মঙ্গলবার, ১৮ মার্চ, ২০২৫

কোচবিহারের পরেই যে রাসযাত্রা আসবে

শেষ আপডেট:

  • পূর্বা সেনগুপ্ত

বৃন্দাবনে শ্রীরাধার সঙ্গে কালাচাঁদের মান-অভিমানের পালা চলছে। রাধিকাকে তাঁর সখীগণ  বলছেন, হে সখী, হে কিশোরী তোর হৃদয়ে যদি গোকুলচাঁদের ভালোবাসা প্রকাশিত না হয় তবে সেই হৃদয় তো আঁধার সদৃশ। তাঁরা বলছেন,

‘যদি কিশোরী কালাচাঁদের, গোকুলচাঁদের উদয় ঘুচল হৃদে দুঃখ কে নাশিবে আর, কৃষ্ণ বই আঁধার থাকবি রাধে।’ সেই কিশোর রাই িজউ বিগ্রহের কথাই আজ আমাদের আলোচ্য বিষয়। তিনি আজও স্বমহিমায় অধিষ্ঠিত আছেন পূর্ব মেদিনীপুরের পটাশপুর ব্লকে পঁচেটগড় রাজবাড়িতে। মেদিনীপুর জেলাকে আমরা বাংলার বিপ্লবী আন্দোলনের এক উল্লেখযোগ্য স্থান বলে চিহ্নিত করি। কিন্তু এই জেলার ইতিহাস তার থেকেও বেশি কিছু। বঙ্গ সংস্কৃতির ধারকবাহক রূপে একই সঙ্গে সমুদ্র ও নদীর মোহনায় অবস্থিত এই ভূখণ্ড ধর্মীয় ইতিহাসেও  উল্লেখযোগ্য দৃষ্টান্তের অধিকারী হয়েছে। বিশেষ করে ওডিশার সঙ্গে ধর্মীয় ভাবাবেগের সংযোগ আমাদের চমৎকৃত করে। আমরা নারায়ণগড় আর ময়নাগড়ের ইতিহাস আলোচনা করেছি। আজ আমরা পঁচেটগড় রাজবাড়ির   কথা আলোচনা করব।

বাংলার ভ্রমণপিপাসুদের কাছে দিঘা একটি বিশেষ স্থান, দিঘার খুব কাছেই এই পঁচেটগড় রাজবাড়ি। শোনা যায় মোগল দরবার থেকে একই সঙ্গে দুটি জমিদারি সনদ পেয়েছিলেন এই বংশ। আর এই বংশের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন কালা মুরাই বা মুরারীমোহন চৌধুরী দাস মহাপাত্র। এই পরিবার দুটি গৃহদেবতাকে একত্রে ধারণ করে এসেছে। একজন পঞ্চেশ্বর শিব, অন্য দেবতা হলেন কিশোর রাই িজউ। দুটি মন্দির নির্মিত হয়েছিল দুটি কালে, দুটি ধর্মীয় ও সামাজিক পরিপ্রেক্ষিতে। দুই প্রেক্ষিতে নির্মিত হলেও দুই গৃহদেবতাই পূর্ব মেদিনীপুর অঞ্চলে বিখ্যাত ও জাগ্রত দেবতা রূপে মান্যতা পেয়ে আসছেন। প্রথমে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলেন পঞ্চেশ্বর শিব, এই শিব মন্দির পূর্ব মেদিনীপুরে সর্বাধিক জাগ্রত শিব রূপে আরাধিত।

এই পঞ্চেশ্বর শিবের নামেই স্থানটির নাম হয়েছে পঁচেটগড়। আর কিশোর রায় িজউয়ের রাস উত্সব খুবই বিখ্যাত। বলা হয়, কোচবিহার রাজবাড়ির মদনমোহন মন্দিরের রাস উৎসব যেমন আড়ম্বরে প্রথম স্থান অধিকার করে, তেমনই পঁচেটগড় রাজবাড়ির রাস দ্বিতীয় স্থান। এমন রাসমঞ্চ আমি কোনওদিন দেখিনি। রাসমঞ্চ সাধারণত গোলাকার হয়, এটি কিন্তু ডপেন থিয়েটারের মঞ্চ সদৃশ। মহিষাদল রাজবাড়ির রথের মেলা দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল। সেই স্মৃতির খাতিরেই পঁচেটগড় রাজবাড়ির রাস দেখার গভীর ইচ্ছা নিয়ে দুই দেবতার ইতিহাস বর্ণনায় অগ্রসর হলাম।

সাল ১৬৭৯-এর কথা। দিল্লির মসনদে তখন মোগল সম্রাট ঔরঙ্গজেব আসীন। এই সময়  উড়িষ্যার  পুরীর একেবারে কাছে আটঘরা নামে এক জায়গায় বসবাস করতেন মুরারীমোহন দাস মহাপাত্র। তিনি মোগল দরবারে বিশেষ পারদর্শিতা অর্জন করেছিলেন। তাঁর কাজে খুশি হয়ে ঔরঙ্গজেব তাঁকে পটাশপুর পরগনাটি প্রদান করেন। যখন মোগল দরবার থেকে জমিদারির সনদটি পাওয়া গেল তখন মুরারীমোহন পুরী অঞ্চলের আটঘরা ছেড়ে বর্তমান  পঁচেটগড়ের কাছে খার নামে একটি গ্রামে এসে বসবাস শুরু করেন এবং জমিদারির কাজ গোছাতে থাকেন।  খারের  চারদিকের অঞ্চলটি ছিল ঝোপজঙ্গলে পরিপূর্ণ। মুরারীমোহনের অনেক গৃহপালিত গোরু–ছাগল ইত্যাদি ছিল। কিছুদিন ধরে হঠাৎ সকলে লক্ষ করলেন, গোরুগুলি মাঠে চরতে যায়, কিছু গোরু সময়মতো ফিরে আসে না। কোথায় যায় তারা? আর ঘুরেফিরে সবক’টি গাভিই বেশ কিছুক্ষণের জন্য কোথায় যেন চলে যায়।  এই বিষয়টি স্পষ্ট হতেই খোঁজ শুরু হল। আর সেই খোঁজই এক আশ্চর্য ঘটনার সম্মুখে এনে দিল সকলকে। দেখা গেল গাভির একাংশ গোধূলির আলো ফুটলেই প্রতিদিন জঙ্গলের ধারে একটি ঢিপির উপরে উঠে যায়। আর সেই ঢিপির উপরে গেলে তাদের বাঁট থেকে আপনাআপনি দুগ্ধক্ষরণ হতে থাকে।

কী আছে সেই ঢিপির মধ্যে? সকলেই কৌতূহলী হয়ে ওঠেন। শুরু হয় সেই ঢিপির মাটি সরানো কাজ। মাটি খুঁড়তেই শাবলের আঘাত লাগে শক্ত কিছুতে। ভালো করে মাটি সরিয়ে দেখা মেলে এক স্বয়ম্ভু শিবলিঙ্গের। কিন্তু শাবলের আঘাতে সেই শিবলিঙ্গের মাথার কাছটি একটু ভেঙে গিয়েছে। লিঙ্গটিকে বের করে আনতে চেয়েও তার শেষ যখন পাওয়া সম্ভব হল না তখন সকলে বুঝতে পারল বিরল স্বয়ম্ভু শিবলিঙ্গের অধিষ্ঠান এখানে। দাস মহাপাত্র পরিবার সেই  শাবলের আঘাতে খুঁতযুক্ত শিবের পুজো করবেন কি না, তাঁর নতুন করে অভিষেক ক্রিয়া করা যাবে কি না? – এই সব পরামর্শপ্রদানের জন্য বেনারস ও বৃন্দাবন থেকে পণ্ডিতদের ডেকে নিয়ে এলেন। তাঁরা পরিস্থিতি দেখে জানালেন, স্বয়ম্ভু শিব আঘাতলাভ করে কমজোরি হয়েছেন তাঁকে পূর্বের মতো শক্তিতে পূর্ণ করতে হলে এই স্বয়ম্ভু শিবলিঙ্গের চারপাশে আরও চারটি শিবলিঙ্গ প্রতিষ্ঠা করতে হবে। কিন্তু এই চারটি শিবলিঙ্গ হবে চার রকমের। বেনারস ও গয়া থেকে নিয়ে আসা হল শিবলিঙ্গ। বেনারস শিবের স্থান, কিন্তু গয়া থেকে এল কেন বোঝা গেল না। এই চারটি শিবলিঙ্গের একটির অবয়ব একেবারে উজ্জয়িনীর মহাকালের মতো। পিঙ্গল শিব তিনি। আমাদের মনে হয় উজ্জয়িনীর সঙ্গেও এ ব্যাপারে যোগাযোগ স্থাপিত হয়েছিল। যাই হোক নতুন চারটি শিবলিঙ্গ ও তার সঙ্গে স্বয়ম্ভু শিবলিঙ্গ মিলে পাঁচটি শিব এই পরিবারে প্রতিষ্ঠা করা হলে এই পাঁচ শিবের নাম হল পঞ্চেশ্বর। মূল স্বয়ম্ভু, আর চারজন তাঁকে শক্তি জোগান দেন। সব মিলিয়ে পঞ্চেশ্বর। এই শিবমন্দির ঠিক ওলটানো ঘণ্টার মতো চূড়াবিশিষ্ট। যেটা বাংলার অন্য মন্দিরের স্থাপত্যে দেখতে পাওয়া যায় না। তবে মন্দিরের প্রবেশপথ দাক্ষিণাত্য স্থাপত্যকে স্মরণ করিয়ে দেয়। পঞ্চেশ্বর শিবলিঙ্গ প্রাপ্তির পর দাস মহাপাত্র পরিবার এই শিবলিঙ্গকেই গৃহদেবতা রূপে পুজো করতে থাকে। মন্দিরের পাশে খনন করা হয় মহাদেব কুণ্ড। আর মুরারীমোহন যে স্থানে শিবলিঙ্গ পাওয়া গিয়েছিল সেখানেই বসতবাটী বা রাজবাড়িটি গড়ে তুলতে শুরু করেন।  ধীরে ধীরে এই স্থানে তাঁদের মহল তৈরি হতে থাকে, আর এই বংশ এগোতে থাকে। পঞ্চেশ্বর শিবের মন্দিরের অভ্যন্তরে কেবল শিবলিঙ্গের দেখা পাওয়া যায় না। এর সঙ্গে খুব প্রাচীন স্থাপত্যের কিছু নিদর্শনও চোখে পড়ে। শিব প্রকটিত হলেন অলৌকিকতাকে নিয়ে কিন্তু এই সব স্থাপত্য এল কোথা থেকে? তবে কি এই স্বয়ম্ভু শিবের উপর কোনও সময় বিরাট মন্দির ছিল? সেই মন্দিরের  ধ্বংসাবশেষ আমাদের চোখে পড়ে?  না কি সেই ঢিপির তলায় কেবল দেবতা ছিলেন না, এই দেবতাকে যাঁরা প্রথমে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন তাঁদের গঠিত জনপথেরও কিছু নিদর্শন পাওয়া গিয়েছিল। যাকে আমরা তেমনভাবে কোনও গুরুত্বপ্রদান করিনি? এই অঞ্চলের প্রাচীন ইতিহাসের সঙ্গে সাযুজ্য রেখে পঁচেটগড় রাজবাটী কখনও আলোচিত হয়নি। কিন্তু পঞ্চেশ্বর শিবের আলয় কেন গড় রূপে চিহ্নিত হল তার সদুত্তর এখনও পাওয়া একেবারে দুষ্কর। কেবল প্রশ্ন রেখে যাওয়া ব্যতীত আর কিছু করার উপায় থাকে না।

 ইতিহাস বলে  মুরারীমোহনের চার পুত্র ছিল, এই চার পুত্রের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন জ্যেষ্ঠ ব্রজেন্দ্রনন্দন। তাঁর পাণ্ডিত্যের জন্য পুরীর মহারাজ তাঁকে ডেকে নেন। শাস্ত্রজ্ঞ ব্রজেন্দ্রনন্দনকে তিনি পুরী জগন্নাথ মন্দিরের সেবার কার্যে নিযুক্ত করেন। মন্দিরের নানা কর্মচারীদের পরিচালনের কাজ দক্ষতার সঙ্গে পালন করছিলেন ব্রজেন্দ্রনন্দন। তার জন্য রাজাও তাঁর উপর খুশি হয়ে উঠলেন। একজন বাঙালি এসে পুরী মন্দিরে নীলাচলস্থ প্রভু জগন্নাথের সেবায় খ্যাতি অর্জন করবে – এ ওড়িয়া পান্ডাদের সহ্য হল না। তারা সকলে একজোট হয়ে এই ব্রজেন্দ্রনন্দনের বিরুদ্ধে খুনের মামলা দায়ের করল। এই নিদারুণ খবর খার গ্রামে পৌঁছালে মুরারীমোহন পুত্রকে ছাড়িয়ে আনার জন্য ছুটলেন পুরী। ব্রজেন্দ্রমোহন জ্যেষ্ঠ পুত্র, তিনি না থাকলে সম্পত্তিজনিত মিতাক্ষরা আইনের ফলে পরিবার অসুবিধের সম্মুখীন হবে। তাই সকলের উত্কণ্ঠার শেষ নেই। পুরীর আগে সাক্ষীগোপালে দাঁড়িয়েই মুরারীমোহন মানত করলেন, যদি তিনি বড় পুত্রকে ছাড়িয়ে আনতে সক্ষম হন তবে তিনি জগন্নাথদেবকে এক কেজি সোনার মুকুট দেবেন এবং এক লাখ টাকার অখণ্ড ভোজের আয়োজন করবেন। তার মধ্যে থাকবে প্রভুর প্রিয় নারকেলের নাড়ু। ব্রজেন্দ্রনন্দন ছাড়া পেলেন। সেই সময় থেকেই ধীরে ধীরে পরিবারের মনোজগতে পরিবর্তনের সূচনা হচ্ছিল। সেটি প্রকাশ পেল আরেকটি ঐতিহাসিক ঘটনায়। মহাপ্রভু শ্রীচৈতন্যদেব এই অঞ্চল দিয়ে পুরীর উদ্দেশ্যে যাওয়ার সময় সমস্ত অঞ্চলটি তাঁর প্রভাবে প্রভাবিত হয়ে যায় এবং বৈষ্ণবধর্ম গ্রহণ করে। এই সময় দাস মহাপাত্র পরিবারও বৈষ্ণব ধর্মগ্রহণ করে এবং পঞ্চেশ্বর শিবের সঙ্গে এই পরিবারে আসন গ্রহণ করেন ‘কিশোর রাই িজউ’। তৈরি হয় কিশোর রাই জিউয়ের মন্দির। রাধাকৃষ্ণের যুগল বিগ্রহ এমন এক মন্দিরে স্থাপিত যে মন্দিরটি দেখলে মনে হবে বাংলায় নয়, উড়িষ্যায় দাঁড়িয়ে আছি। কলিঙ্গ আর্ট অনুসরণ করে তিনটি ধাপে সজ্জিত এই মন্দির। মেদিনীপুরের অনেক মন্দিরই এই পদ্ধতিকে অনুসরণ করে রথদেউল আকৃতিতে নির্মিত। শ্রীমন্দির, নাটমন্দির ও নাচমন্দির– তিনভাগে বিভক্ত। কিশোর রাই জিউ প্রতিষ্ঠিত হলেও প্রতিদিন শিবের পুজো সম্পন্ন করা হয় ধুমধাম করে। যদিও কিশোর রাই িজউ-ই হলেন প্রধান। জগন্নাথদেবের মন্দিরে যেমন প্রহরে প্রহরে ভোগ নিবেদন করা হয়, ঠিক তেমনভাবে এই মন্দিরেও ভোগ নিবেদিত হয়। প্রকৃতপক্ষে পুরীর জগন্নাথ মন্দিরের প্রভাব এই পরিবারের উপর প্রগাঢ়ভাবে জাল বিছিয়েছে বহুকাল ধরে। শোনা যায় মুরারীমোহন নিজে সংগীতজ্ঞ ছিলেন। তাঁর আরেক পুত্র যাদবেন্দ্রমোহন ছিলেন নাম করা সেতারবাদক। তিনি নাকি  একবার জগন্নাথ মন্দিরে প্রভু জগন্নাথকে নিজের বাজনা শুনিয়েছিলেন, সেদিন উপস্থিত সকলের মনে হয়েছিল স্বয়ং জগন্নাথ জাগ্রত হয়ে সেই বাজনা শুনছেন। মুরারীমোহন নাকি এই পরিবারের দত্তক পুত্র ছিলেন, কিন্তু কেন তাঁকে দত্তক নেওয়া হয়েছিল তা জানা যায়নি। তবে মোগল সম্রাটের কাছে সনদ আদায় করে রাজত্ব স্থাপনের পর মুরারীমোহন তাঁদের উপাধি, দাস মহাপাত্রের আগে  চৌধুরী লিখতে শুরু করেন। সেই থেকে এই বংশের পদবি হয় চৌধুরী দাস মহাপাত্র।

এই রাজবাড়িতে দুই দেবতা ছাড়াও আরও দুই দেবসত্তা পূজিত হন। একজন নারায়ণ অপরজন শীতলা দেবী। দেবী শীতলার মন্দিরটিই কেবল একেবারে বাংলার পঞ্চরত্ন মন্দির আকৃতির এবং অনেক পরবর্তীকালে গঠিত। কিন্তু নারায়ণের মূর্তি ও  মন্দিরে দক্ষিণ ভারতের ছাপ সুস্পষ্ট। এই মূর্তিলাভেরও একটি ইতিহাস আছে।

১৫৬৭-’৬৮ সালের কথা। এই সময় প্রবল পরাক্রমশালী কালাপাহাড়ের আবির্ভাব ঘটে। কালাপাহাড় এই অঞ্চলের মন্দিরগুলি ভাঙতে ভাঙতে উড়িষ্যার পুরী মন্দিরের দিকে অগ্রসর হচ্ছেন। পথে পড়ল দাঁতন ও পটাশপুর এলাকা। এই অঞ্চলের অনেক মন্দিরের বিগ্রহ ভঙ্গ করেন কালাপাহাড়।  মন্দিরও ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়।  অনেক মন্দিরের বিগ্রহকে পুকুরের জলের তলায় ডুবিয়ে বা অন্যত্র লুকিয়ে রাখা হয়।  শোনা যায় পুরীর জগন্নাথধামও পান্ডারা কালাপাহাড় যাতে দেখতে না পান তার জন্য বালু আর কাদা দিয়ে আচ্ছাদিত করে রেখেছিলেন। কালাপাহাড় তা দেখতে না পেয়ে অন্যত্র চলে যান। পুরীর মন্দির কালাপাহাড়ের ধ্বংসলীলা থেকে নিস্তার পায়। কালাপাহাড়ের অত্যাচার শেষ হয়েছে বহুযুগ আগে,  তখন প্রায়  ১৮৭০ খ্রিস্টাব্দ।  একদিন শ্রমিকের দল পুকুরের গভীরতা কাটতে গিয়ে একটি অপূর্ব কষ্টিপাথরের নারায়ণমূর্তি পান। তারা সঙ্গে সঙ্গে এই পরিবারের সদস্যদের জানান। সকলে গিয়ে সেই মূর্তি দেখে বিস্মিত। পুকুর থেকে উদ্ধার করা এই মূর্তি দাস মহাপাত্র পরিবার গৃহাঙ্গনে প্রতিষ্ঠা করেন। এই কালো মূর্তিটি নিটোল, জলের তলায় লুকিয়ে রাখার ফলে এতটুকু খুঁতগ্রস্ত হয়নি। শঙ্খ, চক্র, গদা, পদ্মধারী নারায়ণ সুন্দরভাবে প্রতীয়মান হন। বিগ্রহটি কিছুটা  তিরুপতি বালাজির মতো দেখতে বলা হলেও, এর সঙ্গে বালাজির থেকে পাল যুগের পূর্ববর্তী নারায়ণমূর্তির সাদৃশ্য অনেক বেশি। সোনায় আঁকা চোখ আর মুখের গড়ন অনেক বেশি। এই বিগ্রহও একই গৃহপ্রাঙ্গণে পূজিত হচ্ছেন বহুকাল ধরে। কিশোরীলাল িজউর মূল মন্দিরের গা লাগোয়া বাংলার আটচালা ঢঙের মাটির বাড়ি, খড়ের চালা। এই অংশতে সব রকমের পুজো হয় দোল, দুর্গোত্সব, জন্মাষ্টমী, রাস ছাড়া আর প্রতিটি বড় উত্সব এখানেই পালিত হয়। তবে এই পরিবারে মূর্তি গড়ে দেবী দুর্গার আরাধনা করা হয় না। এই পরিবারে দেবীর আরাধনা হয় পটে। এই পরিবারের প্রতিটি দেবদেবীর সেবার জন্য পৃথক পৃথক জলাশয় নির্দিষ্ট করা আছে।

 এই পরিবার যে দুর্গা সদৃশ রাজবাড়ি গড়ে তোলে সেখানে বহিঃশত্রুর হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য পরিখা বা স্থানীয় ভাষায় গড়খাই করা আছে। যদিও বর্তমানে এই পরিখা অনেক স্থানেই বুজে এসেছে।  রাজা হয়ে প্রজাদের শাসন করার জন্য দরবার বসাতেন রাজারা। এর জন্য ছিল রয়্যাল কোর্ট।  এছাড়াও এই পরিবারের জলসাঘরের ভূমিকা ঐতিহাসিক। শোনা যায় রবীন্দ্রনাথের সংগীত শিক্ষক যদুভট্ট এই রাজভবনে এসে দীর্ঘদিন বাস করেছিলেন। যদুভট্টের  অনুপ্রেরণাতেই ঋষি বঙ্কিমচন্দ্র বন্দেমাতরম রচনা করেন। দেশাত্মবোধ গঠনে এই রাজবাড়ির উল্লেখযোগ্য ভূমিকা ছিল। সঙ্গে আমরা হিন্দুস্থান ক্লাসিক্যাল মিউজিকেও এই পরিবারের অবদানের দেখা পাই। রাজবাড়ির গঠনটি এমন যেখানে একটি গেট দিয়ে প্রবেশ করে বিরাট উঠোনের চারপাশে দালান, সেখানে আমরা স্থায়ী স্টেজ দেখতে পাই। যেখানে বহু বড় বড় ঘরানার শিল্পীরা এসে সংগীত সম্মেলন করে যেতেন। সংগীতের আসর বসত। শোনা যায় শিল্পী কানাইলাল, ফকিরবক্স, আল্লারাখাও এসেছিলেন এই রাজবাড়িতে। প্রতি শনিবার এখানে গানবাজনার আসর বসত।  ঠিক এর সঙ্গেই গলি দিয়ে আরেকটি উঠোনে এসে পড়তে হয়, যেখানে মন্দিরগুলির অস্তিত্ব। চারপাশের দালানে ছিল কর্মচারীদের থাকবার জায়গা।

এই পরিবারের আঙিনায় অনেক মন্দিরের অস্তিত্ব থাকলেও  কিশোরীলাল জিউ-এর নামেই সব দেবোত্তর সম্পত্তি। এই মন্দির থেকেই সমস্ত মন্দিরের পুজো অনুষ্ঠান পরিচালিত হয়। এই দেবতার রাস উত্সবের বর্ণনা দিয়ে আমাদের আলোচনা শেষ করব।  গর্ভমন্দিরে বিগ্রহের আসনের কোনায় অধিষ্ঠিত কিশোরী রাই। কিন্তু তিনি ছাড়া আরও কিছু রাই কিশোরী ও কৃষ্ণমূর্তির দেখা মেলে।  রাস উত্সব পাঁচদিন ধরে হয়। প্রথম কয়েকদিন চারদিক যত কৃষ্ণ মন্দিরের বিগ্রহ আছে সকল মন্দিরের বিগ্রহ উপস্থিত হন। সকলকে নিয়ে নাচতে নাচতে কিশোর রাই জিউ চলেন রাসমঞ্চে। দুই দিকে সিঁড়ি দিয়ে উঠে সুন্দর মঞ্চ। লাগোয়া ঘর। সেখানে গিয়ে আবার ফিরে আসা। রাসের দিন কিন্তু সন্ধের পরে ফিরে আসেন না দেবতা, লীলা সাঙ্গ করে তাঁর ফিরতে রাত দুটো থেকে আড়াইটে লাগে। এইভাবে রাসে যেন জাগ্রত হয়ে ওঠেন পঁচেটগড় রাজপরিবারের গৃহদেবতা কিশোর রাই জিউ।

Uttarbanga Sambad
Uttarbanga Sambadhttps://uttarbangasambad.com/
Uttarbanga Sambad was started on 19 May 1980 in a small letterpress in Siliguri. Due to its huge popularity, in 1981 web offset press was installed. Computerized typesetting was introduced in the year 1985.

Share post:

Popular

More like this
Related

শ্রীরামকৃষ্ণের গৃহদেবতার কথা

পূর্বা সেনগুপ্ত   তখন বৈষ্ণবদের ভক্তির রসে আপ্লুত, তন্ত্রের আচারে...

দীপার পাত্র

জয়ন্ত দে             দ্যুতিমানকে দুশ্চরিত্র কোন শালা বলে। দ্যুতিমান ভগবান...

শাপলা

মনোনীতা চক্রবর্তী             আরও একটা জন্মদিনের দিকে এগোচ্ছে  স্বচ্ছতোয়া। আরও...

১ আনমনা   সুব্রতা ঘোষ রায়    বসন্ত এসেছিল পলাশের ডালে, আনমনা মেয়ে তার কোন ব‍্যথা...