শাঁওলি দে
শেষ বৈশাখে বারবার একটা কথা মনে হয়। সময় এখন ব্যবসাকেন্দ্রিক, মানুষের চোখও তাই। বাঙালির সব রীতিনীতি ভুলে নির্দ্বিধায় আমরা নতুন নতুন আচার, সংস্কৃতি, প্রথা গ্রহণ করে নিচ্ছি। পাশ্চাত্যের অনুকরণ তো সেই কবে শুরু হয়েছিল, এখন সেসবও যেন ছাপিয়ে গিয়েছি আমরা।
এভাবেই একদিন নিজের মাতৃভাষাটাও ভুলে যাব, এ নিয়ে আজ আর কোনও দ্বিধা কাজ করে না। ঠিক যেমন করে ভুলে গিয়েছি ঋতুচক্রের আনাগোনার খবর। কখন কোন মাস আসে, আমাদের অনুষ্ঠান না হলে জানা কঠিন হয়ে যায়। অবশ্য নিত্যনৈমিত্তিক কাজে ইংরেজির ব্যবহার আছে বলে জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর আমাদের মনে থেকেই যায়! তবে এই মাসের খবর বাংলায় লিখতে কিংবা জানাতে হলেই আমাদের স্মৃতিশক্তি কেমন যেন দুর্বল হয়ে পড়ে।
এই যেমন পয়লা বৈশাখের কয়েকদিন আগে থেকেই বাজারে চৈত্র সেলের হাঁকডাকে মনে পড়ে যায় বৈশাখ মাস আসছে। আবার মাসের প্রথম দিনের হালখাতা সেরে ফিরতে না ফিরতে ভুলেই যাই বৈশাখ মাসের কথা! স্মৃতিশক্তি বড্ড ক্ষণস্থায়ী এখন! শুধু পঁচিশে বৈশাখকে মনে রাখি।
আজকের শিশুরা ‘বৈশাখ জ্যৈষ্ঠ দুই মাস গ্রীষ্মকাল’ এমন বাক্য দুলে দুলে পড়ে না আর। অনেকে জানুয়ারি, ফেব্রুয়ারি জানে, সানডে স্কুল ছুটি জানে। রবিবার ছুটির দিন ওদের মনে থাকে না।
পুরোনো প্রথা, রীতিনীতি, সংস্কৃতি ভুলতে বসা বাঙালি এখন বৈশাখ মাসকে মনে রাখে বৈশাখীমেলার মাধ্যমে। গ্রাম থেকে শহর প্রায় সব জায়গাতেই এই সময় মেলা আসে দূরদূরান্ত থেকে। কাপড়, ফ্লেক্সের গেটের মাথায় বড় বড় হরফে লেখা থাকে বৈশাখীমেলা।
হরেকরকমের জিনিসপত্র, বাসনকোসন, খেলনা, কৃত্রিম বাহারি ফুল, নাগরদোলা সহ বিভিন্ন ধরনের বাচ্চাদের মনোগ্রাহী ‘রাইড’ আর নানা স্বাদের খাবারের দোকান। চিলচিৎকারে বাজছে চটুল হিন্দি গান। চাকা ঘুরিয়ে চলছে নম্বর মেলানোর খেলা। নির্দিষ্ট নম্বর মিললেই জুটে যাচ্ছে পছন্দের বাসন কিংবা খেলনা। কোথাও ছোট তাঁবু বানিয়ে দেখানো হচ্ছে সার্কাস। তবে আগের দিনের মতো সার্কাসের সেই আকর্ষণ আর নেই। বরং এর বদলে চটুল গানে ছেলেমেয়েরা নাচ দেখাতেই ব্যস্ত। যদিও সেসব অগ্রাহ্য করাই বুদ্ধিমানের কাজ।
তবে বৈশাখীমেলায় লোকের আনাগোনার অভাব নেই। ছেলেমেয়ের হাত ধরে বাবা-মায়েরা পৌঁছে যাচ্ছে মেলায়, প্রেমিক-প্রেমিকা পরিচিত চোখের আড়াল হতে খুঁজে নিচ্ছে মেলার মাঠ, ছেলেছোকরারা আড্ডা দিতে পুরোনো ‘ঠেক’ ছেড়ে চলে যাচ্ছে ওখানে, গান শোনাও হচ্ছে, খাওয়াও হচ্ছে, আড্ডাও বাদ যাচ্ছে না।
ছয় বছরের একটা ছেলেকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, বৈশাখ মাস কোনটা? সে সপ্রতিভ উত্তর দিয়েছিল, যে মাসে ওই যে মেলাটা হয়, সেই মাসটা।
সত্যিই তাই! বৈশাখীমেলাই এখন বৈশাখ মাসের পরিচয় একা হাতে বহন করে চলেছে। তবে এই সোশ্যাল মিডিয়ার যুগে মাসজুড়ে চলা বৈশাখীমেলার ফাঁকফোকরে কখনও উঁকি মারে পঁচিশে বৈশাখের টুকটাক অনুষ্ঠান কিংবা ধর্মীয় একটা-দুটো পুজো। নয়তো কী-ই বা লাভ বাংলা মাসের নাম মনে রেখে?
প্রতিবছর ঘটা করে আমরা আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালন করি, কিন্তু মাতৃভাষার যত্ন করি না তেমন। চিঠিপত্রে তারিখটা ইংরেজিতেই লেখা বাঞ্ছনীয় হয়ে ওঠে, কোনওদিন কেউ নিজের নামের নীচে লেখে না, একুশ কিংবা বাইশ বৈশাখ, ১৪৩২। ঠিক যেমন করে রবি ঠাকুর লিখতেন!
(লেখক শিক্ষক। জলপাইগুড়ির বাসিন্দা)