উত্তর সম্পাদকীয়

বদলে যায় ঘর, বদলে যায় জীবন

  • সুমনা ঘোষ দস্তিদার

মায়ের বুকে মুখ রেখে কোলের ওমে ঘুমিয়েছিল সে। যখন ঘুম ভাঙল তখনও ঠোঁটের কোণ থেকে গড়িয়ে পড়া দুধ শুকিয়ে আছে। কিন্তু বদলে গিয়েছে কোল, পালটে গিয়েছে মায়ের গায়ের চেনা গন্ধ। ডুকরে কেঁদে ওঠে দিন পনেরোর ছোট্ট শিশু। মুঠো করা কচি হাত ছুড়ে ছুড়ে হয়তো প্রতিবাদ জানতে চেয়েছিল, জানতে চেয়েছিল, এই অন্যায়, এই অবিচারের বিরুদ্ধে। শোনেনি কেউ সেইদিন, শুনতে চায়নি। আজও তাঁদের কথা শুনতে চায় না কেউ, বুঝতেও চায় না তাঁদের যন্ত্রণার কথা।

এভাবেই বদলে যায় ঘর,  বদলে যায় জীবন। হারিয়ে যায় পরিবার, আপনজন। এই অন্যায়ের জন্য আমরা দায়ী করব কাকে?  না তাকে, না তার বাবা-মাকে, না সেই সদ্যোজাতের পরিবারকে। কাঠগড়ায় একমাত্র দাঁড় করাতে পারি আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি  আর মানসিকতাকেই, যা কলুষিত করেছে সমাজকে। আমরা ওঁদের সুস্থ স্বাভাবিক জীবন তো দিতে পারিইনি, বরং ঠেলে দিয়েছি বৈষম্য আর বঞ্চনার আঁধারে।

ওঁরা তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ, যাকে দেখে মুখ টিপে ব্যাঙ্গের হাসি হেসে আঙুল তুলে তাচ্ছিল্যভরে ডাকি। আমাদেরই জন্য, তাঁদের জন্মের পর বাবা-মা নিজেরাই দিয়ে যান তাঁর সন্তানকে, কখনও বৃহন্নলা সমাজ এমন শিশুর খোঁজ পেলে নিজেরাই এসে নিয়ে যান তাদের আখড়ায়। কারণ আমাদের মাঝে বেড়ে ওঠার মতো পরিবেশ আমরাই কেড়ে নিয়েছি তাঁদের কাছ থেকে, বিভেদ রেখা এঁকে দিয়েছি তাঁদের আর আমাদের মাঝে।

প্রতিটি আখড়ায় থাকেন একজন গুরুমা। তিনিই মায়ের মতো স্নেহে, শাসনে তাঁদের বড় করে তোলেন। বাবা- মায়ের সব দায়িত্ব পালন করেন তিনিই। গুরুমাই শেখান তাঁদের আচার-আচরণ, রীতি-নীতি। তাঁর প্রতিটি নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে মেনেই তাদের প্রতিদিনের যাপন। এই আখড়াতেই আরও চল্লিশ, পঞ্চাশজনের সঙ্গেই তাঁদের  বেড়ে ওঠা। কণ্ঠস্বর লিঙ্গের পরিচায়ক। ফলত এদের লিঙ্গ অসংগতির কারণে স্বাভাবিকভাবেই তার প্রভাব পড়ে কণ্ঠস্বরে, প্রভাব পড়ে নানা অঙ্গ–প্রত্যঙ্গে। ধীরে ধীরে শুরু হয় তার নিজেকে চেনা, শুরু হয় প্রতি পদক্ষেপে হোঁচট খাওয়া, ভুল প্রমাণিত হওয়া। মন আর শরীরের যুদ্ধও শুরু হয় তখন থেকেই। তবে আখড়ার প্রতিটি মানুষ একই বৈশিষ্ট্যের হওয়ায় মানসিক যাতনা কিছুটা হলেও লাঘব হয়।

ওঁদের জন্য আলাদা কোনও স্কুল নেই। ওই আখড়াতেই কয়েকজন শিক্ষক নিযুক্ত হন। কিন্তু সেখানে নেই ক্লাসরুমে সহপাঠীদের হুল্লোড়,  শিক্ষকের চোখ রাঙানি, নেই পরীক্ষা ভীতি, সাফল্যের উল্লাস। সাধারণ স্কুলে যেতে অসুবিধা কোথায়? ‘পরিবারকে হারিয়েছি, সব ছেড়েছি, আবার তোমাদের স্কুলে ভর্তি হয়ে প্রতিনিয়ত অপমান সইব? এত দুঃখ ভার বইব কীভাবে?’ সজল চোখে বলেছিল বৃহন্নলা প্রিয়া। যদিও ২০১৭ সালে কেরলে  বয়স্ক বৃহন্নলাদের জন্য স্কুল হয়েছে। ছয়জন বৃহন্নলা সমাজকর্মী স্কুলটি পরিচালনা করেন, শিক্ষার্থী দশজন। তাঁদের জন্য কারিগরি শিক্ষার ব্যবস্থা আছে সেখানে।

এই আখড়াতে থাকতে থাকতে, অন্যদের দেখে তারা শিখে নেয় ঢোল বাজাতে। আগে মাটির ঢোল ছিল, এখন তা কাঠের। ঠিক একইভাবে অন্যদের দেখে রপ্ত করে বিশেষ কায়দায় দেওয়া তালি। যা তাদের পরিচয় জ্ঞাপক। নববধূ বা নবজাতককে আশীর্বাদ করতে তাঁরা সেই বাড়িতে উপস্থিত হন। প্রাথমিকভাবে টাকা এবং বিভিন্ন দ্রব্যের আবদার করে তালি দিয়ে, ঢোলের তালে নাচ করেন দলবেঁধে। কিন্তু কেউ সেই টাকা দিতে অসম্মত হলে, তাদের আবদার, অত্যাচারের পর্যায়ে যায় বলে অনেকেই অভিযোগ করেন।

কেন তাঁরা অনুষ্ঠানে উপস্থিত হয়ে টাকার দাবি করেন? মানবী হালদার রামায়ণের প্রসঙ্গ টেনে বলেন, ‘আমি শুনেছি স্বয়ং রামচন্দ্র বৃহন্নলাদের স্বীকার করে নিয়েছিলেন। তাদের, অন্যদের আশীর্বাদ ও বিশেষ পরিস্থিতিতে অভিশাপ দেওয়ার এবং তা ফলপ্রসূ হওয়ার বরদানও করেছিলেন। অভিশাপ নয়, মন থেকে আশীর্বাদ করতেই আমরা ওইসব অনুষ্ঠানে যাই এবং কিছু পাওয়ার আশাও করে থাকি।’  তাঁর পরের মন্তব্য, ‘সমাজের আর পাঁচজন যেমন সুন্দরভাবে বাঁচেন, আমরাও তেমন সুস্থ, সুন্দরভাবে বাঁচতে চাই।  সরকারি সাহায্য পাই না। বাঁচতে তো হবে, যে কোনও কাজে আমাদের নিয়োগ করাও হয় না। এভাবে দান বা ভিক্ষা ছাড়া আমাদের আর উপার্জনের রাস্তা নেই।’

যদিও বর্তমানে ২০১৪ সালের ১৫ এপ্রিল থেকে তাঁরা তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছেন। ভোট দেওয়ার অধিকার, র‌্যাশন, স্বাস্থ্যসাথী প্রকল্পের আওতাভুক্ত হয়েছেন। তবুও কি প্রতিটি মানুষের মতো ভালোবাসায়, সম্মানে, সমানাধিকারে বাঁচেন তারা? মানবী যথেষ্ট ক্ষোভের সঙ্গেই বলছিলেন, ‘একটা ভালো শাড়ি বা গয়না পরলে আমাদের নিয়ে বিদ্রুপ করেন সকলে। এই সমাজ প্রতি মুহূর্তে বুঝিয়ে দেয় আমরা আলাদা। এই লাঞ্ছনা, বঞ্চনা আর তাচ্ছিল্য সয়েই আমাদের প্রতিদিনের বাঁচা।’

ব্যক্তিসুখ ভোগের জন্য এই অবিবেচকের মতো দাবি, জুলুম, অশ্লীল ভাষা প্রয়োগ, কদর্য অঙ্গভঙ্গি? এসব সাধারণ মানুষ মেনে নেবেন কেন? এর উত্তরে পিপাসা হালদারের মন্তব্য, ‘দানের অর্থ দিয়ে আমরা একটি বৃদ্ধাশ্রম চালাই আর একটি অনাথ শিশুদের আশ্রমও আছে। যেখানে প্রায় তিরিশজন শিশু রয়েছে। এছাড়া টাকার অভাবে মাঝপথে যার পড়া বন্ধ, যে মেয়েটির বিয়ে আটকে আছে, চিকিৎসা করবার সামর্থ্য নেই যাদের, তাদের পাশে থাকি আমরা, থাকে ‘জলপাইগুড়ি বৃহন্নলা আস্থা ওয়েলফেয়ার সোসাইটি’।

ভয়াবহ কোভিডের সময় আক্রান্তদের বাড়িতে খাবার, ওষুধ পৌঁছে দিয়েছেন তাঁরা। প্রয়োজন বুঝে বস্ত্রবিতরণ, স্কুলে বই বিতরণ করে থাকেন। তবে এসব কাজের প্রচার চান না তাঁরা। তাঁদের কথায়, দান হবে নিঃশব্দে, গোপনে। এমনভাবে হবে, ডান হাত দান করলে বাম হাত যেন তা জানতে না পারে।

তাঁদের শরীর জুড়ে অযুত অসংগতির চিহ্ন। শুধুই না পাওয়া, ঘৃণা আর বঞ্চনার গল্প। তবু্ও ঈশ্বরের প্রতি তাদের কোনও ক্ষোভ নেই। তাঁরা ঈশ্বরে বিশ্বাসী, তাঁদের আরাধ্য দেবাদিদেব মহেশ্বর এবং মা মনসা। শিবের অর্ধ-নারীশ্বর রূপের ছায়া যেন তাঁদের শরীরে, যাঁর একই অঙ্গে নারী ও পুরুষের অবস্থান। এই বিশ্বাসে তাঁরা মাথা উঁচু করে চলেন। তবে ঈশ্বরের কাছে নয়, তাদের সকল চাওয়া মানুষের কাছে। চোখেমুখে বিষাদ মেখে বলছিলেন বৃহন্নলা হালিমা, ‘বর্তমানে আমরা আগের চেয়ে অনেক ভালো আছি ঠিক কথা, কিন্তু এখনও কি পারি তোমাদের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে চলতে? কোনও শুভ অনুষ্ঠানে হাতেগোনা দু’একজন ছাড়া কেউ নিমন্ত্রণ জানিয়েছেন আমাদের? আমরা ভালোবাসা চাই, সম্মানে বাঁচতে চাই।’

পিপাসা বলছিলেন, ‘আমাদের জন্য বিদ্যালয় থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত স্থাপিত হোক, কর্মসংস্থানের প্রতিটি ক্ষেত্রে তৃতীয় লিঙ্গের জন্য আসন সংরক্ষিত থাকুক, বিশেষ ভাতা চালু হোক আমাদের কথা ভেবে, সম্মানে বাঁচার মতো পরিবেশ রচিত হোক প্রতিটি রাজ্যে।’

এই বৃবন্নলার জন্মকে অভিশাপ মনে হলেও, এ জীবনকে স্বীকার করে নিয়েই প্রতিনিয়ত অপমান, অবহেলা, বঞ্চনার ধুলো ঝেড়ে ফেলেই বাঁচেন তাঁরা। জীবন জুড়ে শুধু নেই, নেই আর নেই। কিন্তু তারাও আদরে, সোহাগে, সম্মানের জীবনকে আষ্টেপৃষ্ঠে জাপটে বাঁচতে চান, তাঁরাও শামিল হতে চান সেই কাজে, যা দেশের ও দশের হিতের জন্য। বীর যোদ্ধা অর্জুনও তো বৃহন্নলা রূপেই দুর্যোধন কর্তৃক গো-হরণ কালে, উত্তরের সারথি রূপে যুদ্ধে গিয়েছিলেন। শারীরিক গঠনই তো শেষ কথা নয়, অন্তরে যে ঐশ্বর্য রয়েছে সেখানে অলো এসে পড়ুক, তাদের ছুঁয়ে থাকুক মানুষ, স্বজনের মতো। অপমান, তাচ্ছিল্য, বঞ্চনা আর উপহাসের পাত্র হয়ে নয়, বৃহন্নলারাও আমাদের পাশে, আমাদের মাঝে শ্রদ্ধায়, ভালোবাসায় বাঁচুক।

(লেখক শিক্ষক। জলপাইগুড়ির বাসিন্দা।)

Uttarbanga Sambad

Uttarbanga Sambad was started on 19 May 1980 in a small letterpress in Siliguri. Due to its huge popularity, in 1981 web offset press was installed. Computerized typesetting was introduced in the year 1985.

Recent Posts

Theft Case | দিনদুপুরে সরকারি স্কুলে চুরি

নিশিগঞ্জ: দিনদুপুরে সরকারি স্কুলের চুরির (Theft Case) ঘটনাকে ঘিরে চাঞ্চল্য ছড়াল কোচবিহারের (Coochbehar) নিশিগঞ্জে (Nishiganj)।…

48 mins ago

জাতীয়স্তরে বিজ্ঞানমন্থন প্রতিযোগিতায় দ্বিতীয় জলপাইগুড়ির অদিতি

নাগরাকাটা: ন্যাশনাল কাউন্সিল অফ এডুকেশনাল রিসার্চ অ্যান্ড ট্রেনিং (এনসিইআরটি) ও ন্যাশনাল কাউন্সিল অফ সায়েন্স মিউজিয়াম…

50 mins ago

Sand smuggling | দিনে দুপুরে ট্রলি বোঝাই করে বালি পাচার! নাম জড়াল তৃণমূল নেতার

রতুয়া: দিনে দুপুরে পাচার করা হচ্ছে ট্রলিবোঝাই বালি। এই বালিপাচার চক্রে নাম জড়িয়েছে স্থানীয় তৃণমূল…

1 hour ago

Smriti Mandhana | ‘এমন প্রত্যাবর্তনে দম লাগে’, বিরাটদের প্রশংসায় স্মৃতি মান্ধানা

উত্তরবঙ্গ সংবাদ ডিজিটাল ডেস্ক: চেন্নাইকে হারিয়ে আইপিএলের প্লে-অফে পৌঁছে গিয়েছে বিরাট কোহলির রয়্যাল চ্যালেঞ্জার্স বেঙ্গালুরু।…

1 hour ago

Lok Sabha Election 2024 | উন্নয়নের দাবিতে ভোট বয়কট উত্তরপ্রদেশ ও ঝাড়খন্ডের ৩ গ্রামে

উত্তরবঙ্গ সংবাদ ডিজিটাল ডেস্ক: ৬ টি রাজ্য এবং ২ টি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল মিলিয়ে মোট ৪৯…

2 hours ago

Drinking water crisis | স্বাধীনতার ৭৫ বছর পরেও পরিশ্রুত পানীয় জল থেকে বঞ্চিত গাজোলের গ্রাম

গাজোল: স্বাধীনতার ৭৫ বছর পেরিয়ে গিয়েছে। চারিদিকে হোর্ডিং-ব্যানারে বিকশিত ভারতের প্রচার। অথচ এখনও বহু গ্রামে…

2 hours ago

This website uses cookies.