মঙ্গলবার, ১৮ মার্চ, ২০২৫

বদলের দুই ঐতিহ্য

শেষ আপডেট:

রাধামাধব মণ্ডল

১.

জয়দেব কেন্দুলির বাউলমেলা

মকর সংক্রান্তির পুণ্যস্নানের মেলা হয় এখনও অজয় তীরের কেন্দুলিতে। তবে সে মেলার আকার বেড়েছে বহুগুণ। বারো বিঘার মেলা অজয় পেরিয়ে পশ্চিম বর্ধমানের কাঁকসার বিদবিহার গ্রাম পঞ্চায়েতের শিবপুর অজয় ঘাট পর্যন্ত ছড়িয়েছে। কেন্দুলির মেলাই বর্তমানে কবির নামে জয়দেব মেলা। কবি জয়দেবের জন্মের আগেও বীরভূমের অজয় তীরের কেন্দুলিতে হত মকর স্নানের মেলা। সে মেলা শেষ পৌষের স্নানের মেলা। প্রাচীন কেন্দুলির সে মেলা ছিল বাউল, ফকির, বৈরাগীদের মেলা। এখনকার মেলায় বাউলের চেয়ে কীর্তনের দলের ভিড় বেশি হয়।

আশপাশ গ্রামের হরিবাসর, সংকীর্তন সভার বায়নাপত্র ধরে জয়দেবের মেলায় আসেন বহু মানুষ।  সে কারণেই দিন-দিন জয়দেব কেন্দুলির মেলায় ভিড় বেড়েছে কীর্তন দলের। আখড়াধারীও বেড়েছে। কমেছেন বাউলরা। প্রাচীন মেলার নির্জনতা এখন নেই। তাই নিভৃত সাধনা ছেড়ে চলে গেছেন বাউল সাধকদের একটা শ্রেণি। এক কালের বাউলমেলায় এখন কীবোর্ডে বাজে একতারা। ভিখারিদের ভিড় বেড়েছে। পুরোনো কলাপটি, কাঠের পটি, লোহা পটি, জালের পটির সংখ্যাও কমেছে। মনিহারি, কাপড়চোপড়ের দোকান বেড়েছে আগের থেকে। গ্রামীণ লোকশিল্পীদের পসরা আগের মতো আর তেমন চোখে পড়ে না। রাত জেগে হয় না বাউলগানও। এখন মাইকিং হয়। বক্স বাজে। বৈষ্ণবদের মেলার সেই ধুলোট মচ্ছবও হয় না। কেবল চাকচিক্য আর কলেবরই বেড়েছে। আর বেড়েছে ভিড়।

আগের মতো কেন্দুলির আশপাশের গ্রামের মানুষজনরা মেলাফেরত অতিথিদের কিনে দেন না কলার কাঁদি। এখন মেলার আশ্রম যেন তিনদিনের বেড়াতে আসা। অবারিত ভিড়, ঠেলাঠেলি, ডিজের শব্দ আর আবর্জনার স্তূপ। জলহীন অজয়ের মরাস্রোতে ঠেলাঠেলি স্নানের জন্য এখনও পৌষ সংক্রান্তির দিন রাজ্যের বাইরের মানুষজনরা আসেন। কীসের আশায় এই ভিড় বলা কঠিন! তবুও বছর বছর বাড়ছে ভিড়ের জৌলুস!

শান্তিনিকেতন পৌষমেলা

কালের ইতিহাসে বোলপুরের শান্তিনিকেতনের পৌষমেলার প্রথম বছরটা ছিল ১৮৯৪ সালের ৭ পৌষ। তারপর দিন গেছে, বদলেছে মেলা। মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের মেলা এখন এলিটদের দখলে। মেলা ঘিরে বছর বছর নানান নির্দেশিকা জারি করে বিশ্বভারতী। বেশ কয়েক বছর মেলাও বন্ধ করে দেয়। নানা জটিলতা তৈরি হয় মেলাকে ঘিরে।

বাংলা সংস্কৃতি মঞ্চের সঙ্গে বীরভূম জেলা প্রশাসন মিলিতভাবে একাধিকবার বিকল্প পৌষমেলাও করল বোলপুরের ডাকবাংলো মাঠে।

তবে সে মেলায় ছিল না প্রাণ।

বিশ্বভারতীর নিজস্ব পূর্বপল্লির মাঠে, ৭ই পৌষের শান্তিনিকেতন মেলার টানই অন্য। বিকল্প মেলায় সেই প্রাণ নেই।

অতীতের শান্তিনিকেতন মেলা আর বিগত কয়েক বছরের শান্তিনিকেতন মেলার ভিন্নতা অনেকখানি। গ্রামীণ শিল্পীদের অংশগ্রহণ কমেছে। বেড়েছে কর্পোরেট ব্যবসায়ীদের দাপট। তাঁতিবাজার আসে না। বাঁশ-বেত শিল্পীরাও কম আসেন। বাউলদের বাইরে বর্তমানে বিভিন্ন শিল্পী মেলার মঞ্চে গান করেন। অতীতের মেলার বহুগুণ বেড়েছে বর্তমান মেলায় ভিড়। অনেকেই আসেন শান্তিনিকেতন দেখতে। বর্তমানে মেলাকে ঘিরে শান্তিনিকেতন, বোলপুরে লজ, রিসর্ট ব্যবসার রমরমা শুরু হয়েছে। মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথের মেলায় যেন বিশ্বভারতীর অংশগ্রহণ কমেছে।

Uttarbanga Sambad
Uttarbanga Sambadhttps://uttarbangasambad.com/
Uttarbanga Sambad was started on 19 May 1980 in a small letterpress in Siliguri. Due to its huge popularity, in 1981 web offset press was installed. Computerized typesetting was introduced in the year 1985.

Share post:

Popular

More like this
Related

শ্রীরামকৃষ্ণের গৃহদেবতার কথা

পূর্বা সেনগুপ্ত   তখন বৈষ্ণবদের ভক্তির রসে আপ্লুত, তন্ত্রের আচারে...

দীপার পাত্র

জয়ন্ত দে             দ্যুতিমানকে দুশ্চরিত্র কোন শালা বলে। দ্যুতিমান ভগবান...

শাপলা

মনোনীতা চক্রবর্তী             আরও একটা জন্মদিনের দিকে এগোচ্ছে  স্বচ্ছতোয়া। আরও...

১ আনমনা   সুব্রতা ঘোষ রায়    বসন্ত এসেছিল পলাশের ডালে, আনমনা মেয়ে তার কোন ব‍্যথা...