প্যান্ডেল হপিং থেকে আউটিং– মুহূর্ত উপভোগের চাইতেও বেশি জরুরি যেন সেটাকে ক্যামেরাবন্দি করা। ছবি–ভিডিও–রিল পোস্ট করে লাইক, কমেন্ট, ভিউ পেতে ‘কনটেন্ট’ থেকে বাদ যাচ্ছে না কিছুই। একদল বলছে, সবটাই দেখনদারি। আরেকদলের যুক্তি, সমাজমাধ্যমের বন্ধুদের সঙ্গে আনন্দ ভাগ করে নেওয়াটাই উদ্দেশ্য। এই তর্কের শেষ নেই।
সৃজনী ঘোষ
কী! চোখের তলায় কালি কেন পড়েছে তোর?’, প্রিয়াংশি জিজ্ঞাসা করল পাশে বসা মীরাকে। পেছন বেঞ্চ থেকে ঋষিলা বলে উঠল, ‘আরে রাত জেগে অ্যাসাইনমেন্ট করলে তো চোখের তলায় কালি পড়বেই। পুরো গরমের ছুটিটা তো আন্দামানে গিয়ে বসে ছিল।’
মীরা জানাল, ঋষিলা সত্যি কথাই বলেছে। ঘুরতে যাওয়ার কারণে কোনও অ্যাসাইনমেন্ট করতে পারেনি সে। পরশু ফিরে নাওয়া-খাওয়া বাদ দিয়ে লিখতে হয়েছে পুরোটা। সেই কথা শুনে প্রিয়াংশির প্রশ্ন, ‘মীরা, তুই আন্দামানে গিয়ে কি শুধুই ঘুরে বেড়ালি? একটাও ছবি তুলিসনি? এফবি, ইনস্টা, কোথাও তো একটাও পোস্ট দেখলাম না। পরে করবি নাকি?’
মীরার জবাব, ‘না রে, সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট করব না। আমার কেন জানি মনে হয়, এখন এসব দেখনদারির পর্যায়ে চলে গিয়েছে। যেন ফ্লাইটে বা ট্রেনে চড়ার আগে টিকিটের ছবি পোস্ট না করলে তাতে উঠতে দেবে না। সবাইকে জীবনের সব মুহূর্তের সাক্ষী করার প্রয়োজনীয়তা খুঁজে পাই না আমি।’ প্রিয়াংশির পালটা যুক্তি, ‘নিজের আনন্দ আর পাঁচজনের সঙ্গে ভাগ করে নেওয়া কি খারাপ? বরং ভাগ করে নিলে তা দ্বিগুণ হয়ে যায়।’
ঋষিলা অবশ্য মীরার সঙ্গে সহমত। কাছের বন্ধু-আত্মীয়-পরিজনের সঙ্গে বিশেষ মুহূর্ত ভাগ করে নিতে ভালো লাগে তার। নিজের পরিচিত বৃত্তে স্বাচ্ছন্দ্য সে। বলছিল, ‘একটা কথা ভেবে বলত প্রিয়াংশি, সোশ্যাল মিডিয়ায় তোর ফ্রেন্ডলিস্টের সবাই কি তোর আপন? সকলের সঙ্গে কি তুই নিজের ভালোলাগা-খারাপলাগাগুলো ভাগ করে নিতে পারবি?’
এখন লোকে পুজোয় প্রতিমা দর্শনে বেরিয়ে শিল্পীর হাতের কাজ দেখে কম, ভিডিও আর ছবি তোলে বেশি। তারপর অপেক্ষা করে কতক্ষণে বাড়ি গিয়ে সেসব আপলোড করবে। এটা কি শুধুই নিজের আনন্দ সকলের সঙ্গে ভাগ করে নেওয়া? নাকি এর মধ্যে রয়েছে দেখনদারিও?
কোথাও যাওয়ার আগে ‘গেট রেডি উইথ মি’ ভিডিও বানিয়ে নিজের তৈরি হওয়াটা সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট করা হয়। এটাই নাকি ট্রেন্ড। কয়েকজন তো আবার শ্রাদ্ধবাড়ির ভিডিও বানিয়ে আপলোড করে নিজের অ্যাকাউন্টে ভিউজ বাড়ানোর জন্য। সেটা নিশ্চয়ই ‘আনন্দ’ ভাগ করে নেওয়া হতে পারে না!
আসলে জেন জেড, জেন আলফার একাংশের জীবনযাপন যেন সোশ্যাল মিডিয়ায় সীমাবদ্ধ হয়ে গিয়েছে। গড্ডলিকায় গা ভাসাচ্ছেন বড়রাও। বন্ধু এবং পরিবারের সঙ্গে রেস্তোরাঁয় খেতে যাওয়ার পর স্বাদ উপভোগ করাটা সেকেন্ডারি হলেও চলবে। আগে প্লেট সাজিয়ে খাবারের অন্তত ১০০টা অ্যাঙ্গেল থেকে ছবি তোলা হয়। ভ্লগ বানাতে হবে। সেটার মধ্যে কি খানিকটুকুও মিশে নেই শো-অফ? ক’টা লাইক পড়ল, কী কমেন্ট এল- সেটাই কি বিচার করে দেয় বিশেষ মুহূর্তগুলোর দাম?
প্রিয়াংশি অবশ্য দুই বন্ধুর সঙ্গে পুরোপুরি সহমত নয়। তার ব্যাখ্যা, ‘সেটা ঠিক। কিন্তু কয়েকজনের দেখনদারির স্বভাবটাকে জেনারালাইজ করা যেতে পারে না। সবাই শুধুমাত্র শো-অফ করার জন্য সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট করে না। অনেকেই আছে, যারা বিশেষ মুহূর্তগুলোকে ধরে রাখতে চায়। পরের বছর একইদিনে সোশ্যাল মিডিয়া দেখাবে সেই ‘মেমোরিজ’। ছবির সঙ্গে ফিরে আসবে আরও কত স্মৃতি।’
এবার স্কুল থেকে বাড়ি ফেরার পালা। উঠে দাঁড়াল ওরা। মীরা ব্যাগটা কাঁধে নিয়ে জানাল, সে তার ইনস্ট্যান্ট ক্যামেরায় অনেক ছবি তুলেছে। সেগুলোকে রাত জেগে নাকি ‘আন্দামান ডায়েরিজ’-এ সাজিয়েও রেখেছে। বলল, ‘তোরা চাইলে আমি তোদের সেগুলো দেখাতে পারি।’
-কবে যাব, বল বল!
-এই রবিবারেই আয় না, সকালে সুমন স্যরের টিউশন থেকে আর বাড়ি ফিরিস না, আমার বাড়ি চলে আয়। সানডে স্পেশাল মেনুর সঙ্গে আন্দামানের একটা ছোট্ট ট্যুর ফ্রি! এই গাইডের সঙ্গে। কেমন হবে?
-দারুণ!