিন্ডিকেটরাজে সক্রিয় হয়, শহরের প্রাণকেন্দ্রে চায়ের দোকানের ছেলের হাত পুড়িয়ে দেয়, তারাও সতর্ক হত। তা হল কোথায়? জলপাইগুড়ির সৈকত, মুর্শিদাবাদের শাহ আলমদের কিছুই করা হয়নি। তারা প্রবল বিক্রমে ছড়ি ঘোরাচ্ছে চরম অনৈতিক কাজ করেও। আরও আশ্চর্য এবং বিস্ময়, বিধানসভায় শাহজাহানের হয়ে মুখ্যমন্ত্রীর সাফাই। গুন্ডাদের পক্ষে মুখ্যমন্ত্রী বলবেন!

বিজেপিও যে পথে হাঁটছে, সেটাও একইরকম ভয়াবহ। একরকম বিপজ্জনক। কোনওরকম তথ্য যাচাই না করেই নয়াদিল্লিতে স্মৃতি ইরানি বলে দিলেন, সন্দেশখালিতে ধর্ষণ হয়েছে। হিন্দু বিবাহিত তরুণীরা (বেছে বেছে এই শব্দগুচ্ছ ব্যবহার হল) নাকি আক্রান্ত। এতে যে মেয়েদেরই অবমাননা হল, সেটা বুঝেও বুঝলেন না কেন্দ্রীয় মন্ত্রী। বিজেপির আরও অনেক নেতা সেখানে অতি দ্রুত হিন্দু-মুসলিম সাম্প্রদায়িক অ্যাঙ্গল দিয়ে ফেললেন। প্রথমে শাহজাহানের নাম বাজারে আসার সঙ্গে সঙ্গে বলা হল, হিন্দু নারীদের বেছে বেছে অত্যাচার হচ্ছে। তারপর শাহজাহানের পাশে শিবু-উত্তমের নাম উঠল। হিন্দু-মুসলিম দৃষ্টিকোণ উধাও হয়ে গেল হঠাৎ। তৃণমূল যেমন গুলিয়ে দিতে চায় নেতাদের সবরকম অত্যাচারের তথ্য। নাটক নিয়ে ব্রাত্য বসুর অভিযোগের ক্ষেত্রেও রয়েছে ওই একরকম অর্ধসত্য।

মমতা যদি শাহজাহানের অন্তর্ধান নিয়ে নিদ্রা যান, মোদিও সেইভাবে প্রবল নিদ্রায় কৃষক আন্দোলন বা মণিপুর নিয়ে। কৃষকরা যখন রাস্তায়, মোদি সেসময় আবু ধাবিতে ব্যস্ত মন্দির উদ্বোধনে। তখন দুই শাসকপক্ষই হয়ে ওঠে দম্ভের মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ। একপক্ষ একটা ইস্যু নিয়ে মিথ্যা কথা বড় করে দেখালে অন্য পক্ষ সজোরে সদম্ভে আঁকড়ে ধরে আরেকটা মিথ্যা।

খ্রিস্টপূর্ব ১৬৬-র গ্রিক নাটকের রূপান্তর রোমান কমেডি ‘আন্দ্রিয়া’ হয়েছিল ১৪৭৬ সালে। তার ইংরেজি অনুবাদ হয় ১৫৮৮ সালে। সেখানেই ইলিপসিসের প্রথম প্রয়োগ হয় ইংরেজিতে। আজ প্রায় সাড়ে চারশো বছর পরেও দেশজ রাজনীতি তাকে চেটেপুটে খাচ্ছে। শুধু বাংলা নয়, সব রাজ্যেই এই খেলা চলছে অনন্তধারার মতো।

সাধারণ মানুষ? নেতাদের ঢংয়ে ছাঁকনি দিয়ে পছন্দমতো যুক্তি বেছে তাঁরাও একবার এদিকে যান, আর একবার ওদিকে। যেন পেন্ডুলাম। নিজেদের অজান্তেই হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে গোলাম হয়ে ওঠেন কোনও পার্টির। রাজ্যের কংগ্রেস ও সিপিএম নেতারাও ঠিক একভাবে একবার দিদিকে গালাগাল দেন, একবার মোদিকে।  তাঁরাও এক হাস্যকর স্টাইলে ইচ্ছেমতো বাক্য থেকে শব্দ ছেঁটে ফেলেন। রাজ্যপাল আনন্দ বোসের অনেক কাজে, অনেক মন্তব্যে যেমন লেগে থাকে পদ্ম পদ্ম গন্ধ। মোদি মনোনীত অনেক রাজ্যপালই ডট ডট ডটের ভক্ত হয়ে উঠেছেন দিন-দিন।

যত ডট, তত জট। বুদ্ধিজীবীরা যেমন দলজীবী হয়ে উঠছেন, রাজ্যপালেরাও সেই স্টাইলে হয়ে উঠেছেন কেন্দ্রপাল। বুদ্ধিজীবীরাও আঁকড়ে ধরেন নিজস্ব পছন্দের বাক্য এবং ইলিপসিস। মনে করিয়ে দেন, বুদ্ধিজীবী শব্দটা যে অর্থে ভাবতাম, তা মুছে গিয়েছে বাম আমল থেকেই। এঁরা আলোচনার যোগ্য নন আর।

 … ওই তিনটি ডট, ইলিপসিস ভয়ংকর সব অর্ধসত্য এবং মিথ্যের অশনিসংকেতের প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে ভারতীয় রাজনীতিতে।

Uttarbanga Sambad

Uttarbanga Sambad was started on 19 May 1980 in a small letterpress in Siliguri. Due to its huge popularity, in 1981 web offset press was installed. Computerized typesetting was introduced in the year 1985.

Recent Posts

Pension | পুরোনো পেনশন স্কিম ফেরাতে দেশজুড়ে আন্দোলনে রেলকর্মীরা, পাশে থাকার আশ্বাস মমতার

উত্তরবঙ্গ সংবাদ ডিজিটাল ডেস্কঃ নয়া পেনশন স্কিম তুলে দিয়ে পুরোনো পেনশন স্কিম ফিরিয়ে আনার দাবিতে…

3 mins ago

বালুরঘাট: সংস্কারের অভাবে বিপদজনক ভাবে রয়েছে অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্র৷ দেওয়ালে ধরেছে বড় বড় ফাটাল। যেকোন সময়…

6 mins ago

Elephant Corridor | হাতির করিডর যেন ডাম্পিং গ্রাউন্ড, বন দপ্তরের উদাসীনতায় ক্ষোভ

শুভ দত্ত, বিন্নাগুড়ি: হাতির করিডরে শহরের আবর্জনা। বন্যপ্রাণ বিপদে পড়লেও বন দপ্তর নীরব দর্শক। মোরাঘাট…

9 mins ago

Iran | রাইসির পরিবর্তে কে হবেন ইরানের প্রেসিডেন্ট? কোন পদ্ধতিতে নির্বাচন?

উত্তরবঙ্গ সংবাদ ডিজিটাল ডেস্ক: চপার ভেঙে প্রাণ হারিয়েছেন ইরানের প্রেসিডেন্ট (Iran) ইব্রাহিম রাইসি (Ebrahim Raisi)।…

25 mins ago

Part time teachers recruitment | আংশিক সময়ের শিক্ষক নিয়োগে বড় সিদ্ধান্ত! কী জানাল শিক্ষা দপ্তর?

উত্তরবঙ্গ সংবাদ ডিজিটাল ডেস্ক: রাজ্যের কোনও সরকারি বিদ্যালয়ে (Goverment school) স্কুল শিক্ষা দপ্তরের অনুমতি ছাড়া…

28 mins ago

BJP | আদালতে ধাক্কা বিজেপির! নির্বাচনি বিজ্ঞাপনে অন্তর্বর্তী স্থগিতাদেশ হাইকোর্টের

উত্তরবঙ্গ সংবাদ ডিজিটাল ডেস্ক: বিজেপির (BJP) নির্বাচনি বিজ্ঞাপনের উপর অন্তর্বর্তী স্থগিতাদেশ দিল কলকাতা হাইকোর্ট (Calcutta…

31 mins ago

This website uses cookies.