- বিপুল দাস
একজন মানুষের দুটি পরিচয় থাকে। একটি তার বহিরঙ্গের পরিচয়, অন্যটি তার অন্তরঙ্গ রূপ। এই অন্তরঙ্গ রূপের পরিচয় পেতে হলে তার সঙ্গে দীর্ঘদিনের অন্তরঙ্গ মেলামেশার দরকার। আপাত স্বভাবচরিত্রের আড়ালে অন্য এক মানুষ লুকিয়ে থাকে। তাকে চিনতে হলে দরকার হয় এক অন্তর্ভেদী দৃষ্টির। আপাত শান্ত সমুদ্রের আড়ালে লুকিয়ে থাকে অন্য এক ভয়ংকর অন্তস্রোতা প্রবাহ। প্রতিটি শহরের তেমনি দুটি চরিত্র থাকে। একটি তার ঘরবাড়ি, পথঘাট, আলোকোজ্জ্বল বিপণিসমূহ, নাগরিক সমাজ। অন্য এক পরিচয় থাকে এসবের আড়ালে আর এক স্পন্দন। সেই স্পন্দন সহজে টের পাওয়া যায় না। খুব গভীর মেলামেশা, ভালোবাসা, নিবিড় দৃষ্টি ফেলে খুঁজে পেতে হয় এক শহরের ভেতরে আর এক শহরের ঠিকানা। লুকিয়ে থাকা সেই শহরের থাকে অনেক ইতিহাস, অনেক আনন্দবেদনা, অনেক দীর্ঘশ্বাস, অনেক পাওয়া-না পাওয়ার কথা। কত পুরোনো বাড়ি, পুরোনো মাঠ, পুরোনো গাছ উন্নয়নের দাপটে সব হারিয়ে যায়। পুরোনো মানুষজন স্মৃতিকাতর হয়ে ভাবে এখানে সেই বিশাল শিরীষ গাছটা ছিল। স্টেডিয়ামের পাশ দিয়ে যেতে যেতে ভাবে এই মাঠে সন্ধেবেলায় বসে বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা মেরেছে। সেই তিলক ময়দান এখন কাঞ্চনজঙ্ঘা ক্রীড়াঙ্গন।
আমাদের এই শহরের জনবিন্যাস পালটে গেছে অনেকদিন। কিন্তু শহরের ভেতরে অন্য একটা পুরোনো শহর এখনও রয়ে গেছে। উঁচু উঁচু টাওয়ার আর আকাশছোঁয়া ইমারতের আড়াল থেকে এখনও উঁকি মারে কাঞ্চনজঙ্ঘা শীর্ষ। ভোরে প্রথম কিরণপাতে রক্তিম হয়ে ওঠে তার চূড়া। আবার সন্ধ্যায় অন্যরকম লাল বিদায়ি চুম্বনে তাকে দুখি লাল ছটায় রক্তিম করে। এ শহরের শীত আর বর্ষার কথা বলে পুরোনো মানুষজন। সে শীত আর বর্ষার দাপট আগের মতো নেই। তবু কোনও কোনও বছর যেন পুরোনো শীত নেমে আসে, কনকনে বাতাস ছুটে আসে উত্তরের পাহাড় থেকে, রঙিন গরম পোশাকপরা মানুষজনে শহর ভরে যায়। কখনও টানা পনেরোদিন সূর্যের মুখ দেখতে পাওয়া যায় না। জামাকাপড় থেকে বর্ষার গন্ধ যেতে চায় না। এই অর্বাচীন শহর থেকে তখন প্রাচীন এক শহরের অস্পষ্ট ছবি ফিরে আসে। পুরোনো লোকজন গল্প বলে এ রকম এক শীতে মহানন্দার ওপার থেকে একবার বাঘ এসেছিল মিলনপল্লির এক জোতে। জোতদারের গোয়াল থেকে গোরু টেনে নিয়েছিল। এ রকম বর্ষাতেই মহানন্দায় কী ভীষণ গেরুয়া জলের ঢল নেমেছিল। পাহাড় গড়িয়ে নেমে এসেছিল শেকড়ছেঁড়া চা গাছ, শাল, শিমুল। কত মানুষের ভাঙা ঘর, কাঁথাকানি, কত মরামানুষ ভেসে গিয়েছিল মহানন্দার জলে। আধুনিক এই শহরের আড়ালে লুকিয়ে থাকে এইসব গল্প। শহরের ভেতরে আর এক শহরের কথা। প্রকৃতির অনিশ্চয়তার কথা কেউ বলতে পারে না। কেউ বলতে পারে না আবার কোনও দিন তেমন বিপর্যয় নেমে আসবে কি না।
নদীর ফেলে যাওয়া পুরোনো খাতের যেমন চিহ্ন থেকে যায়, সেখানে কাশের বন ছেয়ে থাকে, আস্তে আস্তে সেখানে একদিন জনবসতি গড়ে ওঠে, তেমনি নতুন শহরে বুকে কান পাতলে পুরোনো গল্প শোনা যায়। শোনা যায় এক বালকের মুখে গল্প। সে একদিন দেখেছিল তার বাড়ির পাশে জোড়াপানি নদীর ওপারে কিছু মানুষজন এসে ফিতে ফেলে জমি মাপামাপি করছে। তারপর তার চোখের সামনেই গড়ে উঠল নিউ জলপাইগুড়ি জংশন। কোনও গুরুত্বপূর্ণ মোড়ের নামের উৎস অনুসন্ধান করলে অনেক ভুলে যাওয়া কথা, অনেক ইতিহাস পাওয়া যায়। শহরের বিভিন্ন স্কুলের নামের উৎস অভিমুখে যাত্রা শুরু করলে পাওয়া যায় বিদ্যানুরাগী কিছু অর্থবান মানুষের ইতিহাস। তরাই স্কুল, জ্যোৎস্নাময়ী স্কুল, তিলক ময়দান, শৈলেন্দ্র স্মৃতি পাঠাগার, কিরণচন্দ্র শ্মশানঘাট, লালমোহন মৌলিক বিসর্জনঘাট– এসব নামের পেছনে রয়েছে এ শহর গড়ে ওঠার ইতিহাস।
প্রতিটি শহরের একটি নিজস্ব গোপন স্পন্দন থাকে। অনুভবী মন নিয়ে কান পাতলে শোনা যায় এক শহরের ভেতরে লুকিয়ে থাকা অন্য এক শহরের হৃৎস্পন্দন। সে পরিচয় হোটেল, নার্সিংহোম, ফ্লাইওভার, আলোকোজ্জ্বল বিপণি, প্রশস্ত পথঘাট দেখে বোঝা যায় না। অতিথিবৎসল এ শহরে রয়েছে অসংখ্য অন্য প্রদেশ, এমনকি অন্য রাষ্ট্রেরও মানুষ। সব মিলেমিশে গেছে। এ শহরের আপাত চেহারার আড়ালে লুকিয়ে থাকা অন্য শহরের পরিচয় তারা পাবে না। তারা তো জানে না এক সময় এ শহরে বৈকুণ্ঠপুর ফরেস্ট থেকে উড়ে আসত টিয়াপাখির ঝাঁক। তারা জানে না তরাই স্কুলের মাঠে যুদ্ধবিমান ভেঙে পড়ার কথা। তারা জানে না একসময় রথখোলা পার হলেই শুরু হত শাল শিমুল জারুল বহেড়ার অরণ্য। জমিখোর মানুষের লোভের করাত সব উচ্ছেদ করে দিয়েছে। তারা জানে না শালুগাড়া পার হলে সিমেন্ট বাঁধানো সিঙ্গল রোডের কথা। এ শহরের টেনিস কোর্টের কথা তারা জানে না। কখনও স্মৃতি রয়ে যায়, কখনও সেটাও সাফ হয়ে যায়।
অমূল্য সব স্মৃতি নিয়ে জরাজীর্ণ হয়ে পড়ে আছে টাউন স্টেশন। এখানেই হুইলারের স্টল থেকে ইংরেজি গল্পের বই, পত্রিকা নিয়ে টয়ট্রেনে উঠত বিদেশি পর্যটক। অনাবিল প্রকৃতির সাহচর্য পেয়েছে এই শহর। তিস্তা আর মহানন্দার মাঝে এই শহর। খুব দ্রুত প্রয়োজনের তাগিদেই জনবিস্ফোরণ ঘটেছে। স্বাধীনতার পরে, অসম আন্দোলনের সময়, বাংলাদেশের স্বাধীনতার সময়। বাণিজ্যমুখী এ শহরে অবিরল মানুষের ঢল নেমে চলেছে ভাগ্যপরিবর্তেনের জন্য। জনবিন্যাসের চরিত্র পালটে গেছে। তবু এখনও কিছু বাড়ি রয়ে গেছে পুরোনো ধাঁচের। চারফুট উঁচু খুঁটির ওপর কাঠের পাটাতনের, কাঠের ঘর। তরাই অঞ্চলে এরকমই ছিল সাধারণ মানুষের ঘর। ইটের বাড়ি ছিল না বললেই হয়। একটু রাতে হিলকার্ট রোড ধরে হাঁটতে হাঁটতে মনে পড়ে এখানেই ছিল তরাই পাইস হোটেল। এখানে ছিল ট্রয়ট্রেনের লাইন। এই লাইন দিয়েই ট্রেন যেত দার্জিলিং-এ। পাহাড় পরিষ্কার থাকলে দেখা যেত রাতে কার্সিয়াং আর তিনধারিয়ার আলো। এসব কথা মিশে আছে শহরের গোপন পরতে পরতে। এ শহরের চরিত্রে মিশে আছে পাহাড়, পাহাড়ি নদী, চা বাগান, অভয়ারণ্য। সেই অরণ্য থেকে টাটকা বাতাস, সবুজ গন্ধ নগরজীবনের উষ্ণতাকে স্নিগ্ধ করে তুলত। উন্নয়নের বুলডোজারে উচ্ছেদ হয়ে গেছে চা বাগান, বিস্তীর্ণ অরণ্য। পুরোনো মানুষজন নস্টালজিক হয়ে খুঁজে ফেরে ব্রহ্মকুটির। পুরোনো ডাক্তারদের অবিশ্বাস্য ক্লিনিকাল আই-এর গল্প শোনায়। বাতাসে কান পাতলে শোনা যায় কত উত্থানপতন, কত সার্থক ও ব্যর্থ প্রেমের কাহিনী, কত মাতাল ও মস্তানের গল্প, বড়মানুষদের কত কেচ্ছার গল্প। সব মিশে আছে এই শহরের ধুলোয়। এ শহরের ভেতরে আছে আর একটা শহর। হায় বুঝি তার খবর পেলে না।