প্রাণগোপাল সাহা
এবছরও নিয়ম করে শুরু হয়ে গিয়েছে নিয়মরক্ষার বইমেলা। নিয়মরক্ষা কথাটি বলার পেছনে রয়েছে বইমেলার অতীত অভিজ্ঞতা। কলকাতার বইপাড়ার রুগ্নতার ছোঁয়া লেগেছে জেলার সব বইমেলায়।
ক’দিন আগে কলকাতার বইপাড়ার করুণ অবস্থা দেখে খুব খারাপ লাগল। আগের দেখা কলেজ স্ট্রিট নিজের কাছে অচেনা লাগছিল। নতুন বইয়ের গন্ধ, শয়ে-শয়ে বইয়ের দোকানে কেনাবেচার ব্যস্ততা, সেই দৃশ্য কোথায় যেন হারিয়ে গিয়েছে। বইয়ের দোকান আছে, দোকানে বই রাখার তাক আছে কিন্তু নেই গল্প, উপন্যাস, কবিতার বই। আছে শুধু পাঠ্যবই। বইয়ের বদলে কোথাও মোবাইল, কোথাও ফাস্ট ফুড, কোথাও পান, বিড়ি শোভাবর্ধন করছে। আগের দেখা বই পড়ার সেই দৃশ্য কোথায় যেন উধাও। গুটিকয়েক দোকানদার ও কিছু প্রকাশনী সংস্থা বাঁচিয়ে রেখেছে বইপাড়ার ঐতিহ্য।
কলকাতাতেই যদি এমন অবস্থা হয়, তা হলে জেলা শহরের অবস্থা তো খারাপ হবেই। জেলা শহরের মেলায় কিন্তু স্থানীয় বইয়ের দোকানের স্টলও বেশি দেখা যায় না।
একটি সময়ে অনেক মানুষ বই পড়তেন, বই উপহার দিতেন। ত্রিশ বছর আগে বিয়েতে উপহার পাওয়া কিছু বই আজও আমার বইয়ের তাকে শোভাবর্ধন করে আছে। সময় পেলে আজও বইয়ের পাতায় খুঁজে বেড়াই অতীতের স্মৃতি। নামীদামি উপহার হারিয়ে গেলেও অমূল্য সম্পদ হয়ে রয়ে গিয়েছে সব বই।
বই পড়া বা বই নিয়ে মনীষীদের হাজারো উক্তি আজও স্পষ্ট মনে পড়ে। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় বলে গিয়েছেন, ‘বই পড়াকে যথার্থ হিসেবে সঙ্গী করে নিতে পারলে, তার জীবনে দুঃখকষ্টের বোঝা অনেক কমে যায়’। দেকার্তে বলেছেন, ‘ভালো বই পড়া মানে গত শতাব্দীর সেরা মানুষের সঙ্গে কথা বলা’। এই ধরনের কথাবার্তা বইপ্রেমী মানুষের জানা। তবু কেন বইপাড়া রুগ্নতায় ভুগছে?
জেলার বইমেলায় বই বিক্রি থেকে রকমারি খাবার বিক্রি বেশি হয়। কারণ অবশ্যই রয়েছে। দর্শনশাস্ত্রে বলা আছে, কারণ ছাড়া কার্য হয় না। যুগের পরিবর্তনের সঙ্গে মানুষের চাহিদার ও রুচির পরিবর্তন হয়েছে। আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহারে মানুষ অভ্যস্ত হচ্ছেন। খাদ্যতালিকায় দেশীয় খাবারের জায়গা দখল করছে ভিনদেশি খাবার। ফলে বইমেলায় বইয়ের স্টলের থেকে খাবারের দোকানে ভিড় বাড়ছে। ফলে দিন-দিন বইয়ের গুরুত্ব কমছে, হারিয়ে যাচ্ছে বইমেলার ঐতিহ্য।
তবে একটি ভালো দিকও আছে। আধুনিক প্রযুক্তির মাধ্যম ব্যবহার করে মানুষ পেতে পারেন যে কোনও কবিতা ও যে কোনও গল্প। মোবাইল ফোনের মাধ্যমে যে কোনও লেখকের লেখা খুব সহজেই পড়া যায়। তবে ছাপার বই পড়া আর মোবাইলে ই-বই পড়ার মধ্যে তফাত অবশ্যই রয়েছে। এত কিছুর মধ্যেও এখনও কিছু মানুষ মগ্ন রয়েছেন সাহিত্যচর্চায়। জেলায় জেলায় লিটল ম্যাগাজিন নিয়মিত প্রকাশনীর মাধ্যমে জানান দিচ্ছে, সাহিত্য এখনও শেষ হয়ে যায়নি, শেষ হয়নি বই পড়ার আগ্রহ। তাই তো ধিকধিক করে হলেও জেলা তথা রাজ্যের বইমেলা টিকে আছে। টিকে আছে বইপাড়ার ঐতিহ্য। বইমেলার ঐতিহ্য।
(লেখক গঙ্গারামপুরের সাহিত্যিক)