বুধবার, ২৬ মার্চ, ২০২৫

নকশালবাড়ি থেকে গৌড়জনকথা

শেষ আপডেট:

  • বিপুল দাস

একজন লেখক তাঁর লেখক জীবনে কী লিখবেন, সেটা অনেকটাই স্থির হয়ে যায়। কোন মাটিতে তাঁর শিকড় ছড়ানো রয়েছে। কোন জনজীবনের ভেতরে তাঁর চলাফেরা। কোন বাতাস থেকে তাঁর বেঁচে থাকার অক্সিজেন সরবরাহ হয়। এসব মিলেমিশে লেখকের রক্তে ঘোরাফেরা করে। এসবই একসময় তাঁর লেখার ভেতরে চেতনে ও অবচেতনে চলে আসে। কাহিনী বিন্যাসে, চরিত্র নির্মাণে, মানুষের আনন্দ বেদনা অশ্রু রক্ত ঘাম ঘৃণা ভালোবাসার পটচিত্রখানি যখন আঁকা হয়, তখন খুব স্বাভাবিকভাবেই সেই মাটি, জল, জঙ্গল, পাহাড় ও অরণ্যের কথা পটচিত্রের পটভূমি হয়ে ওঠে। তার সঙ্গে থাকে লেখকের ব্যক্তিগত রাজনৈতিক আদর্শ, সামাজিক ন্যায় অন্যায়, সততা অসততা সম্পর্কে ধারণা। এভাবেই আমরা দেখতে পাই চোমং লামার (বিমল ঘোষ) ছোটগল্প ও উপন্যাসে বারেবারে ফিরে এসেছে উত্তরের পাহাড়, অরণ্য, নদী, সীমান্ত ও চা বাগানের ইতিবৃত্ত। শুধু ওপরে ওপরে আপাত দেখা নয়। তাঁর অন্তর্দৃষ্টি গভীর অনুভূতি দিয়ে ছুঁয়ে দেখেছে এই বঙ্গের উত্তর ভূখণ্ডের লোকজীবনকে। চা বাগানের কুলিকামিনের জীবনের যাপনকথা। বনবস্তির প্রান্তিক মানুষজনের জীবনগাথা। পারাপারের বৃত্তান্তে ক্যারিয়ারদের মৃত্যুকে হাতের মুঠোয় নিয়ে এপার ওপার করার ইতিহাস। চা বাগানের লেবারদের নিয়ে বা সীমান্তে মাল পারাপার করার ইতিহাস নিয়ে ভবিষ্যতে গবেষকদের কাছে এসব এক আকর গ্রন্থ হয়ে রইবে।

                শুধু চা বাগানকেন্দ্রিক উপন্যাসেই যে তিনি মুনশিয়ানা দেখিয়েছেন, তেমন নয়। একসময় আমরা দেখেছিলাম শহর গ্রামের দেওয়াল ভরে গিয়েছিল মাও সে তুং-এর টুপিমাথায় স্টেনসিলের সেই বিখ্যাত ছবিতে। সদর দপ্তরে কামান দাগার কথা, বসন্তের বজ্রনির্ঘোষের কথা। খুব দ্রুত সমস্ত ভারতবর্ষে ছড়িয়ে পড়েছিল নকশালবাড়ি আন্দোলন। সামাজিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক সেই ঝোড়ো সময়কে খুব কাছ থেকে দেখেছিলেন চোমং লামা। তারই ফলশ্রুতি ‘নক্‌শালবাড়ি’ আকর গ্রন্থটি। পালযুগের প্রেক্ষিতে লিখেছেন ‘গৌড়জনকথা’। রাষ্ট্রযন্ত্রের কৌশলের বিরুদ্ধে প্রান্তজনের জেগে ওঠার গল্প। শোষণপীড়নের বিরুদ্ধে দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া মানুষের সমষ্টিগত প্রতিরোধের কথা।

                যে বইটি তাঁকে সর্বাধিক খ্যাতি এনে দিয়েছে, বহুলপঠিত এবং বহুচর্চিত বইটি ‘পাতার নাম জনম’। আমাদের বুঝতে অসুবিধা হয় না এ পাতা আম পাতা বা জাম পাতা নয়। এ পাতায় থাকে গাঢ় খয়েরি রঙের এক উপেক্ষার, যার নাম ট্যানিন। দার্জিলিং, ডুয়ার্স এবং অসমের বিস্তীর্ণ অঞ্চলজুড়ে সবুজ কার্পেটের মতো চা বাগান, আর প্রতিটি চা গাছের শীর্ষে ঘাম-রক্তের কথা। আদিবাসী মানুষদের একদিন আড়কাঠিরা গিয়ে ‘এল ডোরাডো’র স্বপ্ন দেখিয়ে নিয়ে এসেছিল ছোটনাগপুর, পালামৌ, ময়ূরভঞ্জ থেকে। তারপর করে দিল বন্ডেড লেবার। আমাদের বাংলা সাহিত্যের মূলস্রোতে এঁদের কান্না ঘাম অশ্রু রক্তের কথা খুব বেশি আসেনি। এসেছে যা তা হল কুলিলাইনে মাদল বাজিয়ে হাঁড়িয়া খেয়ে উৎসবের কথা। কিন্তু এঁদের জীবনের অন্তরঙ্গ ছবি, এই সমাজের ধরম করম আচারবিচার সংস্কার, কঠিন জীবন সংগ্রামের কথা খুব বেশি কেউ লেখেননি। একবার একটি বহুল প্রচলিত পাক্ষিক পত্রিকায় বিখ্যাত এক লেখিকার ডুয়ার্সের পটভূমিতে উপন্যাসে পড়েছিলাম এ অঞ্চলের চা শ্রমিকের মুখে তিনি অবলীলায় বাঁকুড়া-পুরুলিয়ার আদিবাসীদের ভাষা দিয়েছিলেন। এরা কথা বলে মূলত সাদরি ভাষায়। আর সেই ধারাবাহিক উপন্যাসে ডুয়ার্সের শ্রমিকের মুখে ছিল– তু কেনে যাবি না। এই ফাঁকিবাজি দিয়ে চা বাগানের মানুষের আত্মাকে ছোঁয়া যায় না। কেন পাতার নাম জনম, সেটা বুঝতে হলে চোমং লামা (বিমল ঘোষ) হতে হয়। বঞ্চিত, লাঞ্ছিত, চিরকালের নিপীড়িত আদিবাসী সমাজের দিকে ভালোবাসাভরা দৃষ্টিতে না তাকালে, চা বাগানের লেবারদের দৈনন্দিন ঘামের ইতিহাস না জানলে, অর্থনৈতিক শোষণের কথা না জানলে, এমনকি হাতি এবং বাগানের নালায় লুকিয়ে থাকা চিতার কথা না জানলে পাতার নাম জনম লেখা যায় না। বাংলা সাহিত্যের পাঠকদের সৌভাগ্য চোমং লামার মতো একজন অন্তর্দৃষ্টিসম্পন্ন, অনুভূতিশীল মানুষ একসময় সতীশচন্দ্র টি এস্টেটে দীর্ঘদিন বাগানবাবুর দায়িত্ব পালন করেছিলেন। সে কথাই প্রথমে বলেছিলাম। যে মাটি একজন লেখকের চারণভূমি, সেই মাটিতে তাঁর বেঁচে থাকার শিকড় গভীরে চলে যায়। উত্তরবাংলার অরণ্য, পাহাড়, নদী, চা বাগান, বিভিন্ন উপজাতি, তাঁদের বিচিত্র লোকাচার, তাঁদের দারিদ্র্য, উচ্চশ্রেণির থেকে অবহেলা– এসব সয়ে তাঁদের জীবনের স্রোত বয়ে যায় নিস্তরঙ্গ, নিরন্তর। তাঁদের জনম বিধৃত হয়ে থাকে দুটি পাতা একটি কুঁড়ি অভ্যস্ত হাতে তুলে পিঠে ঝোলানো টুকরিতে জমা করায়।

                চোমং লামার (বিমল ঘোষ) জন্ম ১৯২৫ সালে। সেই হিসেবে এ বছর তাঁর জন্মের শতবর্ষ পূর্ণ হচ্ছে। উত্তরবঙ্গ সংবাদে তাঁর আত্মজীবনী ধারাবাহিক হিসেবে প্রকাশিত হয় ‘এই জন্মের বৃত্তান্ত’ নামে। লিখেছেন ষোলো বা সতেরোটি উপন্যাস। অনধিক পাঁচশো ছোটগল্প। আদিনিবাস ছিল যশোহর জেলার নড়াইলের এক গ্রামে। দেশভাগের পর আরও সহস্র উদ্বাস্তুর মতো তাঁকেও ভিটেমাটির মায়া ছেড়ে এপারে চলে আসতে হয়। প্রথমে কলকাতায় থিতু হয়ে সাহিত্যজগতে থাকার চেষ্টা করলেও উল্লেখযোগ্য কিছু করতে পারেননি। তারপর শিলিগুড়িতে স্থায়ী বাস শুরু হয়। তখন চা বাগানের চাকরিসূত্রে তাঁর কাছে এক নতুন জগতের দ্বার খুলে গেল। ডুয়ার্সের ঘন সবুজ অরণ্য, কত জনজাতি, কী বিচিত্র তাঁদের লোকাচার, কী কঠিন তাঁদের জীবনযাত্রা। তাঁর লেখার রসদ খুঁজে পেলেন এখানেই। পাতার নাম জনম আশ্চর্য এক ডকুমেন্টারি। কিন্তু শুধু ডকুমেন্টেশন নয়, সাহিত্যের যে প্রসাদগুণের কথা আমরা বলি, সেই গুণ রয়েছে এই উপন্যাসে। ফলে শুধু ইতিহাস নয়, আশ্চর্য এক মানবিক আবেদনে সমৃদ্ধ হয়েছে এই লেখা।

                ব্যক্তিগতভাবে তাঁর সঙ্গে আমার সম্পর্ক ছিল। সেই সূত্রে বুঝেছি মানুষটি ছিলেন সহজ সরল, সাদাসিধে। কথাবার্তায় ছিলেন অকপট। জীবনযাপনেও তাই। তাঁর গদ্যের স্টাইলটিও ছিল সহজ। অনর্থক মগজের কসরত তিনি করেননি। সহজ বাক্যে সাধারণ পাঠকদের জন্য প্রান্তিক মানুষের অসাধারণ জীবনের ছবি এঁকেছেন। সে হতে পারে মানুষকে সীমানা পার করিয়ে দেবার গল্প। সে হতে পারে বন্ধ চা বাগানের একজন লেবারের বিপন্নতা।

                আমার মনে হয়েছে হয়তো বাংলা সাহিত্যসংস্কৃতির রাজধানী থেকে অনেক দূরে প্রান্তিক ভূমিতে বসে সাধনা করে যাওয়ার ফলেই হয়তো যতটা আলোক তাঁর পাওয়ার কথা ছিল, পাদপ্রদীপ থেকে ততটা লাইমলাইট তিনি পেলেন না। আরও অনেক সম্মান পাওয়ার যোগ্য ছিলেন তিনি। ‘বঙ্গরত্ন’ সম্মানে ভূষিত এই শ্রদ্ধেয় লেখক উত্তরের মায়া কাটিয়ে অনেক দূরে চলে গেলেন ২০১৬-তে। আমাদের প্রণাম রইল।

Uttarbanga Sambad
Uttarbanga Sambadhttps://uttarbangasambad.com/
Uttarbanga Sambad was started on 19 May 1980 in a small letterpress in Siliguri. Due to its huge popularity, in 1981 web offset press was installed. Computerized typesetting was introduced in the year 1985.

Share post:

Popular

More like this
Related

আমরা দুজন একই গাঁয়ে থাকি

কৃষ্ণ শর্বরী দাশগুপ্ত লিফটের জন্যে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে...

কবিতা

১ এখন বসন্ত  অরণি বসু    এখন বসন্ত। এখন গাছে গাছে...

বিচিত্র ইতিহাসের দেবী হংসেশ্বরী

পূর্বা সেনগুপ্ত দারুমূর্তির প্রসঙ্গে যে সব বিখ্যাত দেবালয় ও...

বারাণসীতে লুকিয়ে কোচবিহারের ইতিহাস

শৌভিক রায়  ‘অলিগলির গোলকধাঁধায়’ কোথায় যে লুকিয়ে মন্দিরটি, বুঝতেই...