- অরুণাভ রাহারায়
এক দশকেরও বেশি আগে জীবনের সবচেয়ে বড় পরীক্ষাটা দিয়েছিলাম। ২০০৮ সালে আলিপুরদুয়ারের হিন্দি হাইস্কুলে। টেস্টের পর থেকেই উৎকণ্ঠা এই ভেবে যে, কোন স্কুলে সিট পড়ে! যথাসময় জানা গেল আমাদের মাধ্যমিক পরীক্ষার সিট পড়েছে চৌপথির পাশে আলিপুরদুয়ার হিন্দি হাইস্কুলে। অভিভাবকরা কিছুটা টেনশন করলেন এই ভেবে, ছেলে হিন্দি বলতে পারে না, প্রশ্ন বুঝতে না পারলে এই স্কুলের শিক্ষকদের জিজ্ঞাসা করে কিছু সমাধান বের করতে পারবে তো! তবে মোটের ওপর ভালোই হয়েছিল পরীক্ষা। আর এই পরীক্ষা দিতে গিয়েই সঞ্চয় হয়েছিল বিচিত্র অভিজ্ঞতা।
যেমন আমাদের ক্লাসমেট গৌরাঙ্গ থাকত খোলটার দিকে। হঠাৎ দেখি ইংরেজি পরীক্ষার দিন হিন্দি হাইস্কুলের পেছনের জঙ্গল থেকে কী একটা বিশেষ ধরনের গাছের পাতা তুলে এনে বেঞ্চের সারা গায়ে ঘষছে! আমি বললাম– কী রে এখানে এসব করার মানে কী? ওর উত্তর : পাতা ঘষলে বাজে গন্ধ ছড়াবে! আগের দিন দেখলি না ম্যাম এসে কেমন আমার বেঞ্চের সামনে দাঁড়িয়েছিলেন। আজ দাঁড়াবেন না। বেঞ্চের গা দিয়ে দুর্গন্ধ ছড়াবে, আর আমি নিশ্চিন্তে পরীক্ষা দেব! একথা শুনে আমি তো থ!
সেই ম্যামের সঙ্গে তখন পরিচয় ছিল না। পরে জানা গেল, তিনি আমাদের অগ্রজ কবি ও অনুবাদক শৌভিক দে সরকারের স্ত্রী। কলেজে ভর্তি হওয়ার পর শৌভিকদার সঙ্গে বেশ সাক্ষ্য হয়। একদিন অরবিন্দনগরে তাঁদের বাড়িতে গিয়ে দেখি হিন্দি হাইস্কুলের সেই রাগি ম্যাম! মুহূর্তে চমকে গিয়েছিলাম চিনতে পেরে। শৌভিকদা আলাপ করিয়ে দিতেই বললাম যে, আমাদের মাধ্যমিক পরীক্ষায় আপনি ছিলেন প্রথম দু’দিনের দুঃসাহসিক গার্ড! আমার কথা শুনে তাঁর মুখে অট্টহাসি। তবে সেই স্কুলে পরীক্ষা দেওয়ার সময় আরও কয়েকজন মাস্টারমশাইকে পেয়েছিলাম, যাঁরা আমাদের প্রশ্ন বুঝে নিতে অভূতপূর্ব সাহায্য করেছিলেন। ভাষার দিক থেকে দূরত্ব থাকলেও তাঁরা যথাসাধ্য চেষ্টা করেছিলেন আমাদের পাশে থাকার জন্য। আর এ কারণেই নাম ভুলে গেলেও তাঁদের মুখচ্ছবি আজও স্পষ্ট মনে আছে।
পরীক্ষা একটা বস্তু বটে! নামের মধ্যেই লুকিয়ে আছে টেনশন। লুজ শিট খাতার সঙ্গে বেঁধেছি কি না, রাফ পেজ স্টেপল হল কি না, ঠিক সময় সব লিখে শেষ করতে পারব তো– এইসব ভেবেই টেনশন হত খুব। মাধ্যমিক আর উচ্চমাধ্যমিকের পর পরিবার ছেড়ে চলে এলাম কলকাতায়। আর পরিবার ছেড়ে দূরে এসে বুঝতে পারলাম প্রতিদিনের জীবন সংগ্রামের নামই পরীক্ষা। কী-এক ভাগ্যচক্রে তীব্রভাবে ঢুকে পড়লাম সাহিত্যে। কবিতাকে কেন্দ্র করে এগিয়ে চলল আমার জীবন। যে পরীক্ষার আসলে কোনও প্রশ্নপত্র নেই! এবারের বইমেলায় আমার দুটি গদ্যের বই বেরিয়েছে। প্রকাশের মুখ দেখে বুঝতে পেরেছিলাম– এই বইয়ের সাফল্য আসাটাই আমার জন্য এক ধরনের পরীক্ষা! কেননা এই পরীক্ষায় পাশ করতে পারলেই আগামী বইয়ের জন্য আমার কাছে পাণ্ডুলিপি চাইবেন প্রকাশক।
তবে এখন বোধহয় বই বিক্রির সুদিন। বইমেলা শেষে ট্রেনে উত্তরবঙ্গে ফেরার সময় এক বন্ধুর সঙ্গে কথা হচ্ছিল এই নিয়ে। তাঁর মতে পিডিএফ অনলাইন এসে যাওয়ায় ছাপা বইয়ের কদর কমেছে। মুদ্রিত বইয়ের বিক্রি আগামী দিনে নাকি উঠেই যাবে। আমিও কথার পিঠে কথা বসালাম। কিছুদিন আগে এক প্রকাশকের মুখে শুনেছিলাম : সিস্টেম যতই আপডেট হোক মানুষের শরীর তো আর আপডেট হচ্ছে না! সেজন্য বেশিক্ষণ পিডিএফ পড়লে আমাদের চোখে ধাঁধা লেগে যায়। অনলাইন ও পিডিএফ-এ বেশিক্ষণ টেক্সট পড়া যায় না তাই। আর সে কারণেই আগামীতে ছাপা বইয়ের কদর বাড়বে। তিনি এ ব্যাপারেও নিশ্চিত হয়েছিলেন যে, পিডিএফ এসেছে বলেই পিডিএফ-এ এক ঝলক দেখে মূল বইটির হার্ডকপি কিনতে চাইবে পাঠক।
এই পিডিএফ-অনলাইনের যুগে তিনি যে স্ট্রাগল করে যাচ্ছেন এবং মুদ্রিত বই বিক্রি করে সংসার চালাচ্ছেন– তা যে এক ধরনের বড় পরীক্ষা সে কথা তাঁর মুখের কথায় স্পষ্ট হয়ে গেল। কলকাতায় যাওয়ার পর গত দেড় দশকে দেখলাম কলেজ স্কোয়ারের আশপাশে জামাকাপড়ের যে দোকানগুলো ছিল একে একে তারা হয়ে উঠল বইয়ের দোকান কিংবা প্রকাশনালয়। এ কিন্তু পিডিএফ-অনলাইনের যুগেও বড় একটা সাফল্যের দিক।
অতএব পরীক্ষার প্রশ্ন যতই কঠিন হোক, ঠান্ডা মাথায় ভেবেচিন্তে লিখে আসতে হবে সবটা। আনকমন প্রশ্নের উত্তর লিখে ভালো নম্বর পাওয়াকেই চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে উতরে যাওয়া বলে। জীবনে চলার পথে যতই কঠিন প্রশ্ন আসুক– যথাযথ উত্তর দিয়ে ভালো নম্বর পাওয়া যেতেই পারে একটু চেষ্টা করলে। ফাঁকা মাঠে গোল দিয়ে যেমন লাভ নেই, সহজ প্রশ্নের উত্তর দিয়েও তেমনই নিজের মুনশিয়ানা প্রকাশ করা যায় না। বরং প্রশ্ন জটিল হোক—‘ছোট্ট ছোট্ট পায়ে চলতে চলতে ঠিক পৌঁছে যাব/ সেই চাঁদের পাহাড় দেখতে পাব।’