বুধবার, ১৯ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫

অপমৃত্যু যেন না হয়

শেষ আপডেট:

  • শৌভিক রায় 

স্কুল ফেরত মদনমোহন মন্দিরে ঢুকেই পূতনাকে দেখে ভয়ে চোখ বন্ধ। কিংবা বিরাট রাসচক্রের নীচে দাঁড়িয়ে ক্রমশ অবাক হয়ে শুধু ভাবা, আমি এত ছোট কেন! সার্কাসের তাঁবুর সামনে হস্তীদর্শনই বা বাদ থাকে কেন! কখনও আবার সারাদিন ধরে গুনে চলা ক’টা গোরুর গাড়ি এল মেলা দেখতে!সেই সব জানা দিনগুলি কবে যেন বদলে গেল! নিয়ম তো এটাই। এক ধারা যাবে। আসবে নতুন ধারা। সুর বদলাবে। তাল বদলাবে। তবু রয়ে যাবে কিছু আবহমানতা।

কোচবিহারের বিখ্যাত রাসমেলার কথা বলছি। ধারা তার বদলে গেছে কবেই। অতীতের এক ছোট্ট গ্রামীণ মেলা ডালপালা মেলে নিজের চেহারা বদলে ফেলেছে সেই কবে! একই কথা, হলদিবাড়ির হুজুরের মেলার ক্ষেত্রেও। কিছু সুর এক থাকলেও বদল তারও।

রাসমেলার কথায় আগে আসি। রাজানুগ্রহে শুরু হওয়া এই মেলার উদ্যোক্তা মন্দিরের ট্রাস্টি বোর্ড আর কোচবিহার পুরসভা। হাজার তিনেকের বেশি ছোট ছোট যে দোকান বসে মেলার মাঠে, তাদের দেখভালের দায়িত্ব পুরসভার। এমজেএন স্টেডিয়ামের ভেতর দিন পনেরো ধরে চলা সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের ব্যবস্থাপকও তারা। অন্যদিকে, মদনমোহনবাড়ির ভেতরে যাত্রাপালা থেকে শুরু করে ভাওয়াইয়া গান ইত্যাদির দায়িত্বে থাকে ট্রাস্টি বোর্ড। অতীতে শুধু মন্দিরকে কেন্দ্র করেই মেলা আবর্তিত হত। আর আজ? জানা না থাকলে মন্দিরকে খুঁজে পাওয়াই মুশকিল। যাঁর জন্য এই বিপুল আয়োজন, সেই মদনমোহন জিউয়ের দর্শন মেলাও কষ্টকর।

আসলে রাসমেলাতেও কর্পোরেট সংস্কৃতির ছোঁয়া। পুরোনো দিনের সেই সহজ সরল গ্রামীণ ভাবটাই উধাও। বিহারের কিশনগঞ্জ, পূর্ণিয়া এলাকা থেকে টমটম বিক্রেতারা এলেও সেই ব্যবসা আর নেই। নস্টালজিয়ায় ভুগে এখনও অনেকে টমটম কিনলেও নতুন প্রজন্মকে সে টানছে না। তারা বরং মেলার অস্থায়ী ট্যাটু সেন্টার বা মোবাইলের নতুন মডেল দেখাচ্ছে যে স্টল, আগ্রহী তাতেই।

ভেটাগুড়ি বা বাবুরহাটের জিলিপির চাইতে তাদের কাছে অনেক বেশি লোভনীয় কেএফসির চিকেন ললিপপ বা ডোমিনোজের পিৎজা। ক্রেতাদের চাহিদা বুঝে এইসব মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিও মেলায় হাজির ঝকঝকে স্মার্ট লুক নিয়ে। এনফিল্ড হান্টার ৩০০ যদি মেলায় প্রদর্শিত হয়, তবে কি আর চোখ ফেরে তরুণ সূত্রধরদের মতো গ্রাম্য মিস্ত্রিদের কাঠের তৈরি হাতে টানা বেখাপ্পা ট্রাক বা বাসের দিকে? বেশি তো নয়, তিন-চার দশক আগেও তো ওইসব জিনিসের চাহিদা ছিল তুঙ্গে! আজ মেলায় আসা মানে সময় আর ব্যবসা দুটোরই ক্ষতি। কিন্তু তবু না এসে থাকা যায় না। তাঁদের কাছে রাসমেলা একটা নেশা। স্বয়ং মদনমোহন জিউ ধরিয়ে দিয়েছেন সেটি। বালুরঘাটের হিলির শঙ্খ ব্যবসায়ী শচীন মোহন্ত ও তাঁর স্ত্রী চায়নাও এই দলে।

হুজুরের মেলার চিত্রও কিন্তু অনেকটা এক। সত্যি বলতে, ছোটবেলায় সেভাবে হুজুরের মেলার কথা আমরা জানতাম না। কিন্তু এখন? উত্তরের প্রায় সব  জেলা থেকে দলে দলে মানুষ ছুটছেন সেখানে। জ্যামে-জটে নাজেহাল হলেও ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করে রয়েছেন একবার মাজার দর্শনের জন্য। কিছুদিন আগেও যে মেলা ছিল নিতান্তই গ্রামীণ, খেটেখাওয়া নিম্নবর্গের মানুষজনের, সেখানে আজ ভিড় সকলের। সেই ভিড়ে যেমন নিতান্ত কিশোর রয়েছে, তেমনি রয়েছেন প্রাজ্ঞ গবেষকও। আর বিরাট এই ভিড় দেখে বিপণনকারীরা পিছিয়ে থাকেননি। ফলে হুজুরের মেলায়ও আধুনিকতার স্পর্শ। কিন্তু সেখানেও রয়েছেন গোসানিমারির মন্টু চক্রবর্তীর মতো ইউসুফভাইরা।

মন্টুবাবু মদনমোহন মন্দিরে আগত পুণ্যার্থীদের কপালে তিলক কেটে দেন। উপার্জন তার মুখ্য উদ্দেশ্য নয়। বরং নতুন লোক আর ইষ্টদেবতাই জীবন। ইউসুফও তেমন। হুজুর সাহেবের মেলায়ও দর্শনার্থীদের গায়ে ময়ূরের পালক দিয়ে আশীর্বাদ দেন তিনি। কেউ হয়তো খুশি হয়ে দশ-বিশ টাকা দেয়। অধিকাংশই গা বাঁচিয়ে চলে যায়। কিন্তু তাতে কী! হুজুর সাহেবের মেলা মানেই তো বিশ্বদর্শন।

এসব দেখে কখনও মনে হয়, কোনও ধারা বদল হয়নি। কিন্তু সেটা সঠিক নয়। বিচ্ছিন্ন কিছু উদাহরণ মেলার ধারা বদলকে লুকিয়ে রাখতে পারে না। রাস বা হুজুরের মেলা আজ আর শুধুমাত্র মেলা নয়। বরং মেলাকে কেন্দ্র করে এক বিরাট জনসংযোগের মাধ্যম। আর তার পরিপূর্ণ ফায়দা তুলছেন রাজনৈতিক কর্তাব্যক্তি থেকে প্রত্যেকেই। পিছিয়ে নেই সরকারি, বেসরকারি সংস্থাগুলিও। মেলার হাত ধরে প্রত্যেকেই ঝাঁপিয়ে পড়েছে নিজস্ব প্রচারে। পাশাপাশি এইসব মেলার এতটাই প্রভাব যে, উত্তরের বিভিন্ন জনপদে এই জাতীয় প্রচুর মেলা আয়োজিত হচ্ছে। আগে রাস ও কালচিনির কালীপুজোর মেলা ছাড়া আর কোনও মেলা খবরের শিরোনামে আসত না। কিন্তু এখন তাদের সংখ্যা প্রচুর। কয়েক বছর পর কোচবিহারের টাকাগাছের মেলা যদি হুজুরের মেলার মতো বিরাট আকার নেয়, বিস্মিত হব না। ধারা বদল তো এখানেও।

রাস বা হুজুরের মেলা বহুদিন আগেই শুধুমাত্র একটি ধর্মীয় গোষ্ঠীর সীমানা ছাড়িয়ে বৃহত্তর উৎসবে পরিণত। সেটা না হলে, দুই মেলাতেই ভারতের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা ব্যবসায়ীদের দেখা যেত না। বর্তমান পরিস্থিতিতে কী হবে জানি না, তবে বাংলাদেশ থেকে এই দুই মেলাতেই বিক্রেতাদের আগমন মেলা দুটিকে অন্য মাত্রা দিয়েছিল। রাসমেলায় তো একটা সময় তিব্বতি ও ভুটিয়াদেরও দেখা যেত। তাদের ক্রমহ্রাসমান উপস্থিতি কিন্তু ধারা পরিবর্তনের একটি লক্ষণ। রাসচক্র ভালোভাবে দেখলে তার মধ্যে হিন্দু, মুসলিম ও বৌদ্ধ ধর্মের প্রভাব লক্ষ করা যায়। অতীতে এই অঞ্চলে বৌদ্ধদের সক্রিয় উপস্থিতি বোঝা যায় সেখান থেকেই। ধারা পরিবর্তনে তারাও কিন্তু হারিয়ে যাচ্ছে। সামাজিক বিবর্তনের উদাহরণ এটিও। আর তা ফুটে উঠেছে মেলার ধারা পরিবর্তনে।

সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই পরিবর্তন অবশ্যম্ভাবী। কিন্তু সমস্যা অন্যত্র। আজকাল যেভাবে ধর্মীয় গোঁড়ামি আমাদের মনে গেঁথে বসছে, তাতে শতাব্দীপ্রাচীন এই মেলাগুলির ভবিষ্যৎ নিয়ে ভয় হয়। ধারা বদলাতে বদলাতে এমন অবস্থা হবে না তো, যেদিন মেলার পুরো চরিত্রই পালটে যাবে? নির্দিষ্ট কিছু সীমাবদ্ধতায় ঢেকে যাবে না তো তারা? হয়তো বৃথাই ভাবছি। কিন্তু তবু আসছে সে ভাবনা। ধারা বদল করেও রাস বা হুজুরের মেলা যেভাবে আমাদের বৃহৎ সুরে বেঁধেছে, তার থেকে সামান্য বিচ্যুতি মানেই মেলার অপমৃত্যু। ধারা পরিবর্তনের নিরন্তর খেলায় আর যাই হোক, সেটি কখনোই কেউ চাই না।

পূর্ববর্তী নিবন্ধ
পরবর্তী নিবন্ধ
Uttarbanga Sambad
Uttarbanga Sambadhttps://uttarbangasambad.com/
Uttarbanga Sambad was started on 19 May 1980 in a small letterpress in Siliguri. Due to its huge popularity, in 1981 web offset press was installed. Computerized typesetting was introduced in the year 1985.

Share post:

Popular

More like this
Related

কবিতা

১ ক্যানভাস অনুপ দত্ত অভিমান সরিয়ে বরং লুকোচুরি খেলা হোক এক তাল,...

কোচবিহারের পরেই যে রাসযাত্রা আসবে

পূর্বা সেনগুপ্ত বৃন্দাবনে শ্রীরাধার সঙ্গে কালাচাঁদের মান-অভিমানের পালা চলছে।...

রায়গঞ্জে মিষ্টির অন্য ভুবনে নয়া বাণিজ্যকরণ

দীপঙ্কর দাশগুপ্ত বরোদা থেকে লেখা অলকানন্দাদির একটা চিঠি পেলাম।...

ডিসেম্বরের ডায়েরি

সুমন মল্লিক ছেলে, বৌমা আর নাতনির সঙ্গে সাত বছর...