- কৌশিক জোয়ারদার
আরুণি নামেতে শিষ্য ছিল একজন। বাঁধভাঙা জল আটকাতে আলের উপর শুয়ে পড়ে ঋষি ধৌম্যের জমির ফসল বাঁচিয়ে সে লাভ করেছিল গুরুর আশীর্বাদ ও জ্ঞান। সপ্রশ্ন ও সতর্ক বিদ্যাচর্চার একটি ইতিহাস সঙ্গে নিয়েই মূলত ব্রাহ্মণ্যবাদী আনুগত্যের গুরু-শিষ্য পরম্পরা মধ্যযুগ পেরিয়ে ভারতবর্ষের গ্রামে নগরে চতুষ্পাঠী শিক্ষাব্যবস্থার মধ্যে নিজেকে কিছুটা টিকিয়ে রেখছিল। আদুল গায়ে উপবীতধারী পণ্ডিতমশাই প্রখর গ্রীষ্মে হাতপাখা ফটাস ফটাস করে নাড়িয়ে ব্যাকরণ কল্প পুরাণের পাঠ দিচ্ছেন— আবছা জলছবির মতো শৈশবের এই স্মৃতি মনের ভিতরে এখনও উঁকি দেয়। অবশ্য আমি যা দেখেছি, প্রকৃতপক্ষে তা মৃত এক ব্যবস্থার অন্ত্যেষ্টি। ব্রিটিশ শাসনের দুশো বছরে পাশ্চাত্য শিক্ষাব্যবস্থার প্রসারের সঙ্গে সঙ্গে টুলো পণ্ডিতেরা অন্তর্হিত হলেন। ব্রিটিশরা আসার আগেই অবশ্য আরবি ও ফারসি ভাষার মাধ্যমে পাশ্চাত্য দর্শনের পাঠ নেবার সুযোগ এই ভারতেই ছিল। রামমোহন রায় গ্রিক দার্শনিকদের চেনেন ইসলামি শিক্ষাব্যবস্থার অন্দরমহলে প্রবেশ করেই। ভারতেরই অন্যতম সেই পরম্পরার কী গতি হল, এই পরিসরে তা আর আলোচনা করছি না। যাই হোক, শাস্ত্র যদি ক্ষেত্র, আর জ্ঞান যদি ফসল, তাহলে তার অধিকার আর ব্রাহ্মণের একার থাকল না। পুরুষেরও নয়। শিষ্যের দান-নির্ভরতার বাইরে সরকারের বেতনভোগী, জাতি ও লিঙ্গ নিরপেক্ষ শিক্ষক সম্প্রদায়ের আবির্ভাব ঘটল। তথাপি ভারতবর্ষে গুরুর প্রতি শিষ্যের চিরাচরিত ভক্তির পরম্পরা ম্লান হতে আরও কিছুটা সময় নেবে। গুরুরেব পরং ব্রহ্ম তস্মৈ শ্রীগুরবে নমঃ।
অতঃপর বাঁধ ভেঙে জলে ভেসে গেছে ইতিহাসের অনেক ভালো ও মন্দ। মালদার গঙ্গাভাঙনে নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে ঘরবাড়ি, ইস্কুল। শুকিয়ে গেছে মহানন্দার জল। উত্তরবাংলায় কালজানি নদীর তীরে একটি মহাবিদ্যালয়ে শিক্ষকতার বৃত্তি নিয়ে যোগ দিলাম আমি। দশক যদি ব্যক্তি-পরিচয়ের চিহ্ন হয়, আমি তাহলে নব্বুইয়ের সৃষ্টি। আমার লিখনযাত্রা শুরু হয়েছে যদিও ঢের আগে, এই দশকই সংকেত দেয়— লেখার হাত থেকে আমার নিস্তার নেই। তেমনই, শিক্ষার বিভিন্ন পর্যায় পেরিয়ে উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতকোত্তর পাঠ নিতে নিতে এই দশকেই নির্দিষ্ট হয়ে যায়, আমি শিক্ষক হব। এই প্রথম শিক্ষকদের বন্ধু হিসেবে পেলাম। পাঠদানের উঁচু ডায়াস থেকে নেমে এসে চায়ের দোকান পর্যন্ত পিঠে হাত দিয়ে যেতে যেতে তাঁরা আমাকে শিক্ষা দিলেন গুরু-শিষ্যের নতুন পরম্পরার, চিরাচরিত ঐতিহ্যের সঙ্গে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্নতা না-ঘটিয়েই। চাকরির অনিশ্চয়তা তখনও কিঞ্চিৎ ছিল। বিকল্পের খোঁজ করতে করতে কিছুটা বিলম্ব হলেও স্বচ্ছতর নিয়োগ-ব্যবস্থার প্রবর্তনে কাঙ্ক্ষিত ব্রত পালনের সুযোগ পাওয়া গেল অবশেষে। গত শতাব্দীর শেষ বিকেলে বন্ধুরা বললে— ভয় পাস নে, মেরে তো ফেলবে না।
বন্ধুরা রহস্যময়, উহাদের আশ্বাসেই লুকিয়ে থাকে বিপদ-সংকেত। বিপুলা সে কলেজের কতটুকুই বা জানতুম। ভর্তি না-নিলে যাবে কোথায়— এই নীতির ধারাবাহিক প্রয়োগে ছাত্র-শিক্ষক অনুপাতের নিদারুণ অসামঞ্জস্যের অসহায় দর্শক হিসেবে একটি বৃহৎ সভাকক্ষের তুমুল কলরোলের মধ্যে গিয়ে পড়লেন নবীন অধ্যাপক। করিডরের জানলা সমূহে দাঁড়িয়ে যারা ভিতরে উঁকিঝুঁকি মারছে, শুনলাম এই ক্লাসেরই ছাত্র তারা, ঘরে জায়গা না-হওয়ায় বাইরে উপচে পড়েছে। নাহ, ভয় পাব না। মেরে তো ফেলবে না— এই মন্ত্র জপতে জপতে কী করে মিনিট চল্লিশ সেদিন কাটিয়েছিলাম, আজ আর মনে নেই। কাজে যোগ দেবার প্রথম দিন আমাকে ছাত্র মনে করে ইউনিয়নের নেতা ঘরে দেখা করতে বলেছিল। দ্বিতীয়দিন পাঠদানকালে একদল দামাল খোকা দড়াম করে দরজা ঠেলে কক্ষে ঢুকে পড়ায় আমার মৃদু প্রতিবাদে অপমানিত হয়ে তাহারা আবার ডেকে পাঠিয়েছিল হুমকির সুরে। যাইনি অবশ্য, অগ্রজ সহকর্মীরা পরিস্থিতি সামাল দিয়েছিলেন। দিন কয়েকের মধ্যেই শীতের পাহাড়ি নদীর মতো সেই বিপুল জনস্রোত শুকিয়ে গেল। শুনলাম, পাস কোর্সের ক্লাসে এমনই হয়। একদা দুষ্টু ছেলেরা ভারী ও ভঙ্গুর বস্তুসমূহ নিয়ে ছোড়াছুড়ি খেলতে গিয়ে শিক্ষকদের বসবার ঘরের দেওয়াল ঘড়িটি ভেঙে ফেলে। সবক’টি রাজনৈতিক দলেরই ছাত্র সংগঠন শক্তিশালী হওয়ায় এই ঘরে নাকি প্রায়ই একটু-আধটু ঝড়জল হয়ে থাকে। বিশেষ করে প্রাণভয়ে অধ্যক্ষ মহাশয় যেদিন শিক্ষকদের মাঝে আত্মগোপন করেন। তাছাড়া শিক্ষাবর্ষ শুরু হবার কিছুদিনের মধ্যেই ‘টিউশন’ নামক সমান্তরাল শিক্ষাব্যবস্থা চালু হয়ে যেত। এইসব নানান কারণে, কিছুদিন পর থেকেই অনার্স-ক্লাসের গুটিকয় ছাত্রছাত্রী ছাড়া আর কেউ বেড়াতে আসত না। ব্যতিক্রম ছিল ছাত্র সংসদের নির্বাচন ও পরীক্ষার দিনগুলি। মজা করে বলা হত, মহাবিদ্যালয় আসলে কতকগুলি ‘শন’-এর সমষ্টি। এডমিশন, ইলেকশন ও এগজামিনেশন। ব্র্যাকেটে টিউশন। বঙ্গের অনেক কলেজেরই এই চিত্র আজ কতটা বদলেছে বলতে পারব না। কয়েক বছর পর, আমার শিক্ষকদেরই সহকর্মী হয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভাষক পদে যোগ দিলাম।
সেই ছাত্রেরাই এখানে সন্ধে অবধি ক্লাস করছে, নোট লিখে এনে ঘরের বাইরে প্রবেশের অনুমতির অপেক্ষায়। দেখি তারাই গ্রন্থাগারে যাবার পথে শিক্ষকদের দেখে সাইকেল থেকে নেমে দাঁড়াচ্ছে, শ্রদ্ধা ও বিনয়ে অবনত। কী রহস্য এই পালটে যাওয়া চিত্রপটের— স্থানমাহাত্ম্য নাকি উত্তরপত্রের মূল্যায়নকারীকে চোখের সামনে দেখা। পাঠ দিয়েছেন যিনি, খাতা দেখবেন তিনি। না, কেবলই তা নয়। সম্পর্ক শুধু দুটো মানুষই গড়ে তোলেন না, পরিকাঠামোর ঘটকালি সেখানে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। ছাত্র-শিক্ষকের কাম্য অনুপাত, পর্যাপ্ত শ্রেণিকক্ষ ও শ্রেণিকক্ষের বাইরে সমান্তরাল শিক্ষাব্যবস্থার অনুপস্থিতি, সমৃদ্ধ গ্রন্থাগার, সুশৃঙ্খল পরীক্ষাব্যবস্থা ইত্যাদি বিদ্যাচর্চার গুণগত মান বৃদ্ধির পাশাপাশি সুস্থ গুরু-শিষ্য সম্পর্কও গড়ে তোলে। প্রাথমিক থেকে উচ্চতম, সকল বিদ্যায়তনের ক্ষেত্রেই এটা প্রযোজ্য। এমন পরিবেশেই শিক্ষককে প্রশ্নে ও তর্কে যাচিয়ে নিতে দায়বদ্ধ হয় ছাত্র, জাগ্রত থাকে শিক্ষকেরও ছাত্রসত্তা। ভারতবর্ষে সামাজিক ও অর্থনৈতিক বিকাশের অসাম্য অতুলনীয়। এমন দেশে একটিই সূচকে নগর শহর ও গ্রামের শিক্ষার মান নির্দিষ্ট করার প্রকল্পটি বাস্তবসম্মত নয়। এমনকি একই চশমায় সমগ্র রাজ্যের শিক্ষার ছবিটাও ধরা যাবে না। তাই দক্ষিণে যখন মধ্যমেধার মহাযজ্ঞ নিয়ে হাহাকার করছেন বিদ্যাজীবীরা, উত্তরের উচ্চতম বিদ্যায়তনে আমরা দেখছি প্রথম প্রজন্মের ছাত্রছাত্রীরা অমসৃণ পাথর হয়ে ঢুকে উজ্জ্বল রত্ন হয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে। এমনকি মহাবিদ্যালয়ের মহাপ্রলয়ের ঘূর্ণাবর্ত থেকে উঠে এসে প্রাচীন দুয়েকজন কৃতী ছাত্রছাত্রী প্রকাশ করে যায় মুগ্ধতা ও কৃতজ্ঞতা। কিন্তু আমাদের অকিঞ্চিৎকর শিক্ষকজীবন আরও একটু সার্থকতা লাভ করার আগেই আশঙ্কায় ধূসর হয়ে উঠছে চারিপাশ। সম্পর্কের মাঝে এসে দাঁড়াচ্ছে অশ্রদ্ধা ও অবিশ্বাস। গোড়া কেটে আগায় জল ঢেলে কতদিনই বা বাঁচানো যাবে গাছটিকে। অমঙ্গলের যে চিহ্নগুলি দৃশ্যমান, তাতে আশঙ্কা হয় সারা দেশেই সরকারি শিক্ষাব্যবস্থা না লাটে ওঠে। স্ব-অর্থায়িত শিক্ষাব্যবস্থাতেও, ছাত্র ও শিক্ষকের শারীরিক উপস্থিতিতে সম্পর্কগুলো তবু মূর্ত। কিন্তু ক্রমবর্ধমান ইউটিউব-শিক্ষক ও টেক স্যাভি ছাত্রের নব্যভূবনে গুরু-শিষ্য সম্পর্কের কী গতি হবে— তা আমি অনুমান করতে ভয় পাই। মূর্ত প্রকৃতি থেকে তো বটেই, প্রযুক্তির অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহার মানুষকে তার নিজের থেকেই বিচ্ছিন্ন করে দিচ্ছে। আন্তর্জাতিক হতে হতে যত দ্রুততায় আন্তর্জালিয়াতির কৃষ্ণগহ্বর আমাদের গ্রাস করছে, তা শুধু শিক্ষার নয়, সমগ্র সভ্যতারই সংকট।