- কৃষ্ণ শর্বরী দাশগুপ্ত
লিফটের জন্যে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে অধৈর্য লাগছিল। হঠাৎ দরজা হাট হয়ে খুলে গেল। পরিচিত দম্পতি কলকলিয়ে উঠলেন, ‘আসুন না, জায়গা হয়ে যাবে।’ তা তো হবে, কিন্তু সহযাত্রীদের দিকে চোখ পড়তে একটু দ্বিধায় পড়ি। প্রতিবেশী অমায়িক হেসে বলেন, ‘আরে ওরা তো চেনে আপনাকে, কিচ্ছু করবে না।’ খানিকটা চক্ষুলজ্জা আর খানিকটা তাড়ার জন্যে অগত্যা ঢুকে পড়ি। চেনাশোনা বিলক্ষণ আছে, তবু কাঠ হয়ে দাঁড়াই। হঠাৎ কাঁধে কেউ ‘হাত’ রাখে টের পাই। আমি তখন কাঠ থেকে পাথর। লিফটটা কি আজ আস্তে চলছে? এদিকে সঙ্গী দুজন ভারী স্নেহাতুর, ‘ও-মা, দেখেছেন, ঠিক কেমন চিনেছে আপনাকে! বলেছিলাম না?’ কচি ছেলে হাট্টিমাটিম আবৃত্তি করার পর বাপ-মা যেমন আহ্লাদে গলে পড়েন, অনেকটা সেইরকম। এবার কানে ভিজে ভিজে নরম কিছুর ছোঁয়া আর প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ঘনিষ্ঠতার প্রমাণ দিতে প্রভুর প্রবল উচ্ছ্বাসের মধ্যে আমার একটি গাল সাদরে চেটে দেন আমার চারপেয়ে প্রতিবেশী।
তা প্রতিবেশী বৈকি! ফ্ল্যাটবাড়িতে আমাদের ডাইনে-বাঁয়ে, ওপরে-নীচে তাঁরা আমাদের সঙ্গেই বসবাস করে আসছেন যখন। কখনও বাড়ির বাসিন্দাদের চেয়েও এঁরা সংখ্যায় ভারী। কেউ বিশালকায় হৃষ্টপুষ্ট, তো কেউ ছোটখাটো মিষ্টি, কেউ হিলহিলে মেদহীন তো কেউ আটপৌরে মাঝারি। গৃহকর্তা বা কর্ত্রী এঁদের আদরের নামে ডেকে থাকেন। স্নেহের প্রাবল্যে এমনকি নিজেদের পদবিটি পর্যন্ত দিয়ে দেন। ক্বচিৎ প্রয়োজনে সারমেয়সংকুল কোনও বাড়িতে গিয়ে ভুলেও যদি সে নামের জায়গায় তাঁদের গোত্রনাম উচ্চারণ করে ফেলেন, তাতে পোষ্যঅন্তঃপ্রাণ গৃহস্থ কিন্তু মর্মাহত হবেন। কুকুর না বলে বরং ও, ওর, ওকে– জাতীয় সর্বনাম ব্যবহার করা এই জমানায় সভ্যতর। আপনার যদি বিশ-পঁচিশ বছর আগে রাতের শহরে হাঁটার অভিজ্ঞতা থেকে থাকে, তবে নিশ্চয়ই মুচকি হাসছেন, মনে পড়ছে সেইসব কালু-ভুলু নামের পাড়াতুতো নেড়ি নেতাদের, নাইট ডিউটি করে ফিরলে যারা সামনে পিছনে পাহারা দিয়ে আপনাকে বাড়ির দরজায় পৌঁছে দিয়েছে দিনের পর দিন। মাঝরাতে ছিঁচকে চোর জলের পাইপ বেয়ে উঠলে চিল্লিয়ে পাড়া মাথায় করে গৃহস্থকে সজাগ করেছে এরাই। রীতিমতো রেজিমেন্টেড এই বাহিনী নিজেদের মধ্যে এলাকা ভাগ করে নিত। অন্যের এলাকায় বহিরাগতদের হিরোগিরি করতে যাওয়ার ফল ভালো হত না।
জানি, ঠোঁট উলটে বলবেন, আরে সেই পাড়াও কি আর আছে, যেখানে অন্ধকার বারান্দায় আগুনের বিন্দু দেখা গেলে পাশের বাড়ির রায়জেঠু একনজরে তার উচ্চতা মেপে নিতে পারতেন, আর পরের দিন অফিস যাবার পথে বাবার কানে খবর পৌঁছে যেত, ‘তোমার মেজো ছেলেটি বোধহয় একটু বিড়িটিড়ি ফুঁকতে শুরু করেছে হে, নজর রেখো।’ তিন ছেলের বাবা অবাক হয়ে জানতে চান, ‘মেজোই যে, কী করে বুঝলেন?’ রায়জেঠুর ঝোলা গোঁফ আত্মপ্রসাদে কাঁপে, ‘আরে বাপু, জন্মাতে দেখলাম, পাড়ার ছেলে, কে কতখানি লম্বা, জানব না?’ এখন রাতের দিকে কেউ মত্ত হয়ে গাড়ি চালাচ্ছেন কি না দেখার জন্যে যখন পুলিশ গন্ধমেশিন (ব্রেথালাইজার) নিয়ে এসে নিঃশ্বাস পরীক্ষা করে, তখন এইসব গতজন্মের প্রতিবেশী আত্মজনদের কথা মনে পড়ে, পাড়ার ছেলের ছিটেফোঁটা বেচাল বুঝতে যাঁদের কোনও পরীক্ষানিরীক্ষার দরকার হত না।
ছেলেপুলে অন্যায় করলে তাঁরা যে শুধু বাড়ির বড়দের কাছে নালিশ ঠুকেই খালাস ছিলেন, ভাবলে কিন্তু ভুল হবে। দায়িত্বশীল অভিভাবকের মতো বকুনি, কি চড়-থাপ্পড়টাও দিতেন মাঝেমাঝে। সেদিনের সেই ছবি অবশ্য এখন কল্পনায় আনতেও সাহস হয় না। তিরস্কৃত লজ্জায় মাথা হেঁট করে দাঁড়িয়ে আছে শাস্তিদাতার সামনে, মুখ খোলা দূরে থাকে, তোলা পর্যন্ত চূড়ান্ত অসৌজন্য বলে বিবেচিত হত। এক্ষেত্রে দোষীর নিজের কেউ হয়তো দৃশ্যপটেই নেই, থাকলেও ছেলের সমর্থনে একটি কথাও তিনি বলবেন না। এবং কিশোর মনে এভাবেই গাঁথা হয়ে যাবে পারস্পরিক শ্রদ্ধা, মূল্যবোধের ভিত। ইভেন্ট ম্যানেজার, কেটারারহীন সেই সাদাকালো দিনগুলোতে বাড়িতে বিয়ে লাগলে প্রতিবেশীরাই যেমন কোমরে গামছা বেঁধে পরিবেশন করে দিত, তেমনি পারিবারিক ঝগড়া বিবাদ মেটাতে, পরিজনহীন অসুস্থ মানুষের জন্যে হাসপাতালের অপেক্ষা-ঘরে মশার কামড় খেয়ে বিনিদ্র রাত কাটাতেও লোকের অভাব হত না।
লোকলজ্জা শব্দটা এখন আর তত কানে আসে না। বাড়িতে বড়রা বলতেন, এমন কিছু কোরো না যার জন্যে পাড়াপ্রতিবেশীর কাছে মুখ দেখাতে না-পারি। পাড়ায় এই মুখ দেখানোটা ছিল প্রাত্যহিকতার অঙ্গ। সদর দরজার বাইরে অনেক বাড়িতেই থাকত কমবেশি প্রশস্ত একটি রোয়াক বা রক। সেখানে পাড়ার চাকুরে, ব্যবসায়ী, ডাক্তার, মাস্টারমশাই থেকে ছোট দোকানদার, বৃদ্ধ পুরোহিতেরও হাজিরা ছিল বাঁধা। খাপ পঞ্চায়েত কি সালিশি সভার নাম তখনও শোনা যায়নি, ক্লাস নাইনের বুকুনের জ্যামিতির এক্সট্রা থেকে তরুণবাবুর বাড়িওলা ভাড়াটে কাজিয়া, সবকিছুরই সমাধান অনায়াসে করে ফেলার এলেম ছিল এসব রকের আড্ডার। প্রতিবেশীদের কাছে সুখদুঃখের কথা বলে বুক হালকা করার রেওয়াজ ছিল। আজকের মতো হঠাৎ দরজা খুলে আত্মঘাতী মানুষের পাশে সুইসাইড নোট দেখে হতভম্ব পাড়ার লোকের ‘কই কিছু তো বুঝতে পারিনি এতদিন’ — বলাটা এমন জলভাত হয়ে যায়নি। প্রত্যেকটি মানুষকে ঘিরে তখনও দেবতার জ্যোতির্বলয়ের মতো ব্যক্তিগত ‘স্পেস’ বা পরিসরের ধারণা গড়ে ওঠেনি, যে দুর্ভেদ্য বলয়ের মধ্যে নাক গলানোই আজ মানবাধিকার লঙ্ঘনের তুল্য।
প্রতিবেশীর এই নাক গলানো ব্যাপারটা অবশ্য সবসময়ে খুব যে ইতিবাচক ছিল, তাও নয়। পরনিন্দা পরচর্চার ধিকিধিকি আগুন আর নিন্দুকের কানভাঙানি লেলিহান হয়ে কত যে সংসার খাক করে দিয়েছে তার ইয়ত্তা নেই। গায়েপড়া পড়শি কীভাবে গৃহস্বামীকে মোটে তোয়াক্কাই না-করে তাঁর বৈঠকখানাটিকে ‘আপন’ করে নেন, আর চা-বিস্কুট-শরবত সহযোগে কাগজ পড়া, রেডিও শোনার ধাক্কায় খোদ কর্তাকেই উৎখাত করেন, শিবরাম চক্রবর্তী তার সরস বর্ণনা দিয়ে গেছেন (তাও তো তিনি টেলিভিশনের প্রথম যুগে গণদর্শনের বহরটা আর দেখে যেতে পারেননি)। ভৌগোলিক অস্তিত্বে টিঁকে থাকলেও বাঙালির পাড়া কালচারের সেই গ্ল্যামার গেছে ঘুলিয়ে। তবে নদীর এক কুল ভাঙলে যেমন অন্যটি জেগে ওঠে, তেমনি শহর মফসসলের নতুন কাঠামোতেও জন্ম নিয়েছে এক নতুনতর প্রতিবেশ। ছোট-বড় পায়রার খোপওয়ালা ফ্ল্যাটবাড়ি বা আবাসনে সম্মেলক উৎসব পার্বণের ভাবনা যেন সাবেক সেই ‘পাড়া’রই প্রতিচ্ছবি। বছর কয়েক আগে অতিমারির আবহে এই নবীন পাড়াগুলি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়ে রোগগ্রস্ত, সন্ত্রস্ত মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছে।
আমরা যেসব পাড়ায় বড় হয়ে উঠেছি তার গোষ্ঠীচেতনাটি ছিল স্বতোৎসারিত। ব্যবহারিক জীবনে অত্যন্ত সফল এবং ব্যস্ত মানুষটিরও সেখানে ‘ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানো’তে ক্লান্তি ছিল না। আধুনিক প্রতিবেশে কিন্তু তেমন উৎসাহী মানুষ কম যাঁরা স্বেচ্ছায় সকলের প্রয়োজনে ঝাঁপিয়ে পড়বেন। নিজের ব্যক্তিগত পারিবারিক বৃত্তে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে থাকা এইসব আত্মকেন্দ্রিক প্রতিবেশীকে যূথবদ্ধ করে এক ছাতার তলায় আনতে আবার এমন কারও সাংগঠনিক প্রচেষ্টা লাগে যিনি সেই জাদুঘরে চলে যাওয়া পুরোনো পাড়া কালচারের আঁচটুকু অন্তত পেয়েছেন। বদলে যাওয়া সমাজ এমন বিরল প্রজাতির মানুষগুলিকেও আঘাত করে বসে। আবাসনের কিশোরী মেয়েটি যখন বাড়ির স্বল্প পোশাকে বাইরের লোকের সামনে বেরিয়ে আসে, কোনও বর্ষীয়ান মানুষ তাঁর বাল্যকালে দেখা পাড়ার কাকা-জ্যাঠাদের দায়িত্ববোধ থেকে তাকে সচেতন করতে গিয়ে উলটে অপমানিত হন। কন্যার বাবা-মা নিজেদের মেয়েকে আড়াল করতে প্রবীণ মানুষটিকে আদালতে তুলে, কাগজে ‘যৌন হেনস্তার’ বাঁধা লবজ ব্যবহার করে যথাসাধ্য কালি ছেটাবার বন্দোবস্ত করেন। ফ্ল্যাটবাড়ির দরজা বন্ধ করলেই পরিবারগুলি এখন এক একখানি দ্বীপ। আজকের ছুটন্ত প্রজন্ম, যারা নিজেদের আত্মীয়পরিজনের থেকে কার্যত বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে, ‘তুতো’ ভাই-বোনেদের চিনতে যাদের ‘ফ্যামিলি ট্রি’র খোঁজ করতে হয়, তাদের নিজেদের স্বার্থেই কিন্তু এই প্রতিবেশের চারাগাছটিকে রোদ-জল দিয়ে বাঁচিয়ে রাখা দরকার। লোক কমতে কমতে দ্বীপগুলিতে সবাই যেদিন রবিনসন ক্রুশোর মতো একেবারে একা হয়ে পড়ব সেদিন যেন ফোন করে অন্তত এমন একজনকেও পাই যিনি বন্ধ দরজাটি খুলে সাহায্যের হাতটা বাড়িয়ে দেবেন।