সোমবার, ১৯ মে, ২০২৫

শিক্ষাঙ্গন বলো, ভালো আছে তো?

শেষ আপডেট:

  • চিরদীপা বিশ্বাস

‘আমাদের সময় হলে চাবকে পিঠের ছাল তুলে নেওয়া হত’… দুই মধ্যবয়স্ক ভদ্রলোক পাড়ার মোড়ে জটলায় ব্যস্ত একদল যুবকের মুখের সুবচনকে ইঙ্গিত করে কথাগুলো বলতে বলতে পাশ কাটিয়ে চলে গেলেন। গন্তব্য একই হওয়ার কারণে অগত্যা ওদের পেছনে হাঁটতে থাকলাম ভিড় ফুটপাথ দিয়ে।

  ‘বাবানটার টিউশন নিয়ে হয়েছে ঝামেলা। দু’দিন হোমওয়ার্ক করে যায়নি বলে ওই ক্লাস ফাইভের ছেলের ওপর এত রাগারাগি করেছেন টিউশন মিস, যে বেচারার জ্বর চলে এসেছে কাঁদতে কাঁদতে। ছাড়িয়ে দেব ওটা।’ সমর্থন এল ‘ইস, বাচ্চা মানুষ, এভাবে বকলে হয়!’ ঠিক ঠাওরাতে পারলাম না যে, এই একই লোক দুটো প্রথম মন্তব্য করেছিলেন কিনা।

     শুধু পুঁথিগত বাঁধাধরা বিদ্যা নয়, একটা ছাত্রের মাটির তাল থেকে সঠিক মানুষ হয়ে ওঠার পেছনে যে চারিত্রিক শিক্ষা দরকার তাও শিক্ষকদের থেকেই মেলে। রাগে গজগজ করা কোনও শিক্ষক যখন বলেন ‘তোর দ্বারা কিস্যু হবে না রে গাধা’ তখন এর পেছনে লুকিয়ে থাকে, একটাই নিশ্চুপ চাওয়া ‘তোরা মানুষের মতো মানুষ হ’।

আজও মনে পড়ে সেই এক সন্ধের কথা, যেদিন আমি বুঝেছিলাম হাই-পাওয়ারওয়ালা চশমার ওপারে থাকা রাগী রাগী দুটো চোখ ঝাপসা হয়ে এসেছিল শুধু আমার ব্যর্থতার দুঃখে। কিছু নম্বরের জন্য ক্লাস থ্রি’র অ্যাডমিশন টেস্ট দিয়ে জেলা তথা রাজ্যের অন্যতম সেরা স্কুলটাতে ভর্তি হতে পারিনি সেদিন। আমার বয়সটা তখন আমাকে দুঃখ অনুভব করার সুযোগ সেভাবে দেয়নি। কিন্তু ওই দিদিমণি যাঁর কাছে অ্যাডমিশন টেস্টের তৈরি করেছিলাম এক বছর ধরে, তাঁর চোখ সেদিন অনেক কিছু বলে দিয়েছিল। তবুও জল মুছে, হাসিমুখে জড়িয়ে ধরে বলেছিলেন  ‘মাধ্যমিকটা জমিয়ে দিস, তারপর ঠিক পারবি’। সেই আশীর্বাদ কাজে লেগেছিল, পেরেছিলাম আমি।

     হাতে ধরে ক, খ শেখানো থেকে কোন রান্নায় কী মশলা যায়, সাইকেলের ব্যালেন্স করার ট্রেনিং থেকে জীবনের গাড়ির স্টিয়ারিং শক্ত করে ধরার বল অনবরত যাঁরা দিয়ে চলেছেন, সেই মা-বাবা, অভিভাবকেরা সবাই আমাদের শিক্ষক। তবে দুর্ভাগ্যজনক লাগে, যখন এই মানুষগুলোকে শুনতে হয় ‘ও তোমরা বুঝবে না’- তাও তাদের মুখ থেকে, যারা কথা বলাটাই শিখতে পারত না, যদি না ওঁরা বট গাছ হয়ে থাকতেন।

   ‘অমুক স্যর কান ধরে দাঁড় করিয়েছেন জানো…ওরাও তো বড় হচ্ছে বলো, মান-সম্মান তো ওদেরও আছে’- বড্ড জানতে ইচ্ছে করে- সারাটা জীবন মান-সম্মান নিয়ে বাঁচতে পারবে তো, যদি এখন সঠিক শাসন না পায়! এরাই তারপর হেডমাস্টার, প্রিন্সিপালের ঘর ঘেরাও করার স্পর্ধা দেখায়, অভব্য ব্যবহারকে নিজেদের বিপ্লবের অধিকার বলে গর্জন করে। মুক্তির স্বাদাস্বাদনে মত্ত হয়ে বোর্ড পরীক্ষার শেষে পাঠ্যবই কুটি কুটি করে ছিঁড়ে রাস্তা ভরায়। ভাবলে রীতিমতো গা শিউরে ওঠে, যে এদেরই কেউ কেউ হয়তো অদূরভবিষ্যতে দেশের আইনকানুনের রক্ষাকর্তা হবে।

     সেই কারণে, সবার প্রথমে নিজের মনের মধ্যেকার দ্বৈতসত্তাটিকে হটিয়ে ফেললে মুশকিল। ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক নিয়ে দু’পাতা লিখে ফেলব, প্রাইমারি স্কুলের উঠে যাওয়া আমাদের চোখে জল আনবে, নস্টালজিক হব, অথচ পরক্ষণেই ‘আমার মেয়েটার সঙ্গে উঁচু গলায় কথা বলেন কী করে আপনি!’ উপসংহার খাড়া করলে চলবে! আপনি ঘরে শাসন করবেন না, ঘরের বাইরে যাঁরা শাসন করতে যাবে, তাঁদের রীতিমতো শূলে চড়ানোর দশা করবেন আর আশা রাখবেন ভবিষ্যৎ সমাজ ‘বিদ্যা দদাতি বিনয়ং’ শিখবে!

গুটিকয়েক ব্যতিক্রম সরিয়ে রাখলে শিক্ষকমহলেও এসব কারণে আজকাল এক ছাড়া ছাড়া ভাব দেখা যায়। ক্লাসরুমের গণ্ডিতেই যে পড়ুয়া শিক্ষকের শাসন মানতে নারাজ, কোন হিসেবে পাড়ার মোড়ে ‘মস্তানি’ করতে দেখলে তাকে এগিয়ে গিয়ে কড়া সুরে ধমক দেবেন তাঁরা!

আমাদের প্রজন্ম বুড়িয়ে তো যায়নি, অথচ বছর পনেরো পেছনে ফিরলে পরিষ্কার দেখতে পাই, বাড়ির ভেতরে অভিভাবকেরা ঠিক যতটা কড়া বাঁধনে, নিয়মে রেখেছিলেন বাইরেও সেই একই রীতি আমরা মেনে চলতে বাধ্য হতাম। যদি কোনও দিদিমণি ইস্কুল গণ্ডির বাইরেও দুষ্টুমি করতে দেখে ফেলেন, তাহলে আর রক্ষে নেই। কই, মা তো এতে দোষ দেখতেন না। শিক্ষকেরা তখন রীতিমতো ত্রাস। কানমলা কক্ষনো কাউকে দিতেন না, কিন্তু সেই ভয়ে পড়া করে যাওয়া চাইই চাই, পড়া না পারলে রীতিমতো বাড়ি বয়ে গিয়ে নালিশ, তারপর উত্তমমধ্যম।

আজও রাস্তাঘাটে চলাফেরার সময় কোনও শিক্ষকের দেখা পেলে একইভাবে থমকে যাই মিনিট দুই সেই ছোট্টবেলার মতো। তবে ভয়ে নয়, শ্রদ্ধায়। বর্তমানে এসব কেমন যেন যান্ত্রিক আর কর্পোরেট স্টাইলে বেড়ে উঠছে। দিদিমণি থুড়ি মিসরা তাদেরই একটু সুনজরে রাখেন, যাঁরা ‘থ্রি ডেজ ইন আ উইক’ স্পেশাল রগরানিতে থাকতে ইচ্ছুক। হাইস্কুলেও এসব চল দেখা যাচ্ছে বৈকি।  এই নিউ ট্রেন্ড মানতে বাধ্য হচ্ছি আমরাও।

কী আর করার, সরস্বতীর পাশাপাশি লক্ষ্মীদেবীর কথাটাও তো ভাবতে হবে।

গুরু-শিষ্য পরম্পরায় গুরুদক্ষিণা বলেও একটা বিষয় তো থাকেই। তবে, আগে তা ছিল ‘তুই ভালো মানুষ হ রে ছোঁড়া, আর কিচ্ছুটি লাগবে না’। আর হালফিলে তা বদলে হয়েছে ‘তিন তারিখ হয়ে গেল মাসের, একটু দেখবেন’। অন্যদিকে বাবানরাও দিব্যি শ্রদ্ধা-অশ্রদ্ধা ভুলে মুখ উঁচিয়ে ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে শিক্ষকের সামনে দিয়ে যেতে দ্বিধাবোধ করে না। জানেই তো, এ মাস্টারমশাই কিচ্ছুটি দেখবেন না।

পূর্ববর্তী নিবন্ধ
পরবর্তী নিবন্ধ
Uttarbanga Sambad
Uttarbanga Sambadhttps://uttarbangasambad.com/
Uttarbanga Sambad was started on 19 May 1980 in a small letterpress in Siliguri. Due to its huge popularity, in 1981 web offset press was installed. Computerized typesetting was introduced in the year 1985.

Share post:

Popular

More like this
Related

সরকারি চাকরি মানেই শান্তির জীবন নয়

মানসী কবিরাজ অ্যালবামের পাতা ওলটালেই দেখা যাবে  আমাদের প্রায় ...

কবিতা

১ অ-কৃতজ্ঞ সোমা দে সভ্যতার ভেতরে মাথা উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে আছে বর্বরতা শরীর থেকে...

সোনার সংসার, যুদ্ধের সংসার

অরিন্দম ঘোষ বাংলায় ‘সোনার-সংসার’ বলে একটা শব্দবন্ধ আছে। এই...

গুজরাট যখন বাংলাকে মনে করায়

দেবদূত ঘোষঠাকুর  সম্প্রতি গুজরাটের পশ্চিম উপকূল ধরে ঘুরে একটা...