Thursday, January 23, 2025
Homeরংদার রোববারবিবিধশূন্য ডাকবাক্সে সুপারহিট চট্টগ্রামের চিঠি

শূন্য ডাকবাক্সে সুপারহিট চট্টগ্রামের চিঠি

  • শমিদীপ দত্ত ও অনিমেষ দত্ত

‘চিঠঠি আই হ্যায় আই হ্যায়, চিঠঠি আই হ্যায়..’ থেকে ‘তোমাকে না লেখা চিঠিটা ডাকবাক্সের এক কোণে…’ -এর যুগ পেরিয়ে ই-মেল, মেসেঞ্জার, হোয়াটসঅ্যাপের জমানা। চিঠির চল প্রায় অবলুপ্ত। শুধুই নস্টালজিয়া।

তবে ছবিটা হঠাৎ যেন বদলে গিয়েছে ইদানীং। বাঙালি আবার চিঠি লিখছে। তবে এ চিঠি লিখতে কাগজ, কলম, খাম কিংবা পোস্ট কার্ডের প্রয়োজন নেই। মুঠোফোন কাফি হ্যায়। সম্প্রতি সোশ্যাল মিডিয়ায় জনপ্রিয় হয়েছে একটি অ্যাপ ‘চিঠি ডট মি’। আর তাতেই মজেছে ১৮-৮০ সব বয়সের নেটনাগরিকরা। সব চিঠি পোস্ট করা হচ্ছে ফেসবুকে।

হঠাৎ কোথা থেকে এল এই চিঠি নামক অ্যাপ? কে-ই বা বানাল? সেটাও চমকে দেয়।

বাংলাদেশের এক তরুণ শৈশব অবস্থায় দেখেছিলেন, পরিবারের সকলে চিঠির মাধ্যমে একে অন্যের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন। তিনিও ভিড়ে যান দলে। অপরিণত হাতে ভাই, বোনকে চিঠি লেখা শুরু। তারপর পদ্মা দিয়ে অনেক জল গড়িয়েছে। সেই ছেলেটাই দেড় দশক পরে চিঠি ফিরিয়ে আনল অ্যাপের মাধ্যমে। শাজিদ হাসান। চট্টগ্রাম ইউনিভার্সিটি অফ ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড টেকনলজিতে মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ছাত্র। চিঠি ডট মি-এর জনক।

তাঁর কথায় পরে আসছি। আগে আমাদের দিকে তাকানো যাক।

বাঙালি অ্যাপে চিঠি লেখায় মজলেও বাস্তবে এই অভ্যাস প্রায় অবলুপ্ত। সেই হিসেবে ডাকঘরগুলোয় কাজ কমে যাওয়ার কথা। কিন্তু বাস্তবটা কি তাই? বাংলার দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর শিলিগুড়ির কথাই ধরা যাক। শহরের প্রত্যেকটি ডাকঘরের কর্মীরা একসুরে জানাচ্ছেন, ব্যক্তিগত চিঠি লেখার বিষয়টি অনেক কমে গিয়েছে। তাতে ডাকঘরের কাজ বিন্দুমাত্র কমেনি। ডাকঘর এখন মূলত সরকারি চিঠি আদানপ্রদানের মাধ্যম।

শিলিগুড়ি হেড পোস্ট অফিসের পোস্ট মাস্টার মনোজকুমার দাস বলেই দিলেন, আধার কার্ড, প্যান কার্ড, ড্রাইভিং লাইসেন্স, ভোটার কার্ড, এমনকি পাসপোর্টের ডেলিভারি চলছে ডাকঘরের মাধ্যমে। তবে ব্যক্তিগত চিঠি প্রায় উধাও।

 এখন ডিজিটাল যুগে পুনশ্চ, ইতি কিংবা শ্রীচরণেষু লেখার প্রয়োজন পড়ে না। ডাকবাক্সেও তেমন জমা পড়ে না পোস্ট কার্ড, ইনল্যান্ড, খাম। মনোজবাবুর হিসেব, মাসে ইনল্যান্ড বিক্রি হয় ২০০ থেকে ২৫০। পোস্ট কার্ড ১০০০। খাম ৪০০ থেকে ৫০০। এগুলো ব্যবহার করেন মূলত বয়স্করা। কেউ কেউ বাচ্চাদের চিঠি লেখানো অভ্যাস করান পোস্ট কার্ড, ইনল্যান্ড দিয়ে। কুড়ি বছর আগের হিসেব শুনবেন? ইনল্যান্ড বিক্রি হত মাসে ১০ হাজার, পোস্ট কার্ড ৫ থেকে ৬ হাজার। খাম ৪ থেকে ৫ হাজার।

লাল ডাকবাক্সের ছবি কেমন?

শিলিগুড়ির রাস্তায় বর্তমানে ২৮টি ডাকবাক্স রয়েছে। যার মধ্যে ১৯টি সচল। ১৫ বছর আগেও দিনে ৩০০-৩৫০ চিঠি সংগ্রহ করতেন সমাপ্তি ঘোষ। এখন সেই সংখ্যা গড়ে ৪০ থেকে ৪৫-এ এসে ঠেকেছে। সমাপ্তির কথায়, ‘শুধুমাত্র যখন পরীক্ষা সংক্রান্ত বিষয় থাকে, তখন দিনে ১৫০-২০০টা চিঠি সংগ্রহ করি।’

এমন বিষণ্ণতার মাঝে বাংলাদেশি তরুণের সৃষ্টি অন্য চটকের।

কয়েকবছর আগে ‘ব্যাটনেম’ (ব্যাটম্যান লোগো জেনারেটর) বানিয়ে অল্প বয়সে ভাইরাল হয়ে গিয়েছিলেন শাজিদ। সেই তিনি হঠাৎ বানিয়ে ফেলেন চিঠি। বর্তমানে যোগাযোগের একাধিক মাধ্যম থাকলেও শৈশবের সেই চিঠি লেখার অভ্যাস শাজিদের কাছে আজও রঙিন। ফোনে বললেন, ‘আমরা সোশ্যাল মিডিয়ায় যতই মেসেজ করি না কেন চিঠি লেখার ব্যাপারটাই অন্যরকম। একটু ভেবে মনের কথা লিখতে পারার মজাটাই  আলাদা।’

শাজিদ একদম শুরুতে ভাবেননি তাঁর বানানো অ্যাপ দু’পারের বাঙালির কাছে এতটা জনপ্রিয় হয়ে উঠবে। বললেন, ‘অ্যাপটা বানিয়ে কলেজের সিনিয়ার দুই দিদিকে পাঠিয়েছিলাম। ওঁদের খুব ভালো লাগে। তারপর আস্তে আস্তে কীভাবে যে এতটা ছড়িয়ে পড়ল, তা বুঝে ওঠা কঠিন।’

ব্যক্তিগত চিঠি থাকবেই বা কেমন করে। ডিজিটাল যুগে ব্যক্তি মানুষ আরও ব্যক্তিগত। ভাবনা, প্রেম, বিরহ, আনন্দ সহ যাবতীয় অনুভূতি এখন সেকেন্ডে ব্যক্ত করার জন্যে রয়েছে বহু মাধ্যম। আর সেখানেই হঠাৎ উঁকি দিয়েছে শাজিদের চিঠি।

তবে এই বেনামি মেসেজিং অ্যাপের ব্যাপারটা নতুন কিছু নয়। বেশ কয়েকবছর বছর ধরে হাশআপ, সারাহা কিংবা এনজিএলের মতো অ্যাপে একই পরিষেবা মিলছে। বাঙালিরাও সেই সমস্ত অ্যাপ ব্যবহার করেছেন। তা সত্ত্বেও চিঠির বিশেষত্ব আলাদা।

প্রথমত, নামে। চিঠি শব্দটির সঙ্গে বাঙালি যতটা একাত্ম বোধ করে, বাকি অ্যাপের নামের সঙ্গে তেমনটা নয়। দ্বিতীয়ত, টেমপ্লেট। চিঠি ডট মি-তে কাউকে বেনামে কিছু লিখলে যে টেমপ্লেটগুলিতে লেখা ভেসে ওঠে, সেগুলি বাস্তব চিঠির সঙ্গে সাযুজ্যপূর্ণ। একটি টেমপ্লেট রুল টানা খাতার মতো। টাইপ করলেও যেন মনে হবে হাতে লেখা। আরেকটি টেমপ্লেট আসল চিঠির সেই হলদেটে রংয়ের অনুভূতি দেয়। ফন্টও অনেকটা আপন। এতেই বাজিমাত করেছে ডিজিটাল চিঠি।

শাজিদ বাঙালি। তাই অ্যাপটি বাঙালিকেন্দ্রিক রাখতে চান। আগামীদিনে আপডেট করে নতুন থিম আনার পরিকল্পনা রয়েছে তাঁর। বলছিলেন, ‘ইদ, দুর্গাপুজোয় সময়োপযোগী থিম আনার ইচ্ছে রয়েছে। যাতে বাঙালি আরও বেশি করে কানেক্ট করতে পারে।’

কানেক্ট তো বাঙালি ডাকবাক্সে চিঠি ফেলে আসার মাধ্যমেও করত। সেই দিনগুলো তো আর নেই।

একদিকে ডাকবাক্সে চিঠির সংখ্যা তলানিতে, অন্যদিকে বাঙালি মজে ডিজিটাল চিঠিতে। আর সেখানেই বাজছে বিপদঘণ্টাও। চট্টগ্রামের চিঠি জনপ্রিয় হওয়ার কিছুদিন বাদেই নেটপাড়ায় সেই বিপদ নিয়ে লেখালেখি শুরু হয়ে গিয়েছে।

ঠিক কেমন বিপদ? কেউ লিখছেন এই ধরনের বেনামি মেসেজিং অ্যাপের রোজগারের মূল রাস্তা ব্যবহারকারীদের তথ্য এবং মেসেজিং প্যাটার্ন ব্ল্যাক মার্কেটে বিক্রি করা। আবার কেউ লিখছেন ব্যক্তিগত তথ্য চুরি হয়ে যাওয়ার আশঙ্কার কথা।

বিশেষজ্ঞরাও এই ধরনের অ্যাপের ব্যবহার নিয়ে খানিকটা সন্দিহান। বেঙ্গালুরুর আচার্য ইনস্টিটিউট অফ টেকনলজির মাস্টার্স অফ কম্পিউটার অ্যাপ্লিকেশনের বিভাগীয় প্রধান তথা সাইবার সিকিউরিটি এক্সপার্ট রত্নকীর্তি রায় দুটি বিষয়ের দিকে ইঙ্গিত করেছেন। একটি টেকনিকাল। দ্বিতীয়টি সামাজিক।

সামাজিক বিপদের দিকটি সম্পর্কে তিনি বলেছেন, ‘আমার এক মহিলা ফেসবুক ফ্রেন্ড অ্যাপটি ব্যবহার করছিলেন। তাঁর কাছে অজস্র বেনামি চিঠি আসে। বেশিরভাগ মেসেজে তাঁর শরীর নিয়ে কদর্য ভাষার ব্যবহার লক্ষ করা যায়। এর ফলে ওই মহিলা মানসিকভাবে বিধ্বস্ত হয়ে পড়েন।’

চিঠিতে যেমন প্রেম নিবেদন চলছে, মনের কথা চালাচালি হচ্ছে, তেমনই আবার বিশেষ করে মহিলাদের উদ্দেশে উড়ে আসছে কটূক্তি। প্রেরক বেনামি হওয়ায় তাকে চিহ্নিত করা সম্ভব হচ্ছে না।

টেকনিকাল বিষয়টিও সমানভাবে উদ্বেগজনক বলে মনে করছেন রত্নকীর্তি। তাঁর বক্তব্য, ‘আমরা গুগল কিংবা মেটার কাছেও নিজেদের ব্যক্তিগত তথ্য দিয়ে রেখেছি। তবে এরা অনেক বড় কোম্পানি। মালিককে আমরা চিহ্নিত করতে পারি। কিছু উনিশ-বিশ হলে তারা জবাবদিহি করার ব্যাপারে দায়বদ্ধ। কিন্তু ব্যক্তিগত উদ্যোগে বানানো অ্যাপের অ্যাকাউন্টেবিলিটি নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়। ব্ল্যাকমেলিংয়ের ভয়ও উড়িয়ে দেওয়া যায় না।’

যাঁরা চিঠি ব্যবহার করছেন, তাঁরা যেন এর যাবতীয় টার্মস অ্যান্ড কন্ডিশন পড়ে তারপর ব্যবহার করেন, এমনটাই উপদেশ দিয়েছেন সাইবার সিকিউরিটি এক্সপার্টরা।

অ্যাপটিকে ঘিরে সংশয়, বিতর্ক চলবে। তবে এ মুহূর্তে গোপন ক্রাশকে মনের কথা ব্যক্ত করা কিংবা কাউকে শাপশাপান্ত করার মাধ্যম চিঠি। কে লিখছে, নাম জানার উপায় নেই। আর এটাই এখন বাংলার ট্রেন্ড।

একসময় প্রেমিকাকে লেখা চিঠিটা গোপনে হাত বদলে সঠিক ঠিকানায় পৌঁছে যেত ঠিক। কখনও আবার অজান্তেই রানাররা হয়ে উঠতেন প্রেমের বার্তাবাহক। তবে সুকান্তের কলম আর হেমন্তের কণ্ঠ আর নেই। চিঠি এখন আঙুলের স্পর্শে। শুধু রাস্তায় রাস্তায় এখনও কিছু লাল ডাকবাক্স পড়ে আছে।

Uttarbanga Sambad
Uttarbanga Sambadhttps://uttarbangasambad.com/
Uttarbanga Sambad was started on 19 May 1980 in a small letterpress in Siliguri. Due to its huge popularity, in 1981 web offset press was installed. Computerized typesetting was introduced in the year 1985.
RELATED ARTICLES
- Advertisment -
- Advertisment -spot_img

LATEST POSTS

S Jaishankar | ‘ভারতের সঙ্গে সম্পর্ককে অগ্রাধিকার দিচ্ছে ট্রাম্প প্রশাসন’, মার্কিন সফর নিয়ে বললেন...

0
উত্তরবঙ্গ সংবাদ ডিজিটাল ডেস্ক: মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের (Donald Trump) শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানে ভারতের প্রতিনিধি হয়ে উপস্থিত ছিলেন বিদেশমন্ত্রী এস জয়শংকর (S Jaishankar)। ওয়াশিংটন সফর...

NJP Station | প্রজাতন্ত্র দিবসের আগে নিরাপত্তার চাদরে মুড়ে ফেলা হচ্ছে নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশনকে

0
শিলিগুড়ি: সামনেই ২৬ জানুয়ারি। নাশকতা রুখতে নিউ জলপাইগুড়ি রেল স্টেশনে বাড়ছে নিরাপত্তা। আর এই গুরুত্বপূর্ণ রেল স্টেশনে নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করতে রেলের পদস্ত কর্তাদের নিয়ে...

Siliguri Hospital | শিলিগুড়ি হাসপাতালের স্যালাইনে মিলল ছত্রাক! ফের প্রশ্নের মুখে স্বাস্থ্য দপ্তর

0
শিলিগুড়িঃ মেদিনীপুরের পর এবার শিলিগুড়ি। সংস্থা বদলে ফেলা হলেও রাজ্যে সরকারি চিকিৎসায় ব্যবহৃত স্যালাইনের মান নিয়ে বিতর্ক যেন থামছে না। প্রসূতি মৃত্যুর ঘটনায় নিম্নমানের...

Ind-Eng T20 | ইডেনে বিধ্বংসী ইনিংস অভিষেকের, ইংল্যান্ডকে ৭ উইকেটে হারিয়ে টি২০ তে যাত্রা...

0
উত্তরবঙ্গ সংবাদ ডিজিটাল ডেস্কঃ ৭ ওভার বাকি থাকতেই ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে জয়ের জন্য প্রয়োজনীয় রান তুলে নিল ভারত। ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে পাঁচটি টি-টোয়েন্টি খেলবে ভারত। ইডেন...

Jalpaiguri | খাদ্যমেলায় পিঠের পাশে শিদল, ছ্যাকা

0
অনসূয়া চৌধুরী, জলপাইগুড়ি: একদিনের খাদ্যমেলার আয়োজন করেছিল কলেজ কর্তৃপক্ষ। মঙ্গলবার সেখানে একদিকে দেখা মিলল বিভিন্ন চাইনিজ খাবার, বাঙালির প্রিয় পিঠেপুলির। আরেকদিকে রাজবংশী সম্প্রদায়ের নানা...

Most Popular