- সৈয়দ তানভীর নাসরীন
রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের কথায় উদ্বুদ্ধ হয়ে আমার দিদিমার দিদিমা, তহুরন বিবি সেই যে গত শতকের গোড়ার দিকে আমাদের বাড়িতেই একটি স্কুল খুলেছিলেন, তারপর ১০০ বছরের বেশি সময় ধরে আমাদের পরিবারের মহিলারা শিক্ষার সঙ্গেই যুক্ত। সেই অর্থে দেখতে গেলে আমি পঞ্চম প্রজন্ম, যে শিক্ষকতার পেশাকে বেছে নিয়েছি। তাহলে এই ১০০ বছরের মধ্যে শেষ ২৫ বছরে কতটা পরিবর্তন ঘটল এই শিক্ষাজগতে? সেটা কি শুধুই সোশ্যাল মিডিয়ার ঝাঁকুনি? অর্থাৎ, ফেসবুক থেকে টুইটার হয়ে ইনস্টাগ্রাম রিল বানানোর ‘ট্রেন্ড’ কতটা বদলে দিল শিক্ষার পরিবেশকে?
ছোটবেলায় মাকে যখন স্কুলে যেতে দেখতাম, তখন আমার ব্যাংক অফিসারের সহধর্মিণী মা যে পাটভাঙা শাড়ি পরে সরকারি স্কুলের দিকে হেঁটে যেতেন, আমি কি আজ, সেইভাবে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে যেতে পারি? কেন আমি নিজে আর মা-দিদিমার মতো পাটভাঙা শাড়ি পরে বিশ্ববিদ্যালয়ে যাই না, সেই আত্মানুসন্ধান করতে গিয়ে খেয়াল করলাম সিকি শতাব্দীর একটু আগে যখন আমি প্রথম বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরি পেয়েছিলাম, তখন যত অনায়াসে বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের গোলাপ বাগ ক্যাম্পাসে ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে নিয়ে গোপালদার ফুচকার দোকানে দাঁড়িয়ে ‘ফাউ’ চাইতে পারতাম, আজকাল আর সেভাবে পারি না কেন? সোশ্যাল মিডিয়া নাকি বয়স, কোনটা আমাকে ‘বল দেখে খেলতে’ শেখাল?
এটা সত্যি, মনমোহন সিং ভারতের অর্থনীতিকে ‘উদারনীতি’র এক্সপ্রেসওয়েতে তুলে দেওয়ার পরও, গত শতকের শেষ দশকে আমি যখন প্রেসিডেন্সি কলেজে পড়ছি, তখনও সামনে যাঁরা ‘রোল মডেল’, সেই ‘আইকনিক’ শিক্ষকরা, অমলকুমার মুখোপাধ্যায়, রজতকান্ত রায় কিংবা প্রশান্ত রায়— এমন ‘কপিবুক’ স্টাইলে চলতেন, যে আমাদের মস্তিষ্কে তো বটেই, হৃদয়েও ওই ছবিটাই আটকে আছে। পরবর্তীকালে যখন অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতকোত্তর পড়তে গেলাম এবং জানতে পারলাম সন্ধেবেলায় শিক্ষকের বাড়িতে গেলে আড্ডার সঙ্গে ‘অনেক কিছু’ জমে, তখন সত্যি কথা বলতে গেলে কি, একটু ধাক্কাই লেগেছিল। কিন্তু এখন জানি অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রেই এই ধরনের ‘সান্ধ্য আসর’ আর ব্যতিক্রম নয়।
আমাকে যদি কেউ রক্ষণশীল ভাবেন, তাহলে খুব বিনয়ের সঙ্গে আমি স্বীকার করে নেব, আমি একটু ‘সেকেলে’-ই বটে। শরৎচন্দ্রের ‘নভেল’-এ আটকে না থাকলেও, সাদা ধুতি পাঞ্জাবিতে সৌম্যকান্তি অধ্যাপক কিংবা সাদা তাঁতের শাড়িতে অধ্যাপিকা হেঁটে আসছেন, দেখতে পেলেই প্রেমে ব্যস্ত শিক্ষার্থী যুগল আড়ালে সরে যাচ্ছে কিংবা শশব্যস্ত কেউ সিগারেট লুকোচ্ছে, এটা দেখতেই স্বচ্ছন্দ ছিলাম। সময়ের ব্যবধানে ছাত্র কিংবা ছাত্রী অধ্যাপকের কাঁধে হাত রেখে গল্প করছে কিংবা শিক্ষিকার হাতে-পিঠে ট্যাটু বা নেইল আর্ট পড়ুয়াকেও উদ্বুদ্ধ করছে সেইভাবেই শরীরকে রাঙাতে, ভাবলে পরে বুঝি সত্যিই এলন মাস্কের সময়ে ঢুকে পড়েছি। কিছুদিন বাদে তো চাঁদে আবাসিক কলোনি হবে আর মঙ্গলে বছরের শেষে ছুটি কাটাতে যাওয়াটাই ‘ট্রেন্ড’ হবে!
আসলে শরৎচন্দ্র থেকে বাংলা সিনেমায় উত্তমকুমার পর্যন্ত দেখতে অভ্যস্ত বাঙালির কাছে শিক্ষকের একটা ‘মডেল’ ছিল। ঠিক যেমন, আমি এবং আমার মতো মধ্যবিত্ত পরিবারে বড় হয়ে ওঠা সন্তানেরা জানত বাড়ির দেওয়ালে যে ছবিটা ঝুলবে, বিয়ের পর বাবা-মায়ের আগ্রা কিংবা নৈনিতাল গিয়ে তোলা ভীরু ভীরু চেহারার ‘ফ্রেম’। আমার শিক্ষিকা মা ছোটবেলায় দুই কন্যাকে নৈনিতালে বেড়াতে নিয়ে গিয়ে ঘোড়ায় চড়ার আগে যে সালোয়ার কামিজ পরেছিলেন, তা নিয়েই কত মনোজগতে আলোড়ন পড়ে গিয়েছিল। আজকে অনায়াসে ফ্লোরিডা কিংবা পাটায়ার সমুদ্রসৈকত থেকে শিক্ষক-শিক্ষিকাদের যে ছবি সোশ্যাল মিডিয়ায় ‘আপলোড’ করতে দেখি, তাতে নিশ্চিত হয়ে যাই কোনও রাজ কাপুরের আর ঋষি কাপুর এবং তাঁর শিক্ষিকা সিমি গারেওয়ালকে নিয়ে ‘মেরা নাম জোকার’-এর মতো সিনেমা বানানোর দরকারই পড়বে না। সময় এতটাই বদলে গিয়েছে, যে শরীরের ট্যাটু বা আরও অনেক কিছু দেখিয়ে ‘পুকার’-এ অমিতাভ বচ্চন আর জিনাত আমানের সমুদ্রের জল মাখানো গান দিয়ে রিল বানাতেও কোনও কুণ্ঠা বোধ নেই!
তাহলে আমিও কি ‘সনাতনী’? চারপাশে সব কিছু ভেঙে পড়ছে বলে হা-হুতাশ করছি? আমি জানি কলেজের লাইব্রেরি থেকে বই নিয়ে দল বেঁধে জেরক্স করিয়ে বাঁধিয়ে রাখার দিন চলে গিয়েছে। এখন হোয়াটসঅ্যাপের পৃথিবীতে সবাই ‘গ্রুপ’-এ নোট চালাচালি করে। কিন্তু তাতে কি শিক্ষার মান বাড়ল? দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন দেশে এবং এই দেশেরও বিভিন্ন রাজ্যে শিক্ষা সংক্রান্ত কাজে ঘোরার জন্যই বুঝতে পারি, শুধু তো আমাদের জীবনচর্চায় পরিবর্তন আসেনি, শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণও চূড়ান্ত এবং সেটা সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের বা স্কুলের পাশাপাশি বেসরকারি স্কুল বা বিশ্ববিদ্যালয় গজিয়ে ওঠার কারণেই হয়েছে। অর্থাৎ, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে যে পড়ুয়া ভর্তি হয়, সে তার ‘সিমেস্টার’-এর খরচ জানে বলে প্রতিটি ‘লেকচার’ বা ক্লাসের শেষে হিসেব কষে নেয়, যে তার ত্রৈমাসিক বা ষাণ্মাসিক খরচ উঠল তো! নাকি, যে ক্লাসটা করলাম, সেটা ‘ফালতু’ বা নেহাতই সময়ের অপচয়? আবার উলটোদিকে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে যে পড়ুয়া আসছে, তার যেহেতু চাকরি বা পেশাগত জীবনে প্রবেশের জন্য আরও কিছু জায়গায় ‘ফ্যালো কড়ি, মাখো তেল’-এর নীতিতে চলতে হয়, সে-ও ভাবে এই যে, প্রায় বিনা খরচে সরকারি সিস্টেমের মধ্যে দিয়ে যা পাচ্ছি, তার কি আদৌ কোনও ‘দাম’ আছে? শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণ দুই প্রান্তে এমন সংশয় এবং ধোঁয়াশা তৈরি করেছে, যে আর কেউ শিক্ষা-‘দান’ শব্দটি ব্যবহার করে না। বরং সবাই জানে আর অনেক কিছুর মতো এটাও একটা ‘সার্ভিস’ বা ‘পরিষেবা’, যার গায়ে ট্যাগ লাগানো আছে, ‘কড়ি দিয়ে কিনলাম’।
আমাদের পরিবারের ১০০ বছরের একটু বেশি শিক্ষার সঙ্গে জড়িয়ে থাকার ইতিহাসে যেমন আমরা জেনেছি মানচিত্র বদলে যায়, রাজনীতির অভিঘাতে সামাজিক সম্পর্কে সংশয় তৈরি হয়, তেমনই বুঝি মূল্যবোধও বদলায়। সিকি শতাব্দী আগে যে আমি ছিলাম ‘আধুনিক’, আজ সেই আমিই কি একটু ‘সেকেলে’, ‘রক্ষণশীল’?